গন্ধ

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, সন্ধ্যা তখন ঘোর। বাইরে বেশ জাঁকিয়ে অন্ধকার নেমেছে। তিথি নিশ্চয় অমাবস্যা হবে। ধীরপায়ে অভ্যস্ত পথে মামার বাড়িতে ঢুকছি। বাঁশের বেড়ার গেট পেরিয়েই বারান্দা। উত্তরে দক্ষিণে টানা ঘর। পুবমুখী দরজা। ছেঁচাবাঁশের বেড়া। টিনের দোচালা। বাঁশের খুঁটির উপর ভর করে আছে টিনের একচালা টানা বারান্দা। ওই বাঁশের বেড়ার আড়াল দিয়েই রচনা করা দু’খানা কামরা। নীচু বারান্দার একধাপ উপরে মূল ঘর। উঠানে ঘন অন্ধকার। নারকেল জাম সজিনা বকুল আর কাঁঠালের গাছেরা আকাশের আলো আড়াল করে রেখেছে।

অন্ধকারে পা টিপে টিপে চলেছি। অন্ধমানুষ চলবার সময় যেমন করে হাত সামনে বাড়িয়ে পথের দিশা ঠিক করে। অনেকটা তেমন করে সামনের ঘর পার করে শেষের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেঁচাবেড়ার জালিছিদ্র ভেদ করে ছোটো ছোটো আলোর বিন্দু মাটিতে ছড়িয়ে আছে। অনেকটা যেন মালা থেকে খসে পড়া পুঁতি। আর যারা মাটিতে পড়তে পেল না, তারা, পাঠশালার ছাত্ররা ছুটির ঘন্টা পড়লে যেমন করে ক্লাসঘর থেকে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে পড়ে ঝাঁক বেঁধে, ঠিক তেমনই যেন ছুটছে। শুধু দেখা যায়  শীর্ণ একটা আলোর রেখা অন্ধকার ভেদ করে আলোর সন্ধানে ছুটে চলেছে। শুধু একটা রেখাচিহ্ন চোখে পড়বার মতো রেখে যায় পেছনে।



দরজা ভেতর থেকে ভেজানো। ভিতরে হ্যারিকেনের আলো। বারান্দা থেকে একটু উঁচুতে ঘরের ধাপে পা রাখলাম। কড়াতে হাত লাগাতেই ভেতর থেকে সাড়া এলো। খোলা আছে। কে, ভেতরে এসো। ভেতরে মুখ বাড়াতেই বললেন, এসো। দেখলাম,  তিনি মেজমামা। বড় একখানা ঘরজোড়া তক্তপোশের উপর তিন জন বসে আছেন। হাতের ইশারায় বসতে বললেন। তুই সম্বোধনে ডাকেন না কা’কেও, নিজের ভাই-বোন ছাড়া। আর আছেন মামিমা আর ছোটমামা। বেশ নিবিষ্ট। কিছু আলোচনা চলছিল তাদের। 

তিন জনের আলোচনার বিষয় মাছের গায়ের গন্ধ। সে তো যারা মাছ খান বা ধরেন অথবা খান না বা ধরেনও না নির্বিশেষে সকলেরই জানা। যারা নিরামিষাশী তারা তো সহ্যই করতে পারেন না মাছের গন্ধ। না সেটা নয়। প্রাণী কিম্বা বস্তু সকলেরই একটা নিজস্ব গন্ধ আছে বা থাকে। গন্ধ, বস্তুটির এক ধরণের পরিচয়। বিষয়টা তা-ও নয়। আলোচনা চলছিল পরিবেশের গন্ধ নিয়ে। যেকোন কিছু, তা প্রাণী হতে পারে। না-ও হতে পারে। স্থানের একটা গন্ধ সে নিজের গায়ে মেখে নেয়। যেমন আলমারি থেকে পোশাক বের করে দেখা গেল, তাতে ন্যাপথালিনের গন্ধ অথবা কালোজিরে কি, কর্পুর, যা পোশাকে থাকবার কথা নয়। এই রকম আর কী। গোয়ালার গায়ে খাটালের গন্ধ। জেলের গায়ে মাছের গন্ধ। এ তো সবার চেনা। সবার জানা। তবে মাছের গায়ে আবার কিসের গন্ধ। তার নিজের গন্ধেই তো নিরামিষভোজীরা তাকে এড়িয়ে চলে।

না, ঠিক তা নয়। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল, বাড়িতে সে দিনের রান্না করা মাছের বিষয়ে। সেই মাছটাতে পাঁকের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ যে জলাশয়ে মাছটা ছিল সেখানে অবশ্যই পাঁক অথবা ঝাঁঝি ছিল। জল নিশ্চয়ই ভালো ছিল না। সেই গন্ধটাই খাবারের পাত অবধি বয়ে নিয়ে এসেছে রান্না করা মৃত মৎস্যের সেই টুকরো। গন্ধের এ এক অন্য পরিচয়। মানুষও এমনি করে শুধু রূপ নয়, স্বভাব নয়। বোধ করি গন্ধও বয়ে বেড়ায় আমৃত্যু।

Comments

  1. শ্রদ্ধেয় বিমলকান্তি দাশগুপ্ত-এর " গন্ধ " পড়ার পর আমার মন অতৃপ্ত রয়ে গেল। বোধ হলো আরো কিছু বাকি রয়ে গেল ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!