গঙ্গা, ভাঙ্গন, সরকারি অপদার্থতা, মানুষের দুর্দশা

প্রথম প্রকাশঃ সরলরেখা (https://www.facebook.com/saralrekha.wb/posts/1511958325850910) ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২২; ‘জন আন্দোলন’-এর অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশিত হল

‘গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’ ও ‘জন আন্দোলন’-এর যৌথ বিবৃতি

দেশের মধ্যে আছে সে এক দেশ, যেখানে মানুষের কাছে পৌঁছায় না কোনো প্রশাসন বা সরকারি পরিষেবা; কারণ সবকিছুর সাথে তাদের পরিচয়ও গেছে গঙ্গার গর্ভে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সেই '৪৭ পরবর্তী সময় থেকেই গঙ্গার ভাঙ্গন সমস্যার সমাধান তথা পীড়িত মানুষের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি আসছে; কিন্তু ঐ আশ্বাসটুকুই সার, কার্যকরী কোন সমাধান আজও হয়নি। সমাধান দূরের কথা, সময়ের সাথে সাথে অবস্থা আরও খারাপই হয়েছে। সভ্যতার সেই আদিকাল থেকে নদী প্রকৃতির খেয়াল অনুযায়ী তার নিজের পথ তৈরী করেছে, তাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে জনপদ, এগিয়েছে সভ্যতা। নদীর এক কূল ভেঙ্গে, আরেক কূল গড়েছে; মানুষ গঙ্গাকে তার মা হিসাবে মেনে, তাকেই আশ্রয় করে বেঁচেছে। আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যখন ভাঙ্গন-পীড়িত মানুষের কথা ওঠে তখন জবাব আসে, 'নদীতীরে বাড়ি করেন কেন?' তিনি ভুলে যান, সভ্যতার এগিয়ে চলার ইতিহাস ও তার অন্যতম উপাদান, নদীর ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রী তার গালভরা 'নমামি গঙ্গে' প্রকল্প দ্বারা নির্বাচনী ফায়দা তুলেই দ্বায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেন। বেনারসের ঘটে সন্ধ্যারতির ব্যবস্থা করে মোদীসাহেব নিজের জন্য এক জনমোহিনী ভাবমূর্তি গড়তে যতটা তৎপর, তার সামান্যতম দায়বোধ যদি তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ব্যয় করতেন, তাহলে পীড়িত মানুষের দুর্দশা কিছুটা হলেও মিটতো। শুধু বিজেপি সরকারই দায়ী - এমন নয়, আগেকার কংগ্রেস বা অন্যকোন সরকার এব্যাপারে প্রয়োজনীয় সদর্থক ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে কোন তথ্য নেই। গত শতকের ৫০-র দশক থেকে গঙ্গা নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা তথা পরিকল্পনা আলোচনায় আসতে থাকে এবং তারই ফলস্বরূপ গঙ্গা নদীতে বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, তৎকালীন বিহার রাজ্যের অন্তর্গত রাজমহলের কাছে এই বাঁধ দেওয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে মালদহের ফারাক্কা অঞ্চলে এই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ফারাক্কা নিয়ে নানাবিধ তথ্য এখন ইন্টারনেটের যুগে অতি সহজেই জানতে পারা যায়। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৪ সালে, কিন্তু সরকারিভাবে বাঁধটি চালু হয় ২১ এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ৭,৩৫০ ফুট লম্বা। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিমি)। এই বাঁধের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল জলের অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার জলে পুষ্ট করে, দিন দিন ন‍ব‍্যতা হারিয়ে ধ্বংসের মুখে চলে যাওয়া কলকাতা বন্দরকে আগেকার রূপে কার্যক্ষম করে তোলা। ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হয় কলকাতা বন্দরকে পলি জমা থেকে রক্ষা করার জন্য। যদিও সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি এবং বর্তমানে কলকাতা বন্দর ধীরে ধীরে আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশিষ্ষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্য সহ বেশকিছু বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, গঙ্গা/পদ্মার মতন বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান (Upstream) এবং ভাটি (Downstream) উভয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরনের অভিমত সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পিত কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে যা মূলতঃ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ-কেন্দ্রীক বিপর্যয় ডেকে আনে। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে নিম্নরূপ অভিমত প্রকাশ করেন।

1. গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক জল ফিডার খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না।

2. গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে জল সঞ্চালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।

3. প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।

4. ব্রক্ষপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতিশক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরনের নদীর গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering)। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে জলধারা প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার অবধি সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ঐ সমস্ত নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে।

5. ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।

6. শুখা মরশুমে জলপ্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিতে বাধ্য।

এমন কথা উত্থাপন করার কারণে কপিল বাবুকে সেই সময়ে ‘দেশদ্রোহী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল! সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছেই। বৃটিশ সরকারের আমলে, পলি সঞ্চয়ের কারণে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ভিড়ানোর অসুবিধা লক্ষ্য করছিলেন। কারণ হুগলী-ভাগরথী নদী ক্রমশঃ নাব্যতা হারাচ্ছিল। ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছে কিভাবে গঙ্গার জলের এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।

"মহাকালেশ্বর

পাঠায়েছে দুর্লক্ষ্য অক্ষর,

বল্ দুঃসাহসী কে কে

মৃত্যু পণ রেখে

দিবি তার দুরূহ উত্তর।"

শেষের কবিতায় অমিতের জবানিতে, নিবারণ চক্রবর্তীর কবিতার এই শব্দগুলো যেন আমাদেরই আপন কথা। প্রশ্নের উত্তর বা সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য একটা পণ করা খুব জরুরি, যদি প্রয়োজন হয় জীবন পণ। মানুষ সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকেই এভাবেই নিজেদের সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে, লালন করেছে, বেঁচেছে নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাসকে সম্বল করেই। গঙ্গা তীরকে আশ্রয় করে প্রাচীন কাল থেকেই গড়ে উঠেছে নানা জনপদ, গ্রাম, শহর, নগর, বাণিজ্যকেন্দ্র। হিমালয় থেকে সাগরে শুধু জল আর নুড়িপাথর নয়; বয়ে নিয়ে এসেছে আত্মীয়তা, পড়শির খবর আর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধি।

ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের নদীস্তুতি (ঋগ্বেদ ১০।৭৫) অংশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত নদীগুলির তালিকা পাওয়া যায়।  গ্রন্থের ৬।৪৫।৩১ অংশে গঙ্গা শব্দটির উল্লেখ আছে, তবে নদী অর্থে কিনা সেটি এখানে পরিষ্কার নয়। ঋগ্বেদ ৩।৫৮।৬ অংশে বলা হয়েছে "হে বীরগণ, তোমাদের আদিভূমি, তোমাদের পবিত্র সঙ্গীগণ, তোমাদের ধনসম্পদ সবই জাহ্নবীর তীরে।" সম্ভবত এই স্তোত্রে গঙ্গার কথাই বলা হয়েছে। ঋগ্বেদ ১।১১৬।১৮-১৯ অংশে এমনকি জাহ্নবী ও গাঙ্গেয় ডলফিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। গঙ্গার অপর নাম জাহ্নবী। পুরাণে কথিত আছে, মর্ত্যে ভগীরথকে অনুসরণ করার সময় গঙ্গা ঋষি জহ্নুর আশ্রম প্লাবিত করেন। উগ্রতপা জহ্নু ক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেলেন। তখন দেবগণ গঙ্গার মুক্তির জন্য ঋষির কাছে প্রার্থনা করতে থাকলে নিজের জঙ্ঘা বা জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেন। এইরূপে গঙ্গা জহ্নু ঋষির কন্যা রূপে পরিচিতা হন এবং তার অপর নাম হয় জাহ্নবী। পৌরাণিক কাহিনীর কথা অবতারণার কারণ হলো, গঙ্গার প্রাচীন উপস্থিতি ও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সভ্যতার আভাস খুঁজে পাওয়া। ঋষি জহ্নুর জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেওয়ার গল্পকথার মধ্যে যেন ড্রেজিং করে পলি জমে মজে যাওয়া গঙ্গাকে আবার পূর্বারূপে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাই দেখতে পাই। বহতা নদীতে পলি পড়ে তার নাব্যতা হারানো – এক প্রকৃতিগত কারণেই হয়ে থাকে, ফলে নদীতে ফুলে ফেঁপে ওঠা বিপুল জলরাশি তার চলনের সুবিধার্থে অন্যপথ খুঁজে নেয়। একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে – মানুষ তার নিজের মতো করে তার সাথে মানিয়ে নিয়েই বেঁচেবর্তে থাকে। আজকের দিনে, মালদা ও মুর্শিদাবাদে যে ব্যাপক ভাঙ্গন গত অর্ধ শতাব্দীব্যাপী হয়ে চলেছে, তা শুধু প্রকৃতির খামখেয়ালে নয়, হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট বাঁধ তৈরির অবিমৃশ্যকারিতার জন্য। ফারাক্কা বাঁধ-জনিত কারণে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত পড়শি রাজ্য বিহার ও ঝাড়খণ্ডও! এই বাঁধের কুফল অনেক বেশীমাত্রায় ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে, পাশের দেশ বাংলাদেশের মানুষও, যারা সত্তাগত কারণে আমাদের অতি আপনজন। সুতরাং এই সমস্যার ইতিবাচক নিরসনের ইস্যুটি আর শুধু এদেশেই সীমাবদ্ধ না থেকে, এক আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে গেছে। তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলে, পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে থাকার কারণে, তাদের সহায়তায় গড়ে ওঠা ফারাক্কা বাঁধের পুনর্মূল্যায়ন করাটা আজ খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। ফারাক্কা বাঁধ গড়ার ফলে তার উজানে বামদিকে আর ভাটিতে ডানদিকে যে ভয়ঙ্কর ভাঙ্গন ও ভূমিধ্বস, তা আগে আন্দাজ করে বিশেশজ্ঞরা তাদের আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেসব মতামতকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে, ক্ষমতার দম্ভের চূড়ান্ত ফল হলো এই বাঁধ। গঙ্গা ভাঙ্গন ও তার কারণ অনুসন্ধানে তথা ভাঙ্গন পীড়িত মানুষের দুর্দশা লাঘবে গরে ওঠা আন্দোলনে গত পঞ্চাশ বছর ধরে জুড়ে থাকা কেদার মণ্ডলের কথায়, “সাপের ফণা চেপে ধরলে, সে নিজেকে বাঁচাতে বা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এলোপাথাড়ি, অনিয়মিত, আন্দাজহীন ল্যাজ ঝাপটাতে থাকে; যার আঘাত প্রবল।” অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ এই ঋজু মানুষটির এই কথার মধ্যেই আজকের ভাঙ্গন পরিস্থিতির কারণ বলা হয়ে যায়। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, গঙ্গার ভাঙ্গনের জন্য মালদা, মুর্শিদাবাদের সাথে নদীয়া ও বর্ধমানের নদী তীরবর্তি অঞ্চলে ভাঙ্গন হয়েছে, যার ফলে একইভাবে জনপদ, প্রাণীসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু ভাঙ্গনই নয়, গঙ্গার এই অনিয়মিত চলনের ফলে এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বন্যার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়ে গেছে। প্রায় প্রতি বছরই বন্যা যেন সন্নিহিত জেলাগুলোতে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অসহনীয় দুর্যোগের থেকে মানুষকে বাঁচানোর বা তাদের কার্যকরি ক্ষতিপূরণের সেভাবে কোন ইতিবাচক ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। ফলে পড়ে থাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস। আবার ফিরি শেষের কবিতায়;

“ঐ নতুন চাঁদ, আর এ পারে তুমি আর আমি, এমন সমাবেশটি অনন্তকালের মধ্যে কোনদিনই আর হবে না।”

আবদুল্লা যখন বীরনগরে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বলে, আমার দাদা (ঠাকুরদা)-র ১০০ বিঘা সম্পত্তির বেশীটাই ঐ গঙ্গার পেটেই গেছে, তখন সবহারা মানুষের হাহাকার যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে। কারণ এমন অবস্থা তো আরও অনেক মানুষেরই, তাদের অভিজ্ঞতা, দুঃখ, দুর্দশা যে একইধরণের। এমন নয় যে সরকারের দিক থেকে কোনই ভূমিকা রাখা হয়নি। বৃটিশ শাসনের আমলেও নদীভাঙ্গন হয়েছে এবং তা প্রকৃতির নিজের নিয়মেই। কিন্তু তার ভয়াবহতা বা মারণ ক্ষমতা আজকের মতো এতো ভয়ঙ্কর ছিলোনা। তখনও ভেঙ্গেছে মালদহ ও মুর্শিদাবাদের গঙ্গা ও পদ্মার তীর। এই ভাঙ্গন-প্রবণ এলাকার বয়স্ক মানুষেদের মুখে শোনা যায় ওই ভাঙ্গন চলছে প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে! মালদহ জেলার মানিকচকের ১৯টি মৌজা ও কালিয়াচকের ৩১ টি মৌজা ইতিমধ্যে গঙ্গা গর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। এভাবে পশ্চিমবঙ্গে গত পঁচাত্তর বছরে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে সর্বসাকুল্যে প্রায় ৭০ টির মতো মৌজা। সরকারিভাবে নদীর ভাঙন রোধের চেষ্টা চললেও মালদহ ও মুর্শিদাবাদের গঙ্গা ও পদ্মার ভাঙন ঘটে ফি বছর প্রতি বর্ষায়। মালদহের পঞ্চানন্দপুর ও খাসখোলের ভাঙ্গনের তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেলেও হরিশচন্দ্রপুর, রাতুয়া, ইংরেজবাজার ও কালিয়াচকের গঙ্গাতীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাঙনের তীব্রতা ভয়াবহ। বর্ষা এলেই নদীপারের ঘরে ঘরে ছড়ায় নীড়হারানোর আতঙ্ক, ঠিকানা বদলের আয়োজন। মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা থেকে লালগোলা পর্যন্ত পদ্মার তীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভাঙনের ত্রাস ও ইতিহাস প্রায় একইরকম। তা ছাড়া জলঙ্গির টলটলি, পরাশপুর, দয়ারামপুর প্রভৃতি মৌজাও বর্ষায় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে নদীগর্ভে। পরাশপুরের অস্তিত্ব তো সম্পূর্ণ মুছেই গেছে। সম্প্রতি বর্ধমান জেলার কাটোয়ার অন্তর্গত অগ্রদ্বীপের গঙ্গাতীরবর্তী রাজ্য সড়কের অনেকখানি ভাঙ্গনের মুখোমুখি, কিছুটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। গঙ্গা ও পদ্মার ওই ভাঙ্গনের ফলে বহু মানুষ জমিজায়গা, ঘরবাড়ি ও রুজিরোজগার হারিয়ে পথে বসেছে। উদ্বাস্তু মানুষের মতো মাথাগোঁজার ঠাইটুকুর জন্য কী দুঃসহ দুঃখ-কষ্টই না ভোগ করতে হচ্ছে পীড়িত মানুষগুলোকে।

