'লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে': মমতার শিক্ষানীতি
অভিজ্ঞান চক্রবর্তী
তৃতীয়বারের মতো বিধানসভা নির্বাচনে জিতে আসার পর বুনিয়াদী শিক্ষাকে ধ্বংস করার কাজে অব্যাহত থাকল তৃণমূল সরকার। কর্পোরেটদের প্রসাদ পেয়ে ভোটে জিতে আসার পর থেকে আরও উগ্রভাবে কর্পোরেটবান্ধব চরিত্র নিয়ে হাজির হয়েছে তৃণমূল ৩.০। আগামী লোকসভা ইলেকশনে প্রধান মুখ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে কর্পোরেটের আশীর্বাদ পেতে বদ্ধপরিকর তৃণমূল তাই কর্পোরেট তোষণেই ব্যস্ত। এই কর্পোরেট আগ্রাসনের থেকে রেহাই পাইনি শিক্ষাব্যবস্থাও। একদিকে বুনিয়াদী শিক্ষাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং সরকারী পরীক্ষাগুলিকে মহামারীর নামে বাতিল করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোকে অবাধে চালিয়ে শিক্ষার বেসরকারীকরণকে ইন্ধন জোগান ও অন্যদিকে প্রথম বিশ্বের দেশের ছাত্রছাত্রীদের মতো এদেশের দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করার পথের দিকে ঠেলে দেওয়ার রুটম্যাপ নিয়ে হাজির হয়েছে এই সরকার। এই সরকারই গত ১৫ বছর ধরে রাজ্যে গণশিক্ষার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করেছে। সরকারী এবং সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলোর ভর্তির সাথে সাথে স্কুল স্তরেও বৃত্তি পরীক্ষা এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ভর্তির ক্ষেত্রেও তোলাবাজি চালু করেছে তৃণমূল এবং অভিভাবকদের কাউন্সিলগুলোকেও সম্পূর্ণ বিকল করে দিয়েছে। এর সাথে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি, ছাত্রপরিষদের তোলাবাজি এবং মেরিট লিস্টের গড়মিলের দায়িত্বও যথেষ্টভাবে পালিত হয়েছে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মাধ্যমেই ছাত্র সমাজের বিরাজনীতিকরণ, ছাত্র রাজনীতির পরিসর ধ্বংস করার মাধ্যমে বিনা বাধায় শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
এইবার করোনা আবহকে ব্যবহার করে পরীক্ষার নম্বর পদ্ধতিকেও সম্পূর্ণ বিকল করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাকে বাতিল করেই থেমে না থেকে এবার মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক দিতে না পারা শিক্ষার্থীদের জন্য এক আজব মূল্যায়ন পদ্ধতি হাজির করে শিক্ষার্থীদের আরও অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দিতে চাইছে। এই মূল্যায়ণ পদ্ধতিতে ৫০-৫০ ফর্মুলায় মাধ্যমিকের নম্বর দেওয়ার পদ্ধতি হাজির করেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, যেখানে ৫০% নম্বর দেওয়া হবে নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার এবং বাকী ৫০% নম্বর দেওয়া হবে দশম শ্রেণীর আভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলির রেজাল্টের ভিত্তিতে। উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রেও একইভাবে ৬০% নম্বর দেওয়া হবে ২০২০ সালে একাদশ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে এবং ২০১৯ সালের মাধ্যমিকের "বেস্ট অফ ফোর"-এর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে দেওয়া হবে বাকি ৪০% নম্বর। যদিও এর সঙ্গে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণীর প্র্যাক্টিকাল ও প্রজেক্টের নম্বর। এক্ষেত্রে লকডাউন চলাকালীন যখন সেরকমভাবে কোনো প্রজেক্ট বা প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা নেওয়াই হয়নি, সেখানে এই নম্বর দেওয়া হবে কীসের ভিত্তিতে সে প্রশ্ন অজানাই থেকে যাচ্ছে! এর সাথে সাথেই যে সকল পরীক্ষার্থী নবম শ্রেণীতে খারাপ ফল করলেও দশম শ্রেণীতে ভালো ফল করার সম্ভাবনা ছিল বা মাধ্যমিক বা একাদশ শ্রেণীতে খারাপ ফল করলেও দ্বাদশ শ্রেণীতে ভালো ফল করার সম্ভাবনা ছিল, তারা বঞ্চিত হবে। সর্বাপেক্ষা যে প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে ওঠে, যেহেতু কেউ পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগই পায়নি, সেক্ষেত্রে কেউই ফেল করার উপযুক্ত নয়। এই বিষয়টি বোর্ড বা কাউন্সিল মাথায় রাখবে তো? অন্যদিকে, বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী যাদের সকলেরই পাশ করানো উচিৎ, তাদের উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির দায়িত্বও বর্তায় রাজ্য সরকারের ওপর। