ফুলেশ্বরের 'সাইনআপ ফাইবার্স' সংলগ্ন 'লেবার লাইন' দখলের প্রচেষ্টা রুখল 'সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন'

নিজস্ব সংবাদদাতা, ৩১শে মে, ২০২১


উলুবেড়িয়ার ফুলেশ্বরে অবস্থিত "সাইনআপ ফাইবার্স" কারখানা সংলগ্ন শ্রমিক বসতি অঞ্চল বা 'লেবার লাইন'-এ আজ জেসিপি ক্রেইন এনে উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেখানকার বহু প্রাচীন গাছ উপড়ে ফেলতে শুরু করা হলে 'সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন'-এর সদস্যরা প্রতিবাদ শুরু করেন। ইউনিয়নের সভাপতি রামবচন সিং জেসিপি-র সামনে শুয়ে পড়ে পথ আটকান। শ্রমিকদের মিলিত প্রতিবাদে আজকের মত উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হলেও আশঙ্কা কমছে না। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে অবন্তী কাঙ্ককরিয়া পূর্বতন হমুনাম কটন মিল কিনে নেন মাত্র ১ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকায়। এভাবেই মফতলালদের হাত থেকে কারখানা  'কাঙ্ককরিয়া গ্রুপ'-এর হাতে চলে আসে জলের দরে। কারখানার পুরনো স্ক্র্যাপ ২ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। কারখানার নতুন নাম 'সাইনআপ ফাইবার্স প্রাইভেট লিমিটেড'। কিন্তু এই মালিকানা হস্তান্তরের সময়ে চুক্তিপত্রে শ্রমিক বসতি অঞ্চল 'লেবার লাইন' কাঙ্ককরিয়াদের অধীনস্থ হয়নি। এই অঞ্চলের জমির বর্তমান বাজার দাম ১০ কোটি টাকার কাছাকাছি কিন্তু একপ্রকার গায়ের জোড়েই এই জমি হাতিয়ে ফ্ল্যাট তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। সেই থেকে আজও, গুন্ডাবাহিনীর উপদ্রব বারংবার সামলেছেন লড়াকু শ্রমিকরা। আন্দোলনকারী প্রেমানন্দ দাঁ আমাদের জানান যে তাঁদের ইউনিয়ন তৈরি হয় ১৯৯৪ সালে। মালিকপক্ষ 'সাসপেনশান অফ ওয়ার্ক'-এর নোটিশ জারী করতে শুরু করলে ২০০২ সালের ১২ই মার্চ মালিকপক্ষ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর সিআইটিইউ-আইএনটিইউসি-টিইউসিসি একযোগে মালিকপক্ষের সাথে সমঝোতা করে শ্রমিকদের 'রিজাইন' দিয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়ার নিদান দেয়। নামমাত্র কিছু টাকার বিনিময়ে নিজেদের কর্মজীবনে আকস্মিক ছেদ ফেলে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি কোনোকিছুর নিশ্চয়তা ছাড়াই উক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলির এই সমঝোতায় বাধাদান করে 'সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন'। ২০০৩ সালে তাঁরা কোর্টের দ্বারস্থ হন। মামলা লড়েন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৫ সালে কোর্ট স্ক্রিনিং কমিটিকে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করতে বললেও তৎকালীন স্ক্রিনিং কমিটির সেক্রেটারি কালী ঘোষ বারংবার শ্রমিকদেরকে তাঁদের প্রাপ্য ভাতা থেকে বঞ্চিত করতে থাকে। এরপর আবার শ্রমিকরা কোর্টের দ্বারস্থ হলে মামলা লড়েন অরুণাভ ঘোষ এবং রাজ্য সরকারের লেবার গ্যাজেটের বন্ধ কারখানার তালিকায় ৩৯ নম্বরে 'সাইনআপ ফাইবার্স'-এর নাম নথিভুক্ত থাকার সুবাদে ২০০৭ সালে হাই কোর্ট রায় দেয় যে ট্রেড ইউনিয়নগুলির শ্রমিকদেরকে এই রিজাইন করার নিদান তাদের এক্তিয়ারভুক্তই নয়, বরং কারখানা বন্ধ থাকাকালীন ৩৬৯জন শ্রমিককে মাসিক ৭৫০ টাকা ভাতা (প্রথমে ৫০০ টাকা বলা হলেও পরে তা বাড়ানো হয়) এবং এককালীন বকেয়া ৪২,০০০ টাকা এরিয়ার দিতে হবে। অন্যদিকে, কারখানা খাতায় কলমে বন্ধ থাকলেও এবং রাজ্য সরকার শ্রমিকদের ভাতা দিলেও কাঙ্ককরিয়া গ্রুপ বিভিন্ন নামে কারখানা চালু রেখেছে, তাও সমস্ত শ্রমিকদের কাজে বহাল না করেই। কখনও নাম 'সাইনআপ ফাইবার্স' তো কখনও 'আশিস ফাইবার্স'! কাজ পেয়েছে ২০০২ সালে রিজাইন করা কিছু শ্রমিকই। এদিকে, 'লেবার লাইন' দখল করার জন্য প্রথমে বামফ্রন্ট এবং পরে তৃণমূল সরকারের আমলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সাথে ঝামেলা শুরু করে। মালিকপক্ষ জমি জবরদখলের অভিযোগ এনে বারংবার এসডিও কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে কিন্তু কোর্টের নির্দেশে সেই জমির উপর নিজেদের মালিকানা প্রমাণ করতে অসমর্থ হলে মামলা খারিজ হয়ে যায়। এখনও এরকম একটা মামলা চলছে। বর্তমান অতিমারীর মাঝে, মালিকপক্ষ স্থানীয় তৃণমূলের বিধায়কের সাহায্যে লেবার লাইনে কমিউনিটি কিচেনের ব্যবস্থা করে এবং পরিস্থিতি বুঝে আজ জিসিপি এনে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করতে সচেষ্ট হয়। 'সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন'-এর রামবচন সিং, মুন্না তিওয়ারীরা এই উচ্ছেদ রুখে দিয়ে স্থানীয় বিধায়কের কাছে গেলে তিনি এই ঘটনায় নিজের জড়িত থাকার অভিযোগকে অস্বীকার করেন; স্থানীয় থানায় ডেপুটেশান দেওয়া হয়েছে এবং বন দপ্তরের কর্মীদের ডেকে এনে দেখানো হয়েছে কিভাবে প্রাচীন গাছগুলি উপড়ে ফেলা হয়েছে। বিনা ক্ষতিপূরণ এবং প্রাপ্য বকেয়া পিএফ গ্র্যাচুয়িটি ছাড়াই বিনামূল্যে কেবল পেশী শক্তির প্রয়োগে মালিকপক্ষের জমি দখল রুখতে সংগ্রামী শ্রমিকরা বদ্ধপরিকর।       

জেসিপির পথ আটকে শুয়ে রয়েছেন রামবচন সিং

ক্ষতিগ্রস্থ লেবার লাইন

Picture Courtesy: Premananda Dan's Facebook Wall  

Comments

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!