১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ (যা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে আসলে ড্যাম বা জলাধার) চালু হওয়ার পরে যখন মালদা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভাঙ্গন দেখা দেয়, তখন ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের সেচ বিভাগের তরফ থেকে কিছু টাকাপয়সা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু অন্যান্য সরকারি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও দুর্নীতির এক রমরমা ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়। বোল্ডার বিছিয়ে ভাঙ্গন রোধের অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের আড়ালে আদতে কিছু অসাধু আমলা, ইঞ্জিনিয়র, ঠিকাদার, সাপ্লায়ারের মিলিত প্রয়াসে, চুরির এক unholy nexus গড়ে ওঠে। ফারাক্কা ব্যারেজ প্রজেক্টের ত্রুটিযুক্ত প্ল্যানিং-র কারণে যে ভাঙ্গন মালদা ও মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে এক অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কাজের কাজ কিছু না হয়ে, স্রেফ Eyewash হয়েছে। এই কুকর্মে প্রতিটি সরকারি দফতর ও ফারাক্কা ব্যারেজের আধিকারিকরা সরাসরি যুক্ত। ভাঙ্গন পীড়িত মানুষ যেখানে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তখন দুর্নীতির পালে ভর করে কিছু অমানুষ আখের গুছিয়ে নিয়েছে।

পঞ্চানন্দপুর – মালদা তথা উত্তরবঙ্গের এক বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য অঞ্চল, যা আজ গঙ্গার ভাঙ্গনে প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে। এখানে একসময় সেরেস্তা, বিডিও অফিস, হাসপাতাল, উচ্চবিদ্যালয় ইত্যাদি ছিলো, সেসব এখন নদীর গর্ভে। সারা বাংলায় লবণ সরবরাহ হতো এই জায়গা থেকেই। এই গঙ্গাভাঙ্গনে তলিয়ে গেছে; নবী টোলা, ঘাসি টোলা, মাঝি টোলা, হাজারি টোলা, পাল পাড়া, সরকার পাড়া, রামলাল টোলা, সুভানি টোলার মতো আরও অজস্র গ্রাম ও জনপদ। তলিয়ে গেছে এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গঙ্গা ভবনও! পঞ্চানন্দপুরের পাশাপাশি তোফি, উত্তর লক্ষ্মীপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও ভাঙ্গনের প্রভাব খুব স্পষ্টভাবেই লক্ষিত হয়। পঞ্চানন্দপুর ও সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষ ভাঙ্গনে সব হারিয়ে খানিক দূরে সরে এসে বাঙ্গিটোলা বা অন্যত্র কোনরকমে মাথা গুঁজে আছে। কালিয়াচক ব্লক ২-র বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাঙ্গন, তাতে কয়েক হাজার হেক্টর জমি ইতিমধ্যেই জলের তলায়। এই মুহুর্তে গঙ্গা তার নিজস্ব চলার পথ থেকে প্রায় ১৪ কিমি ভেঙ্গে সরে এসেছে। সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ ষোলোবার গঙ্গায় বসতবাড়ি, জমি কাটা পড়ার ইতিহাস একটু কান পাতলেই শোনা যায়। গঙ্গাকে ভালোবেসে, মা হিসাবে ভরসা করে বেঁচে থাকা মানুষেরা আজ পরিবেশ-উদ্বাস্তু।

গঙ্গা নদীর ভাঙ্গনকে শুধু দেশীয় সমস্যা বলে ভাবলে ভুল হবে। গঙ্গার উৎপত্তি পশ্চিম হিমালয়ে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে। দক্ষিণ ও পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এক্ষেত্রে এর দুটি ধারা বা শাখা লক্ষনীয়- একটি ফারাক্কা বাঁধ থেকে এসে ভাগীরথী ও হুগলী নদী নামে মূলত দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে; অপরটি বাংলাদেশ সীমান্তে মহানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নামে গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। ফারাক্কা ব্রীজ তৈরি হওয়ার কারণে যেমন একদিকে মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান জুড়ে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে, সেভাবে অন্যদিকে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে এই বাঁধের নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের অবিসংবাদিত জননেতা মৌলানা ভাসানি-র ফারাক্কা অভিযান বা ‘লং মার্চ’ তো সেদেশে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। খুব বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও স্বাভাবিক চোখে যা দেখা যায়, তাতেই বুঝতে অসুবিধা হয়না, গঙ্গা – যা বাংলাদেশে পদ্মা, তা সর্বনাশের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারাক্কায় বাঁধের ফলে, পদ্মার স্বাভাবিক গতিরুদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে জল্প্রবাহের ব্যাপক হ্রাসের কারণে পদ্মা আজ এক প্রায় এক মরা নদীতে পরিণত। বাংলাদেশের পুরনো মানুষ, যাদের স্মৃতিতে এখনো অতীতের বিশালকায় পদ্মা এবং গোয়ালন্দ ঘাটের ইলিশের কথা শোনা যায়, তা এক রূপকথার মতো মনে হতে বাধ্য। পদ্মার শুকিয়ে যাওয়ার সাথে মরে গেছে বাংলাদেশের বহু ছোটবড় নদী। বড়াল, মরাবড়াল, নারোদ, মুছাখান, ইছামতী, চিকনাই, নাগর, ধলাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, হিসলা, কাজলা, চিত্রা, সাগোরখালি, চন্দনা ইত্যাদি নদী হয় মরে গেছে, অথবা মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। মাইকেল মধুসূদনের কপোতাক্ষও বর্তমানে সময়ের সাথে স্রেফ এক নাম হয়ে রয়ে গেছে! কালিগঙ্গা, বেলাবত প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ নদী আজ বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিবছর গঙ্গা-পদ্মায় যে লক্ষ টন পলি জমছে, তা নদীগর্ভে জমা হয়ে শুধু এই বাংলা নয়, বাংলাদেশেরও ভূপ্রকৃতির বিশাল ক্ষতিসাধন করে চলেছে। এই ভাঙ্গনের খেসারত দিতে হচ্ছে, সন্নিহিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষকেই।

ভাঙ্গনের ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে বললেই এখন রে রে করে তেড়ে আসার লোকের অভাব হবেনা। আগেও এমন কথা বলার ‘অপরাধে’ দেশদ্রোহিতার তকমা জুটেছে, এবারেও যে জুটবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই বাস্তবটা বুঝতে অসুবিধা হয়না। চীন যখন ব্রহ্মপুত্র নদীতে বিশাল বাঁধ দেয় এবং তা যখন অসম সহ উত্তর-পুর্ব ভারতের ভূপ্রকৃতি বিন্যাসে বদল ঘটায় বা প্রতিবছর বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে সংসদীয় দলগুলোর বিভিন্ন নেতাকর্মীদের মধ্যে দেশপ্রেমের উন্মত্ত লহর জেগে ওঠে। তাহলে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা যদি সেই একই কারণে হয়ে থাকে, সেই সত্য কথন দেশদ্রোহিতা বলে আখ্যায়িত হয় কোন যুক্তিতে! ফারাক্কা বাঁধ এক আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার অংশ, তাই প্রয়োজনে এই সমস্যার সমাধান যথোপযুক্ত প্ল্যাটফর্মেই হতে হবে। শুধু বাংলাতেই নয়, ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারেও ভূবিন্যাসে এক আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিবছরই সেখানে বন্যা এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা হিসাবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত। বিহারের অন্যতম নদী কোশী, গঙ্গার চলন-বিভ্রমে আজ নিজের পথ পালটানোর পাগলামিতে মেতেছে, যা সর্বাত্মক ধ্বংস ডেকে আনছে। অবস্থা এতোটাই সঙ্গিন যে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও এখন ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর রাজ্যের বন্যাদুর্গতির জন্য দায়ী করেছেন পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত ফারাক্কা ব্যারাজকেই এবং দিল্লীস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বাঁধ অপসারণের দাবিও জানিয়েছেন। তাহলে, খারাইলো কি? বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও দেশদ্রোহী! বিহারের বন্যাদুর্গত মানুষ, যারা তাদের দুর্দশার জন্য ফারাক্কা বাঁধকে অভিসম্পাত করে, তারা সবাই দেশদ্রোহী! দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী – এই বাদানুবাদ সরিয়ে একবার সৎভাবে মানুষের কথা ভাবা যায় না? রাষ্ট্রনেতারা কবে আর সুবুদ্ধির পরিচয় দেবেন?

