নেতাজি

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত

কারও নামের পেছনে ‘জি’ শব্দ ব্যবহার করে না বাঙালি । সম্মান জানাতে পদবির শেষে বাঙালি লেখে ‘মহাশয়’ আর মুখে বলে ‘মশায়’ । ইংরাজি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে মহাশয় বা মশায় ত্যাগ করেছে সে । বদলে নামের আগে বা পরে যোগ করেছে ‘বাবু’ পদের । ইংরাজ এক সময় সারা ভারতে তার রাজ্যপাট বিস্তার করলেও ‘বাবু’ কিন্তু বাংলাতেই রয়ে গেল । বাবু ডাকে এক সময় বাঙালি শ্লাঘা অনুভব করত । ‘বাবু’ নামে এক প্রবন্ধ রচনা করে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সে আমলের আধুনিক বাঙালির এক মজাদার লেখচিত্র এঁকেছেন ।

ব্যতিক্রম দুই বাঙালি । প্রথম জন সন্যাসী বিবেকানন্দ । দ্বিতীয় , সুভাষচন্দ্র বসু । এই দুই বাঙালির কাজ এবং ব্যক্তিত্ব সমগ্র ভারতে স্বীকৃত । তারই চিহ্ন সাম্মানিক এই ‘জি’ শব্দে প্রকাশিত । বিবেকানন্দের পরিচয় স্বামীজি নামে আর সুভাষচন্দ্র হলেন নেতাজি ।
দু’জনেই জাতির পরাধীনতার যন্ত্রণা অনুভব করেছেন অন্তরে । এবং মুক্তির পথের সন্ধান করেছেন । অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন । নিজেদের মতো করে । নিজের নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থচিন্তার বাধা অতিক্রম করে দু’জনেই নিজের দেশকে জীবন পণ করে ভালোবাসতে পেরে ছিলেন । তারই স্বীকৃতিচিহ্ন হল এই ‘জি’ শব্দে । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রকে সম্বোধন করেছিলেন ‘দেশগৌরব’ আখ্যা দিয়ে । কিন্তু ক’জন মনে রেখেছে সে কথা । অথচ অনুগামীদের দেওয়া ‘নেতাজি’ শব্দবন্ধ সুভাষের জন্য সকল পরিচয়কে ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে ।
পূর্বাঞ্চল বাদ দিলে উত্তর ভারতের সকল নেতাই তো নেতাজি । কিন্তু সর্বভারতের বেলায় নেতাজি একজনই । তিনি সুভাষচন্দ্র বসু ।


কী ছিল তাঁর কাজ । কোন পথই বা বেছে ছিলেন তিনি মুক্তির দিশা হিসেবে । তাঁর বিশ্বাস জন্মে ছিল যে অত্যাচার সহ্য করে করে অত্যাচারীকে ক্লান্ত করে দিয়ে অত্যাচার বন্ধ করা যায় না । বিশেষ , যে অত্যাচারের মূলে আছে শোষণ । শোষণে বাধা পেলে নিপিড়ন অবধারিত । ইংরেজ আমাদের শ্রম আর প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করে নিজের জাতের সমৃদ্ধি আর নিজের দেশের সম্পদ বাড়িয়ে চলেছে । এবং সেটা যত চালু থাকছে , আমাদের দেশের দুঃখ দারিদ্র্য আর দৈন্যতা ততই বেড়ে চলেছে । অতএব পাল্টা আঘাত হানতে হবে । কিন্তু কী উপায়ে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন । ইংরাজের শত্রু জার্মানি আর জাপান । ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ । এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে সুভাষচন্দ্র জার্মানি আর জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন । একক চেষ্টায় । জাপানের হাতে বন্দী ছিল ব্রিটিশ বাহিনির অনেক ভারতীয় সৈনিক । তাদের নিয়ে বিদেশের মাটিতে তিনি গঠন করলেন ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ । এবং জাপানের সহযোগিতায় বার্মা সিঙ্গাপুর ফ্রন্ট দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন । আন্দামান নিকোবর দ্বীপ দখল করে কোহিমা পর্যন্ত ঢুকে পড়লেন । কিন্তু ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে কোন সমর্থন পেলেন না । তাঁর অসহযোগ যজ্ঞ পন্ড হবার আশঙ্কায় গান্ধীজি প্রকাশ্যে সুভাষের বিরোধিতায় নামলেন । পার্টির নির্বাচনে সভাপতির পদে নির্বাচিত হয়েও কংগ্রেসে থাকতে পারলেন না সুভাষ । কমিউনিস্টরাও হিটলারের সংগে সুভাষের বন্ধুত্বকে সমর্থন করতে পারলেন না । মুসলিম লিগের প্রশ্ন আসে না । কারণ তাদের দাবি পৃথক রাস্ট্র । তারা মুসলমানের জন্য পাকিস্তান চায় ।
কিন্তু শেষ রক্ষা হল না । যুদ্ধে জার্মান আর জাপানের পরাজয় ,  সুভাষচন্দ্রকেও পরাজিত করল । দ্বিতীয় বার তিনি অন্তর্ধান করলেন । এবং আজও নিরুদ্দেশ । প্রসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ ওটেন , যাঁর সঙ্গে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে ছিল সুভাষের , নিজের ছাত্রকে তুলনা করে ছিলেন গ্রীক পুরাণের বীর আইকেরাসের সঙ্গে । যে কি না সূর্যকে ধরতে গিয়ে হারিয়ে গিয়ে ছিল । নেতাজি ভারতের জনমানসে বেঁচে আছেন । বেঁচে থাকবেন ।

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার