উত্তর-আধুনিক সংযুক্ত মোর্চা?

সুমিত ঘোষ  



নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নবান্ন অভিযান করে এবং শহীদ মইদুল মিদ্যার বলিদানের উপর ভর করে বামফ্রন্ট সবুজ-গেরুয়া ইলেক্টোরাল বাইনারী ভেঙে লাইমলাইটে এসেছে। ২১-এর নির্বাচনে ফ্যাসীবাদকে রুখতে তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেস এবং আব্বাস সিদ্দিকী।

সংযুক্ত মোর্চার মূল ভিত্তি হল বিভিন্ন আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত ও কখনও কখনও সংকীর্ণ সামাজিক প্রতিনিধিত্বের (আইডেন্টিটি) জোড়াতাপ্পি মেলবন্ধন ঘটিয়ে বিজেপিকে হারানোর রাজনৈতিক লাইন। অর্থাৎ একটি সরল সমীকরণে আলাদা আলাদা করে যোগ করতে থাকতে হবে একটার পর একটা সামাজিক ফ্যাক্টরের প্রতিনিধিদেরকে।

অঙ্কটা এরকমঃ    

তরুণ মুখ + সংখ্যালঘু + আদিবাসী + উচ্চবিত্ত + ... = তৃণমূল ও বিজেপির থেকে বেশি ভোট

উপরের সমীকরণকে এইভাবেও লেখা যায়ঃ

(সৃজন, দিপ্সিতা, ...) + আব্বাস সিদ্দিকীর অনুগামী + (দেবলীনা হেমব্রম, ...) +  জাতীয় কংগ্রেস + ... = তৃণমূল ও কংগ্রেসের থেকে বেশি ভোট 

এই সরলীকরণের সমস্যা এখানেই যে যোগ করতে থাকা উপরের এক একটা ফ্যাক্টরকে আলাদা আলাদা করে ধরে, প্রত্যেকের প্রতিনিধি খুঁজে বের করে নির্বাচনী জয়ের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। প্রথমত, এই ফ্যাক্টরের কোনও শেষ নেই, শত সহস্র ফ্যাক্টরের আলাদা আলাদা প্রতিনিধি খুঁজতে হলে তা রাজ্যের বিধান সভার ২৯৪টা আসনের থেকে বেশি অঙ্কের সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই কমিউনিস্ট পার্টির সামগ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং ইস্তেহারের ভিত্তিতে লড়াই করা প্রয়োজন এই মর্মে যে তার সকল প্রার্থী নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সেই ইস্তেহারকে বাস্তবায়ন করতে ব্রতী হবে। যদিও এক্ষেত্রে সমস্যা এখানেই যে সামগ্রিক ইস্তেহারের ভিত্তিতে লড়াইয়ের নামে বহুবার এদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি দলিত এবং আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের দাবীকে খর্ব করে ব্রাহ্মণ্যবাদকে ঘুর পথে জায়গা করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সংযুক্ত মোর্চার রাজনৈতিক লাইনের আরেকটা সমস্যা হল যে এই আলাদা আলাদা করে ধরা এক একটা ফ্যাক্টরের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও মিথষ্ক্রিয়াকে এই সরল সমীকরণ নিজের গাণিতিক জটিলতার মধ্যে গ্রাহ্যই করেনা। ফলে সংখ্যালঘুদের ভোট পেতে আব্বাসকে সমর্থন করতে গিয়ে একদিকে মুসলমান সমাজের একাংশের কাছে যেমন বামফ্রন্ট বিরাগভাজন হচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়াতে বিজেপির পথ আরও মসৃণ হয়ে উঠছে ! 

তাহলে উপায় কি? শ্রেণি রাজনীতির মধ্যেই আন্দোলনের ভিত্তিতে উদীয়মান প্রত্যেকটা সামাজিক ফ্যাক্টরকে অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন থেকে বর্তমানে শত হস্ত দূরে অবস্থানকারী সিপিআই(এম) শ্রেণি রাজনীতিকে বাদ দিয়েই বিভিন্ন সামাজিক ফ্যাক্টরগুলোকে আলাদা আলাদা করে অ্যাড্রেস করতেই উদ্যত। তাই সে একদিকে প্রান্তিক লিঙ্গের আন্দোলনকে নির্বাচনী বার্তা দিতে খেটে খাওয়া হিজড়ে সম্প্রদায় ও খেটে খাওয়া প্রান্তিক লিঙ্গের প্রতিনিধিদের বদলে মূলত আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রূপান্তরকামী এবং বিভিন্ন এনজিও (এদের কিছু আবার তৃণমূলের প্রসাদ তুষ্ট)-দের নিয়ে সভা করতে ব্যস্ত, আবার অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে সে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল মৌলবাদী ধর্মগুরু ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। অর্থাৎ সরলার্থে উত্তর-আধুনিকতার তত্ত্বকে হাতিয়ার করে আইডেন্টিটি পলিটিক্সকে তুলে ধরছে বামফ্রন্ট! 

এখন দেখার বিষয় হল, ২রা মে এই রাজনৈতিক লাইনের রিপোর্ট কার্ডে কত নম্বর ছাপা থাকে...



Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views