নীতিশ কুমারের মতো ফারাক্কা ব্রীজ অপসারণ বা গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবী না ওঠালেও, ফারাক্কা ব্রীজ নিয়ে একটা পুনঃসমীক্ষা বা পর্যালোচনা হওয়াটা খুব দরকার। যে কোন প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই পর্যালোচনা আবশ্যিক এবং ফারাক্কা তার বাইরে নয়। এই ব্রীজ তৈরি হওয়ার পরে গঙ্গার ভাঙ্গন যে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ২৫২৫ কিমি যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গায় গঙ্গার পাড় আদিকাল থেকে অনেক জায়গাতেই ভেঙ্গেছে; কিন্তু ফারাক্কা তৈরি হওয়ার পরে মালদা ও মুর্শিদাবাদে ভাঙ্গনের যে তীব্রতা ও ধ্বংসের রূপ লক্ষ্য করা গেছে, তা ভারতবর্ষের আর কোথাও দেখা যায় না। কোন রাজনৈতিক বিরোধিতার অবস্থান থেকে নয়, সরকারি তথ্য ও ভাষ্যের দিকে নজর দিলেই এই ব্যাপারটি অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। ১৯২৮ সালের মালদা জেলা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার অনুযায়ী, মালদা জেলায় নদীভাঙ্গনের কোন ব্যাপকতা ছিলোনা, মাঝেমধ্যে ‘হাই ফ্লাড’ লক্ষ্য করা যেতো। পশ্চিমবঙ্গেই যেহেতু এই ভঙ্গন সমস্যা তীব্র, সেই কারণেই রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, এই ভাঙ্গন-জনিত সমস্যার প্রতিকার চেয়ে আবেদন জানানো হলে, কিছু আমলানির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়াও হয়েছিল। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, ০২/০৭/২০০১ – এ তৎকালীন সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কেন্দ্রের অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের কাছে এই বিষয়টি উত্থাপন করলেও (ডি. ও. নং. ১০২), সেভাবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলা চলে। ভাঙ্গন প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে ১৯৮০-তে রাজ্য সরকার এবং ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের তরফে দুটি পৃথক বিশেষজ্ঞ কমিটি (Expert Committee) গঠন করা হলেও, সর্বস্বান্ত মানুষ যে তিমিরে ছিলেন, সেখানেই রয়ে গেছেন। যতদিন যাচ্ছে মানুষের ভাষায়, অবস্থা শেষের সে দিন বা রোজকেয়ামত (Doomsday)-র দিকে এগিয়ে চলেছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ চিন্ময় ঘোষ “ফারাক্কা ব্যারাজের রিভিউ হোক অনতিবিলম্বে” নামে একটি চটি বই লিখে গেছেন। যাতে তিনি সরকার দ্বারা ১৯৯৬ সালে গঠিত কেশকার কমিটি’র তথ্য ও প্রস্তাব উল্লেখ করেছেন, “১৯৭০-র বন্যায় কালিয়াচক থানার তোফির কাছে ভূমিক্ষয়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ৭৩০ মিটার। ১৯৭১-র বন্যায় ঐ থানার চর বাবুপুরে এবং ১৯৭২-এ পঞ্চানন্দপুরে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৩১০ মিটার ৫৪৯ মিটার। ১৯৭৩-এ চর বাবুপুরের কাছে খুব বেশিমাত্রায় বিপদজনক ভাবে ভূমিক্ষয় হয়েছিল। ৯৩৯ হেক্টর জমি গঙ্গায় তলিয়ে যায়। ১৯৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৮ - প্রতি বছরই নদী ভেঙ্গেছে যথাক্রমে ১৬২ হেক্টর, ৩০৮ হেক্টর, ৮৯ হেক্টর, ২২৮ হেক্টর অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট ১৮০৭ হেক্টর জমি তলিয়ে যায়। ভূমিক্ষয়ের কারণেই ফারাক্কা ব্যারেজের উজানে নদীর বাঁদিকে একটি খাঁড়ির সৃষ্টি হওয়ায় ব্যারাজমুখী নদীর গতিপথটি এঁকেবেঁকে গেছে। ব্যারাজের ডানদিকে নদীস্রোত কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ব্যারাজের বামপ্রান্তে প্রায় ৭৪ ফিট দীর্ঘ চর তৈরি হয়েছে, যা ব্যারাজের জল নির্বাহি ক্রেস্ট থেকেও ২২ ফিট লম্বা, ফলে ব্যারাজের নকশা অনুযায়ী জল ছাড়ার নির্ধারিত মাত্রা ফুটপ্রতি ৫০০ কিউসেকের চেয়ে বেশী পরিমাণে ফুটপ্রতি ৭০০ কিউসেক জল ডানদিক থেকে ছাড়তে হচ্ছে।” চিন্ময়বাবু আরও বলেন, “১৯৮০ সালে ৩ রা অগাস্ট থেকে ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৫ দিন ধরে ফরাক্কায় গঙ্গাজল বিপদ চিহ্নের উপরে ছিল। উজানে যে গঙ্গা গর্ভ ভরাট হয়ে আছে, এটা তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।” এই তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরির যে পরিকল্পনা বা সার্ভে করা হয়েছিল, আতে ত্রুটি আছে এবং এই ব্যাপক ভাঙ্গনের আসল কারণ সেখানেই নিহিত রয়েছে।

অনেক হয়েছে! প্রায় অর্ধ শতাব্দীকালব্যাপী যে দুর্দশার মধ্যে দিয়ে সাধারন মানুষকে যেতে হচ্ছে, এবার তার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়াটা খুব জরুরি। অন্যথায়, গণতন্ত্রের বড়াই করা এই রাষ্ট্রের শেষ আবরণটুকুও সরে গিয়ে তার জনবিরোধী নগ্ন চেহেরাটা বিশ্বের সামনে এসে যাবে। রাজনৈতিক লাভালাভের প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে, মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারকে স্বীকৃতি দিতেও এই জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিকতা হওয়া উচিৎ। সেটা না করতে পারলে; কিসের নেতা-মন্ত্রী? কাদের সরকার? কার জন্য এই রাষ্ট্র?

ভারতবর্ষের গৃহীত সংবিধানে লিপিবদ্ধ প্রস্তাবনায় উল্লেখিত সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশটি একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। সে হিসাবে রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভূমিকা ও স্বার্থই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন পরিকল্পনা মানুষের লাভ-ক্ষতির সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই হওয়া উচিৎ। সেকারণেই যে কোন প্রজেক্ট-র শুরুর আগেই সেই মর্মে সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন (Feasibility study)-র ক্ষেত্রে শুধু Topographic বা Geo-Technical পরীক্ষানিরীক্ষা করাটাই শেষ নয়; অত্যন্ত জরুরী হলো পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনীতিতে নির্দিষ্ট প্রকল্পটি ভবিষ্যতে কেমন পরিবর্তন বা প্রভাব সৃষ্টি করবে – সেই স্টাডিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। জবরদস্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার জোর খাটিয়ে প্রকৃতির সাথে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াটা এক চরম নির্বুদ্ধিতা। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির ক্ষেত্রে তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রনেতারা সেই আহাম্মকপনাই করে গেছেন, যার মাশুল দিতে হচ্ছে অগণিত মানুষকে। ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে মানিকচক অবধি ৩৫ কিমি এলাকা জুড়ে যে ভাঙ্গন গত প্রায় ৬ দশক ধরে চলছে, তার কোন স্থায়ী সমাধানের কোন পরিকল্পনা বা উদ্যোগ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার – কেউই দেখায়নি।