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, কলেজের কাউন্সিলিং কেমন হবে সেই নিয়েও। আমাদের দেশে এমনিতেই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার আলো থেকে দূরে ছেঁটে ফেলে শিক্ষার উচ্চস্তরগুলিতে কিছু অল্প সংখ্যককেই নিয়ে যাওয়া কারণ কর্মসংস্থানের সমস্ত ক্ষেত্রগুলোকে ধ্বংস করেই রাখা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এই ধরণের মূল্যায়ণ পদ্ধতি কি আসলে ছাত্র সমাজে অসুস্থ, অবৈজ্ঞানিক ও অর্থনির্ভর উচ্চশিক্ষার প্রমোশন এবং চাকরির অধিকারকে আরও সংকটের মুখে ফেলে দেবে না?
এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের জমানায় সরকারি চাকরি পাওয়ার সমস্ত রুট বন্ধ, গতি সেই বেসরকারী চাকরি যেখানে ন্যূনতম মাস মাইনের কথা ছেড়ে দিলেও কর্মচারীদের বেগার খাটানো এবং ছাঁটাইয়ের ঘনঘটা লেগেই আছে। বিগত দশ বছরে এই সরকার প্রায় সবক্ষেত্রেই নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে, একবার যে টেট নিয়োগ করেছিল তাতেও তোলাবাজি আর স্বজনপোষণের ব্যাপক পর্যায় পৌঁছেছিল। গত সপ্তাহে উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে হাইকোর্টের পুনরায় স্থগিতাদেশ রাজ্য সরকারের দুর্নীতির মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করল। তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর গত জুন মাসে মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেছিলেন যে পুনরায় বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ শুরু হবে এবং সেই দরুণ গত ১৯শে জুন ইন্টারভিউ শুরু হয়। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী নতুন তালিকা তৈরি করা হলেও তাতে প্রার্থীদের নামের পাশে তাদের প্রাপ্ত নম্বর জানানো হয়নি। এর পরবর্তী সময়ে দেখা যায় ৬৮ বা ৭০ নম্বর পেয়ে প্রার্থীরা ইন্টারভিউয়ে ডাক পেলেও ৮০ নম্বর প্রাপ্ত প্রার্থীরা ডাক পাননি। ফলে বঞ্চিত প্রার্থীরা আদালতের দ্বারস্থ হলে শিক্ষার্থী নিয়োগে পুনরায় ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ পায়, যার পরই গত ৩০শে জুন মামলার শুনানির পর শিক্ষক নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অর্থাৎ একদিকে শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বিকল করে দেওয়া এবং অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগকে প্রহসনে পরিণত করার কাজকে অব্যাহত রেখে শিক্ষার সার্কাস রমরমিয়ে চালাচ্ছে প্রশাসন।
প্রসঙ্গত মাধ্যমিক - উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাকে বাতিল করা হলেও জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোকে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে যাতে আকাশ, ফিটজি বা পাথফাইন্ডারের মতো প্রাইভেট কেরিয়ার গাইডেন্স সংস্থাগুলোর স্বার্থ জড়িয়ে আছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে করোনা কি শুধুই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীনই সংক্রমণশীল এবং কর্পোরেটের স্বার্থ জড়িয়ে থাকা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সময় সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়?!
