প্লাস্টিক অভিযান


বিমলকান্তি দাশগুপ্ত



২৮শে নভেম্বর, ২০১৮...

আজ সকালে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পৌরসভার কর্মীরা হঠাৎ করেই প্লাস্টিক দূর করবার অভিযানে বেরিয়েছে। এলাকা বেলঘরিয়া বাজার। দোকানীদের কাছ থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ বাজেয়াপ্ত করছে। আমার দেখা এলাকা- পোষ্ট অফিস থেকে ষ্টেশন। ফিডার রোড। সাফল্য খুব একটা আসবার কথা নয়। এক দোকানের সামনে এক যুবককে বলতে শুনলাম,- ‘আমি দেখতে পেয়েই ছুটে সবাইকে খবর দিলাম, ক্যারিব্যাগ সরিয়ে ফেল। হামলা আসছে’। বলেই মুখে সাফল্যের হাসি। সে হাসিতে আমি আরও দেখলাম রাজনীতির কর্মীদের বোকা বানাবার অহংকার।

এ ধরণের প্রোগ্রামগুলি নেহাতই দলের কর্মীদের চাঙ্গা রাখবার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন নেতাগণ। এর আগেও ঠিক এ ধরণের প্রোগ্রাম অনুষ্ঠান করেছে রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই। এলাকা সেই বেলঘরিয়া বাজার। অনেক দোকানের মজুত ক্যারিব্যাগ বাজেয়াপ্ত করেছে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় দোকানদার তার প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছে স্বগতে উচ্চারণে নোংরা বিশেষণে দল এবং তার কর্মীদের নেতাদের উদ্দেশ্যে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি কয়েকদিন পরেই আগের অবস্থা ফিরে গেছে।


প্রত্যক্ষ করলাম মাঝ বয়সী এক সম্পন্ন মানুষকে। হাতে তার অতি পাতলা প্লাস্টিকে মোড়া একখানা আড়াই হাতই ফুল ঝাড়ু। সদ্য কিনেছেন হার্ডওয়ারের দোকান থেকে। আন্দোলনকারী একজনকে সেটি দেখিয়ে বললেন- এটার কী হবে? কোম্পানি তো এভাবে প্যাক করে ঝাড়ু বেচছে। এটা বন্ধ করবে কে? স্বেচ্ছাসেবকদের এত কথার উত্তর যেমন জানা নেই তেমনই সময়ও নেই। সে এড়িয়ে গেল। যারা প্রত্যক্ষ করলেন, মুচকি হাসলেন।

ঘটনা আমায় নিয়ে গেল আমার স্বেচ্ছাসেবী বয়সে। সময় ঊনিশ শ ঊনষাট। চালের আকাল চলছে। মজুতদারের ঘরে চাল আছে। বাজারে নেই। খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। না ভাগ হওয়া কমিউনিস্ট পার্টির স্বেচ্ছাসেবী আমি। পার্টি ডাক দিল মজুত উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু জোতদারের গোলায় গেল না পার্টি। আমাদের এলাকায় প্রত্যেকের বাড়িতে তল্লাশি করা হল। বেশি চাল থাকলে সে চাল নিয়ে এলাকায় যারা অভাবে আছেন তাদের মধ্যে বিলি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এলাকা আমাদের নিম্নবিত্ত উদ্বাস্তুদের এলাকা। প্রতি পল্লিতে দু’তিন জনের বেশি ভালো রোজগেরে নেই। আবার দিন আনা দিন খাওয়া দুস্থ পরিবার কিছু সব পল্লিতেই আছেন। অভিযানে সামিল ছিলাম আমিও। আমার নিজের বাড়িতেও তল্লাশি পার্টি এসেছিল। কিছুই পাওয়া গেল না। যাদের কাছে পাওয়া যেত সেখানেও পাওয়া গেল না। কারণ খবর তো ঘটনার আগে ছোটে। সম্পন্ন মানুষেরা তাদের উদ্বৃত্ত ভাণ্ডার লঘু করে অনুগত প্রতিবেশীর ঘরে সরিয়ে রেখেছিলেন।

সেদিনের সেই ঘটনার পর সময় আজ অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে গেছে। খাদ্য সামগ্রীর আকাল এবং মজুতদারী ব্যবস্থার অবসান ঘটেনি। দূষণ এবং প্রতিরোধ। অন্যায় এবং প্রতিবাদ। বিজ্ঞান এবং কুসংস্কারের একে অপরের সঙ্গে এমন আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে পৃথক করবার কথা আদপেই টেঁকে না। বড় কারণ প্রতিবাদী রাজনৈতিক দলগুলি পরাবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একই রকমের মিলেমিশে থাকবার দর্শনে বিশ্বাসী। আর এটাই কি আমার দেশ?



বিমলকান্তি দাশগুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং নাট্য ব্যক্তিত্ব।

Comments

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!