উত্তরপ্রদেশ, বিহারের বহু ছোটবড় নদীকে শরীরে মিশিয়ে গঙ্গা রাজমহল পাহাড়ের পাশ থেকে যেভাবে আছড়ে পড়ছে বাংলার ভূমিতে, তাকে ধারণ করার ক্ষমতা ফারাক্কা আরও নষ্ট করে দিয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত, বাংলা বিশ্বকোষ-র বর্ণনা অনুসারে “রাজমহলে স্বাভাবিক অবস্থায় গঙ্গার গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ২ লক্ষ ৭০ হাজার ঘনফুট, আর পুরো বর্ষায় ১৮ লক্ষ ঘনফুট।” শুধু বর্ষা নয়, শীত ও গ্রীষ্মে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৩ লক্ষ ঘনফুটের যে প্রবল জলপ্রবাহ ধেয়ে আসে, তার আঘাতটাও কিন্তু নেহাৎ কম নয়। কপিল ভট্টাচার্য তার ‘ফরাক্কা ব্যারাজ ও বন্যা’ নামক প্রবন্ধে লিখছেন, “পাটনার কাছে যেখানে রাজেন্দ্র পুলে গঙ্গার সর্বোচ্চ প্রবাহ ৩০ লক্ষ কিউসেক পর্যবেক্ষিত হয়েছে, সেখানে ফরাক্কা ব্যারাজ পরিকল্পনায় মাত্র ২৭ লক্ষ কিউসেক সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সরল হিসাব মতো, কুশী(কোশী)-র মতো বৃহৎ উপনদীর সঙ্গমের পরে ফরাক্কার কাছে খুব কম করেও ৪০ লক্ষ কিউসেক প্রবাহের উপযুক্ত ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ ছিল।……১৯৭১-র বন্যায় দেখা গিয়েছে, কার্যত ফরাক্কা-ব্যারাজ পরিকল্পিত ২৭ লক্ষ কিউসেক জলপ্রবাহও নিকাশ করতে পারেনি, পেরেছে মাত্র ২৩ লক্ষ কিউসেক। সুতরাং ৪০ লক্ষ কিউসেক থেকে ২৩ লক্ষ কিউসেক বিয়োগ করলে যে ১৭ লক্ষ কিউসেক প্রবাহ বাকি থাকে, সর্বোচ্চ প্রবাহের সেই জল ১৯৭১ সালের বন্যায় বিহার ও মালদহ জেলা ভীষণভাবে ডুবিয়েছে।”

একটু দেখে নেওয়া যাক, ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের সরকারি উদ্দেশ্যটা কি ছিলো; “The Farakka Barrage Project is designed to subserve the need of preservation and maintenance of the Calcutte Port by improving the regime and navigability of the Bhagirathi-Hoogly river system. The river Bhagirathi, the feeder canal and navigation lock at Farakka form part of Haldia-Allahabad inland water way. The principal components of the project are: (a) 2240 meter-long barrage across the Ganga, (b) 213 meter-long barrage across the river Bhagirathi at Jangipur, (c) Feeder canal of 1113 cusec (40,000 cusec) carrying capacity.” – (Source: India, 1998 Ministry of Information and Broadcasting, Govt. of India, chapter – 16) – এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা হয়নি; ফারাক্কায় ব্যারেজের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বের সাথে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যান্য অংশের যোগাযোগের সুবিধার ক্ষেত্রে এই ব্রীজের অপরিসীম ভূমিকা। সরকারের দিক থেকে কেন এই কারণটি দেখানো হয়নি, সেটা এক লাখ টাকার প্রশ্ন। কেন এই ব্যারেজ তৈরি করার ব্যাপারে অনেককিছুই গোপন করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন আজও না তুললে, আর কবে! বর্তমান সময়ের ছবিটার সাথে এই কথাগুলো মিলিয়ে দেখলেই পরিকল্পনার ব্যর্থতার ব্যাপারটি সহজেই মালুম হয়। প্রমাণ, যুক্তি ঢোকেনা শুধু আমলা আর রাজনীতির খেলোয়াড়দের মাথায়! কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো যায়নি। ভাগীরথী-হুগলি নদীর নাব্যতা বাড়েনি। বদলে ফারাক্কার উজানে ও ভাটিতে পলি জমে, নদীখাতের চরিত্রের বদল ঘটে গেছে। অর্থাৎ প্রধান যে দুটি কারণ সরকারিভাবে দেখানো হয়েছিল, দুটিই ফলাফলের নিরিখে নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।

আড়াই হাজার কিমি যাত্রাপথে গঙ্গা যে বিশাল পরিমাণ জলরাশি বয়ে নিয়ে আসে, তা বহুকাল ধরেই শুকিয়ে যেতে থাকা মূলতঃ তিনটি নদীখাত ভাগীরথী, পাগলা, কালিন্দ্রী দিয়েই বয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু এই মুহূর্তে নদীগুলির সেই ধারণক্ষমতা নেই। পাগলা ও কালিন্দ্রী প্রায় শুকিয়ে মজে গেছে, আর ভাগীরথী এখন কোনমতে বেঁচে আছে। ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার রাজধানী ছিলো গৌড়, যাকে গৌড়লখনৌতি বলেও অভিহিত করা হয়। এই নগরী ছিলো ভাগীরথী, যা গঙ্গার মূল স্রোত হিসাবেই বিবেচিত হতো, তার দ্বারাই সমৃদ্ধ জনপদ শুধু নয়, রাজধানী হয়ে উঠেছিলো। পাল বংশের রাজা, ধর্মপাল (খৃঃ ৭৮০-৮২০)-র সময়কার খালিমপুর তাম্রশাসন অনুযায়ী, সেই সময় রাজমহলের উপরেও গঙ্গা নদী ভাগীরথী নামেই পরিচিত ছিলো এবং পুরো অঞ্চলটি বৃহত্তর বাংলার অংশ ছিলো। এই তথ্য প্রমাণ করে, ভাগীরথীই হলো গঙ্গার প্রধান প্রবাহপথ, এখন যা ভাবা হয় সেই পদ্মা নয়। পরবর্তীতে গঙ্গা ও মহানন্দার চলন পালটে সরে যাওয়ার দরুণ, ধীরে ধীরে কৌলীন্য হারিয়ে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে পৌঁছে গৌড় এক অস্বাস্থ্যকর জলাভূমিতে পরিণত হয়ে পরিত্যক্ত হয়। ভাগীরথীও তার কৌলীন্য হারায়।

আজ যখন ভাঙ্গন-পীড়িত মানুষের অবস্থান থেকে সমগ্র অবস্থাটা খোলা মনে দেখা যায়; তখন সেখানে গঙ্গা, তার চলন, ফারাক্কা বাঁধ, পাড় ভেঙ্গে তলিয়ে যাওয়া, নদীবক্ষে চর গজিয়ে ওঠা, মানুষের স্থান থেকে স্থানান্তরে উদ্বাস্তুর মতো ছড়িয়ে গিয়ে বেঁচে থাকার আকূল প্রয়াস – সব নতুন আঙ্গিকে ধরা দিতে বাধ্য। সেখানে শুধু মানুষের জান বা সম্পত্তি হারানোর গল্প নেই; আছে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিকতা হারানোর বুক-ভাঙ্গা হাহাকার। আছে সমগ্র বাংলার সাথে ষড়যন্ত্রের চোরাগোপ্তা, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণের ইতিহাসও। এই দেশের মধ্যেই হারিয়ে আছে এক অন্য দেশ! যেখানে মানুষ আছে, জীববৈচিত্র্য আছে, জমিজিরেত আছে, নিজেদের মতো নিয়ম তৈরি করে বাঁচার চেষ্টা আছে – শুধু নেই তার কোন স্বীকৃতি। ‘এ কূল ভেঙ্গে, ওকূল তুমি গড়ো…’ – এই প্রাকৃতিক নিয়ম মেনেই তো অ্যামাজন, নীল, ভোলগা, টেমস, শ্যেন, মেকং, ইয়াংসি-র সাথে গঙ্গা, পদ্মা, গোদাবরী, কাবেরি, বিপাশা, ব্রহ্মপুত্র, সুবর্ণরেখা, দামোদর, তিস্তা – এই নিয়মেই ইতিহাসপূর্ব সময় থেকেই বয়ে চলেছে। গঙ্গার ভাঙ্গন তীর কেটে আবার নতুন করে মাঝদরিয়ায় বা অন্য কোনখানে নতুন স্থলভাগের জন্ম দিয়েছে। সব হারিয়ে মানুষ, হয় নদী থেকে দূরে গিয়ে নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজেছে, নয়তো অনন্যোপায় হয়ে গজিয়ে ওঠা চরে প্রাণ হাতে করে পরিবার নিয়ে লড়াই চালাচ্ছে।