কর্পোরেটবান্ধব ভাইরাসে আক্রান্ত সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারীকরণকে আরো তোল্লাই দিতে হাজির করেছে "স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড"। জয়ললিতা মডেলে চলা মমতা ব্যানার্জী সরকারের এই নতুন প্রকল্পটিতে যে কোনো শিক্ষার্থী ১০ বছর পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলেই এই কার্ড পেতে পারবে। শিক্ষার্থীদের বয়সসীমা ৪০ বছর পর্যন্ত ধার্য্য করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন নিতে পারবে এবং পরিশোধের সময় হবে ১৫ বছর। বর্তমানে এইচ.ডি.এফ.সি., আই.সি.আই.সি.আই এবং অ্যাক্সিসের মতো কিছু বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলোই এই স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা যাতে বিভিন্ন অর্থবহুল প্রাইভেট সংস্থায় প্রস্তুতি বা গাইডেন্স নিতে পারে এবং বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা চালাতে পারে তাই এই ক্রেডিট কার্ডের উপস্থাপনা, এমনটাই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডের স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে বলে রাখা ভালো, এতবছর ধরে আমাদের রাজ্যের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা পৌঁছেছে এবং ২০১৩ সাল অবধি সরকারী কলেজগুলোতে মাত্র বার্ষিক ৭০০ টাকায় পড়াশুনো করে পাশ করেছে, কোনো লোন না নিয়েই, কোনো প্রাইভেট সংস্থার গাইডেন্স ছাড়াই। তারা বিদেশেও গবেষণা করতে গেছে ফেলোশিপ পেয়েই, গ্যাঁটের কড়ি খরচ না করেই। হঠাৎ তাদের লোনের প্রয়োজনীয়তা হল কেন? এমনকী জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতেও গ্রামের দুস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আলাদা করে কোনো ইন্সটিটিউশনে ভর্তি না হয়েই ভালো ফল করেছে, তাদের হঠাৎ করে প্রাইভেট সংস্থাগুলোতে প্রস্তুতির জন্য যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে কেন? সরকারী গণশিক্ষাকে ধ্বংস করে, প্রাইভেট সংস্থাগুলির রমরমা বাড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক বুনিয়াদী শিক্ষাকে ধ্বংস করতেই এই ক্রেডিট কার্ডের উপস্থাপনা। একইসাথে আমাদের রাজ্যে কর্মসংস্থান এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা না কেবল বিত্তশালী পরিবারের পরিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থার ভান করে নিজেদের দায় সেরে ফেলতে চাইছে এই সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রচন্ড ব্যয়সুলভ উচ্চশিক্ষা চালানোর জন্য লোন নিতে বাধ্য হয় এবং যা পরিশোধের জন্য বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে বাধ্য হয়, যার ফলে ব্যক্তি জীবনের কৃষ্টি এবং পড়াশুনার সময়টুকুই পায় না, সেখানে এই রাজ্যেও শিক্ষার সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ করে উচ্চশিক্ষাকে আকাশছোঁয়া খরচসাপেক্ষ করে তোলাই লক্ষ্য এই সরকারের এবং তার জন্যই এই ক্রেডিট কার্ড। নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণকারী নয়াউদারবাদী তৃণমূল সরকারের তাই এই ধরণের পদক্ষেপ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না বরং সরকার যদি এতই মানবিক হয় সেক্ষেত্রে দুস্থ শিক্ষার্থীদের এই ১০ লক্ষ টাকা ভাতা প্রদান করুক।
মূলত একদিকে সরকারি চাকরির পরিবেশকে নষ্ট করে বেসরকারী চাকরিকেই ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং নির্লজ্জভাবে সকলকে বুনিয়াদী শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাথে শিক্ষাকে কর্পোরেট আগ্রাসনের দিকে ঠেলে দেওয়ার এই জঘন্য খেলা আজ প্রকাশিত। ফলে দান খয়রাতির রাজনীতি বর্জন করে, শিক্ষার এবং কর্মসংস্থানের অধিকারের জন্য সরব হয়ে ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনতার রাস্তার আন্দোলনে নামাই একমাত্র পথ।
Comments
Post a Comment