প্রায় ৬০ বছর আগে গজিয়ে ওঠা এমন এক বিশাল চর ফারাক্কার অনতিদূরে আছে, যেখানে এখন প্রায় ২ লক্ষ মানুষ বাস করে! যারা সেখানে বাস করেন তাদের প্রায় সবাই উত্তরাধিকার ও জাতিসত্তা অনুযায়ী বাঙালি! বাংলা তাদের মাতৃভাষা! তাদের সংস্কৃতি বাংলার রূপ-লাবণ্য, জল, জমিকে ঘিরেই তৈরি। কিন্তু তারা সবাই আজ এক পরিচয়হীন ভূভাগের বাসিন্দা। এখনকার মানচিত্রের দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাওয়া যাবে, কিভাবে হঠাৎ করে কাল্পনিক সীমানা রেখা নদীর ভেতর নিয়ে এসে, এলাকাটিকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন বলে দেখানো হয়েছে! চরের মধ্যেকার জমি এখনো পলাশগাছি, পিয়ারপুর, পরাণপুর, শ্রীঘর, কাঁচি, কে বি ঝাউবোনা প্রভৃতি আরও অনেক মৌজার অন্তর্গত, যার রেকর্ড এখনো, মালদা জেলার কালিয়াচক ব্লক ২-র ভূমি দফতরেই রক্ষিত! কোন এক অজানা, সন্দেহজনক কারণে প্রথমে কংগ্রেস, তার পরে বামফ্রন্ট বা এখনকার তৃণমূল সরকার - এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন – এক্কেবারে স্পিকটি নট! আগে বিহার সরকার এবং এখন ঝাড়খণ্ড সরকার এই এলাকায় নাম কা ওয়াস্তে পরিষেবা দেওয়ার ভড়ং দেখিয়েছে। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে তাদের সেরাজ্যের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড করে দিয়েছে। যেখানে ২ লক্ষ মানুষের বাস, সেকানে হোন উচ্চ বিদ্যালয় নেই, কলেজ তো দূরের কথা। নেই সামান্যতম স্বাস্থ্য পরিষেবা। অসুখবিসুখে বা সন্তান প্রসবকালে ভরসা নৌকায় করে বাঙ্গিটোলা বা মালদহ হাসপাতাল। অনেকের ঐ যাত্রাই শেষ যাত্রা হয়। চরে জেগে ওঠা তাদের নিজস্ব জমি এখন রেকর্ড করা বন্ধ রেখেছে বাংলার সরকার, আর ঝাড়খণ্ড তা করতে পারেনা, কারণ রেকর্ড তো এরাজ্যের ভূমি দফতরে! এই মানুষগুলো বাংলার সন্তান; এদের মায়ের মুখের ভাষা, পুরুষানুক্রমে পাওয়া সংস্কৃতি, এদের জাতিসত্তাগত পরিচয় চক্রান্ত করে ছিনিয়ে নেওয়ার কোন অধিকার রাষ্ট্রের নেই, থাকতে পারেনা।

“নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপাড়েতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস।”

(গতকালের পরে) রবীন্দ্রনাথ যখন এই শব্দগুলো লিপিবদ্ধ করেন, তখন গঙ্গার ভাঙ্গন একটা জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে সামনে আসেনি। আজ আর কোন নির্দিষ্ট একটি দিক নয়; দু’পাড়েই মানুষের হাহাকার আর দিশাহীনতা খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। দুদিকে সমস্যার ধরণ হয়তো আলাদা, কিন্তু কারণ এক – গঙ্গার এলোপাথাড়ি ভাঙ্গন। ফারাক্কা বাঁধের প্রযুক্তিগত ত্রুটি, পরিকল্পনায় খামতি ইত্যাদি নিয়ে বিশদে আলোচনা করাটা আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সেই কাজটি নাহয় প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞরা করবেন, কিন্তু এই ব্যারেজ যে তার উদ্দেশ্য সফল করা দূরের কথা, সমস্যা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়েছে, তা এই প্রায় ৫-৬ দশকে প্রমাণিত। গত শতকের ’৮০ ও ’৯০-র দশকে গঙ্গার ভাঙ্গন পঞ্চানন্দপুর, মাণিকচক, রতুয়াতে যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো; আজ সেসব অঞ্চলে তার প্রকোপ অনেকটাই কমে, তা কালিয়াচক ব্লক ২-র বীরনগর অঞ্চলের দিকে সরে এসেছে বলা যায়। ২০২১ সালের জুলাই-অগাস্টে বীরনগর অঞ্চলের চীনাবাজার, বালুগ্রাম, ভীমা গ্রাম, বিজলি টোলা, দুর্গারাম টোলা, সরকার টোলা, মুকুন্দ টোলা, নতুন হাট প্রভৃতি জনপদগুলো আজ প্রায় সবটাই গঙ্গার ভয়াল ভাঙ্গনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সহায়সম্বলহীন মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে বা বিড়ি কারখানার ব্যবহার না হওয়া ঘরগুলোতে। সরকারি সাহায্য বলতে এখনো তেমন কিছুই মেলেনি বললেই হয়। স্থানীয় MLA তথা রাজ্যের মন্ত্রী বা সরকারের ভূমিকা? চামাগ্রামে যে স্কুলে অসহায় মানুষগুলো জন্তুর মতো দলা পাকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, সেখান থেকে তাদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার জন্য স্কুলের বিদ্যুতের কানেকশন কেটে দেওয়া হয়েছে! 

ভাঙ্গনকে ঘিরে যে ব্যাপক দুর্নীতির চাষ হয়, তা ঐ পীড়িত মানুষগুলো তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানে। ভাঙ্গন প্রতিরোধে একের পর এক বাঁধ তৈরি হয়েছে; কিন্তু ১, ২, ৩,……থেকে শুরু করে ৮, ৯, ১০ – একের পর এক বাঁধ ভেঙ্গেছে কয়েক দশক ধরে। মানুষ তার শেষ সম্বলটুকু ৯যদি কিছু আদৌ বাঁচাতে পেরে থাকে) নিয়ে আরও দূরে সরে গেছে। হয়তো মালদা বা গাজলের দিকে চলে গেছে। কেউ হয়তো আরও দূরে তামিলনাড়ু, কেরালা, দিল্লী বা, মধ্যপ্রাচ্যে! অনেকেরই সেখানে অবস্থা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বা প্রায় ক্রীতদাস! সম্পন্ন চাষী, যার হয়তো ২০০ মণ ধান কি ১৫-২০ মণ কলাই হতো, সে এখন সব হারিয়ে PWD রাস্তার ধারে পরিবার নিয়ে মাথা গুঁজে আছে। এখানে লোকের কাছে কাজ চাওয়াটা তার সম্মানে লাগে, সে খুঁজে নেয় এক অচিন ঠিকানা, যেখানে সে শুধুই এক ভিনদেশী আগন্তুক বা খেটেখাওয়া শ্রমিক। যে জমিগুলো চরে জেগে উঠেছে, সেখানে নিজেদের মতো করে আমিন নিয়ে গিয়ে মাপজোক করে কিছু কিছু চাষাবাদ করলেও, সেখানে তাদের মালিকানা-স্বত্ব ফিরে আসছেনা। সেই জমিগুলোকে ভূমি দফতর থেকে ‘গাঙ সিকস্তি’ অর্থাৎ নদী বলে দেখানো হচ্ছে! ফলে নিজের জমিতেই ‘অবৈধ’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত হওয়াটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে! নদীর স্বাভাবিক পার ভাঙ্গার ফলে জমি একদিকে ভাঙ্গলে, অন্যদিকে জেগে ওঠার পরে তার মালিকানা যার জমি কাটা পড়েছে, তারই হওয়ার কথা – এখানে তা হয়না।

এবার সরকারি কাজের নমুনা একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যাক। ১৯৬৮ সালে তিস্তার বড় মাত্রার বন্যার পরে যৌথ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন তৈরি করা হয়। কমিশন গঠনের ৩০ বছর পরে এক অনুসন্ধানে জানা যায়, এতোগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরেও সেই কমিশন একবারও বসতে পারেনি বা বসেনি! ১৯৭৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় সারা পশ্চিমঙ্গ-জুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই সময়ে কিছু শুভবোধসম্পন্ন মানুষ বলেন যে, বন্যা রুখতে হলে, সারাবছর ধরেই নদীর জলপ্রবাহের একটা খতিয়ান থাকা প্রয়োজন। তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেচ বিভাগের দু’জন প্রকৌশলীকে দিয়েই এই কাজটি করা হোক, তাতে আলাদা করে আর্থিক দায় বাড়ার সম্ভাবনা থাকেনা। সেসময় অর্থ দফতর প্রথমে খরচের কথা ভেবে আপত্তি জানালেও, পরে ছাড় দেওয়াতে সেই সেল তৈরি হয়। ২০ বছর পরে খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, সেই সেল একটিমাত্র বৈঠক করেছিল। সেই প্রথম, সেই শেষ! এই সহস্রাব্দের শুরু থেকে আজ অবধি আরও কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হয়েছে; কিন্তু কাজের কাজ? সঠিকভাবে বলতে গেলে, অশ্বডিম্বই প্রসবিত হয়েছে। গণতন্ত্রে আইন, নিয়ম, হিসাব, উন্নয়ন – সবকিছুই তো মানুষের জন্যই হওয়া উচিৎ। জনপ্রতিনিধিরা সেই কাজটিই না করলে, তাকে মান্যতা দেওয়ার কোন দায় সর্বহারার থাকে না।

কীর্তিনাশা – পদ্মানদী(আদতে গঙ্গা) এই নামেই খ্যাত বাংলার লোককাহিনী, লোকগান, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে। এই নামের কারণ হলো, নদীর খামখেয়ালী পথ-বদলের খেলা, যা সর্বগ্রাসী। ১৮০১ সালে মেজর কোলব্রুক, তাঁর গবেষণাপত্র, On the courses of the Ganges through Bengal লেখাতে নির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, “The quantity of land which has been destroyed by the river in course of a few years will amount upon most moderate calculation to 40 sq. miles or 25600 acres, but this is counter balanced in a great measure by alluviation which has taken place on the opposite shore.” এছাড়াও, ১৮৭৬ সালে WW Hunter সাহেব তাঁর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সম্মীলনে লেখা, ‘A statistical Account of Bengal (Dist. Murshidabad) বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘an acre of land was engulfed by the gnawing Padma within half an hour.” নদী ভাঙ্গন এক অবশ্যম্ভাবী ইস্যু, যা এড়ানো মুশকিল। কিন্তু যে ভাঙ্গন মনুষ্য-সৃষ্ট বা উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে জোরপূর্বক বাগ মানানোর চেষ্টা – তা এড়ানোর উপায় কিন্তু মানুষের হাতেই। বাংলা, বিহার সহ পূর্বোত্তর ভারতের জনপদ ও সভ্যতার গড়ে ওঠার পেছনে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশালাকায় নদ বা নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বৈদিক সময়ের শেষের দিকে যে আর্যাবর্তের কথা নানান আলোচনায় সামনে আসে, তা প্রধানত গড়ে উঠেছে গঙ্গাকে কেন্দ্র করেই। তাই এই নদী বিশেষ গুরুত্ব দাবী করে।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন, ভাঙ্গন পীড়িত মানুষের এক বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয় পূর্ণ পুনর্বাসন ও ভদ্রগোছের ক্ষতিপূরণ, যার কোনটাই এযাবৎকাল কেউই পেয়েছেন বলে জানা যায়না। পাড় ভেঙ্গে, জমি আবার করে নদীর মাঝে জেগে উঠলে তার চরিত্র ঠিক কি – এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্দশায় জর্জরিত মানুষ এ-দোর থেকে ও-দোর ঠোক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছে; জুটছে বঞ্চনা, খুব বেশী হলে একটা ত্রিপল! ক্ষতিপূরণ হিসাবে অতীতে যা দেওয়া হয়েছে বা এখন কিছু কিছু যা দেওয়ার কথা হয়, তা এই মানুষগুলোর সাথে এক পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। তাদের প্রতি এক চরম অসম্মান প্রদর্শন ছাড়া একে আর কিই বা বলা যায়! গত শতাব্দীর ’৬০-র দশক থেকে যে ভাঙ্গনের প্রকোপ বেড়েছে, তা যে মূলতঃ ঐ ফারাক্কা-র জন্য, এই ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত। এমনকি, সরকারি বা আমলাতন্ত্রের মধ্যেও এই নিয়ে খুব কিছু বিতর্ক আছে বলে জানা যায় না। ফারাক্কা ব্যারেজ প্রজেক্ট-র আধিকারিকরা কিছু ‘থুক পালিশ’ মার্কা কাজ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি বললেই চলে। কিন্তু রাজ্য সরকারের সেচ দফতর বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (Disaster Management) আধিকারিকরাই বা কি করেছেন, যাতে তাদের সাধুবাদ জানানো যায়! পুনর্বাসনের নামে এক কাঠা বা তার চেয়ে কম একটি প্লট আর কয়েক হাজার টাকা, যা ভিতটুকু গড়ার জন্যও যথেষ্ঠ নয়। এবারের বীরনগর গ্রামের ভাঙ্গন পীড়িত কিছু পরিবারকে একটি নীচু ডোবা-সদৃশ জায়গায় বসানোর চেষ্টা হয়েছে। এক জলের ধার থেকে বাঁচতে, আরেক জলের মধ্যে এসে পড়া! আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই জমিটা আবার বীরনগর হাইস্কুলের খেলার মাঠ, অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার মাঠটুকুও কেড়ে নেওয়া হলো। বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে গেলেও, জল সরে গেলে জমিটুকু অন্তত ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে, কিন্তু ভাঙ্গন সেই সুযোগ দেয় না।

জমি-বাড়ি-বাগান যদি নদীতে চলে যায় এবং নদীর মালিকানা যদি রাষ্ট্রের হয়, তাহলে হারানো সম্পত্তির সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণের দায় সরকারের কেন নয়? কোন যুক্তিতে সরকার এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে? চরের জমি ‘পয়স্তী’ (Upland), না ‘গাঙ সিকস্তি’ (River) – এই কূটকচালের বা কুযুক্তির দোহাই দিয়ে সরকার মানুষকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে। যে জমি ডাঙা, তাকে জবরদস্তি নদী কেন বলা হবে! চরের ২ লক্ষ মানুষ কেন তাদের অস্তিত্বহীনতার কোন সমাধান পাবেন না? এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন আছে, কিন্তু তার ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ জনবিরোধী বলেই প্রমাণিত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে ১৮২৮ সালে তৈরি Bengal Alluvion and Diluvion Regulation আইন প্রণীত হয়, যা এখনো এই সংক্রান্ত আইনি সমাধানের ভিত্তি! বৃটিশ আমলে সেই ১৮৯৬ সালে Maharaja of Dumraon v. Secretary of State for India–র মধ্যে গোদাবরীর চরে জেগে ওঠা জমি নিয়ে তৎকালীন Privi Council-র রায় কিন্তু জমির মালিকের পক্ষেই গেছিলো। সেক্ষেত্রে বর্তমানে যাদের জমি গঙ্গায় বা অন্য নদীতে কাটা পড়েছে তারা কেন চরের জমির মালিকানা ফিরে পাবে না? সওয়া ‘শ বছর আগে যে সিদ্ধান্ত আইন মোতাবেক হয়েছিল, তা আজকের দিনে কেন হতে পারে না? পারে, শুধু প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা আর দায়বদ্ধতা।

আশ্রয়হীন, অসহায় মানুষ সরকারি দফতর, আমলা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে সেই শাসকদলের নেতাকর্মী – সবার দুয়ারে মাথা কুটেছে, শুধু খানিক সাহায্যের আশায়। গত শতকের শেষ দশকে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে তৈরি হয় ‘গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি।’ ঘরোয়া সভা, পথসভা, প্রচার, জনসভা, সাইকেলে মালদহ অভিযান, নৌকায় ফারাক্কা ঘেরাও, টানা অবস্থান – সংগঠন থেকে একের পর এক কর্মসুচি নেওয়া হয়েছে। কলকাতা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকরা পৌঁছে গেছেন গঙ্গার তীরবর্তী ঐ অসহায় সহ-নাগরিকদের পাশে। ২০১২-১৩ অবধি একটানা এই লড়াই চলার পরে, আন্দোলনে ভাঁটা আসে এবং একটা সময় তার আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়। ২০২১-এ ‘জন আন্দোলন’ বলে সংগঠনটি, মালদহতে ৫ ডিসেম্বর, ২০২১-এ এক কর্মী সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নেয় যে ভাঙ্গন পীড়িত মানুষের হক আদায়ের লড়াইকেই তারা পাখির চোখ করবে। সেই মোতাবেক, ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সার্ভে করে ০২ জানুয়ারি, ২০২২; বীরনগর গ্রামে এক গণ কনভেনশন আয়োজিত হয়। ‘গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’ এবং ‘জন আন্দোলন’ যৌথভাবে এই কনভেনশন করে, যেখানে নিম্নোক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

সাথী,

গঙ্গা ভাঙ্গন কোন নতুন ইস্যু নয়, ইতিহাস-পূর্ব সময় থেকে আজ অব্দি তার ভাঙাগড়ার সাক্ষী থেকেছে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূভাগ। এই বাংলাতে তার আপন খেয়ালে গতি পরিবর্তন ও তার দ্বারা ঘটে যাওয়া ভাঙ্গনের ফলে তীরবর্তী মানুষ, জমি, প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগেও ঘটেছে, এখনো তা হয়ে চলেছে। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে যে ভাঙ্গন মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান ইত্যাদি জেলায় হয়ে চলেছে, তা প্রকৃতির আপন খেয়ালে নয়; হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের কারণে। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্রীজ চালু হওয়ার পর থেকেই মালদহ, মুর্শিদাবাদ সহ গঙ্গা-তীরবর্তী জেলাগুলোয় ভাঙ্গন এক বিভীষিকা হয়ে দেখা দিয়েছে। স্মরণে রাখা যেতে পারে, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা চলাকালীন বহু নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা এই বাঁধ নির্মাণের ক্ষতির আশঙ্কা করে তার নির্মাণের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে, সরকারকে বাঁধ তৈরী করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকার এই সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করে, একরকম জবরদস্তিভাবেই বিশাল বাঁধ দিয়ে গঙ্গার আপন চলার ছন্দকে শুধু বিপথগামী করা নয়, তার বেঁচে থাকাটাকেও অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢেকে ফেলে!

মালদহ জেলায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর থেকেই অনিয়মিত ভাঙ্গন দেখা দিতে থাকে; আজ যা গঙ্গা তীরবর্তী মানুষের জীবন, জীবিকা, বেঁচে থাকাটাকেই চরম সংকটের মুখেই শুধু ফেলে দেয়নি, সমগ্র বাংলার ভূগোল, ইতিহাস বা অর্থনীতিতেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পঞ্চানন্দপুরের মতো সমৃদ্ধশালী জনপদকে একরকম ধ্বংস করেছে এই মনুষ্য-সৃষ্ট গঙ্গা ভাঙ্গন। ভাঙ্গনের পরে গঙ্গার বুকে গজিয়ে ওঠা চরের জমিতে এখনো জমি-হারানো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তার অধিকার ফিরে পায়নি। ফিরে পায়নি তার বেঁচে থাকার অবলম্বন জমিটুকু। এক ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যারা ভাঙ্গন পরবর্তীতে গজিয়ে ওঠা চরে কিছু কিছু চাষাবাদ করছেন বা সেখানে কোনরকমে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই খুঁজে নিয়েছেন, তারা সরকারের অসহযোগিতা ও বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনার মাত্রা এমনই যে, তারা আজ তাদের নাগরিকত্বের অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। বাংলার মানুষ; বাংলা যাদের মাতৃভাষা, তার সংস্কৃতি চর্চার অভ্যাস, এই ভূখণ্ডে যাদের পূর্ব পুরুষেরা আবহমানকাল ধরে বাস করে আসছেন - তাদের আজ ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা বানানোর এক চক্রান্ত চলছে। পরিচয় হারানোর শঙ্কায় এই মানুষগুলোর অস্তিত্বই আজ এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা সহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে ভাঙ্গন-পীড়িত এই মানুষগুলোকে বঞ্চিত করছে সরকার। এই কনভেনশন সরকারের এহেন অযৌক্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকার তীব্র নিন্দা করছে এবং গঙ্গার ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে দাবি রাখছে:

  • Ø  গঙ্গা ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত মানুষকে কার্যকরী পূর্ণ পুনর্বাসন দিতে হবে;
  • Ø  সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ইতিবাচক, বাস্তবসম্মত, প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে;
  • Ø  ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যাতে তার সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার প্রাপ্ত হয়, তা নিশ্চিত করতে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে ভাঙ্গন-পীড়িত হিসাবে পরিচয়পত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে;
  • Ø  ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের রিভিঊ করে সরকারের তরফে এক শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে;
  • Ø  গঙ্গার এই ভাঙ্গনকে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করতে হবে;
  • Ø  ভাঙ্গন-রোধে পুকুর চুরি করা পরিকল্পনা নয়, সঠিক বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা ও তার সদর্থক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে;
  • Ø  প্রশাসনিক অবহেলা ও নানান স্তরের দুর্নীতি রোধ করে দেশের সম্পদের অপচয় ও লুন্ঠন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

সংগ্রামী অভিনন্দনসহ,

গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি

জন আন্দোলন

কেদার মণ্ডলের মতো অশীতিপর যুবা, খিদির বক্স, তারিকুলের মতো পোড় খাওয়া নেতা এবং তার সাথে আজ আবদুল্লা, নৌশাদ, তোজবুলের মতো জনপ্রিয় মানুষেরা আজ আবার নতুন করে কোমরে কষি বেঁধেছে সরকারের কাছ থেকে তাদের অধিকার বুঝে নিতে। লড়াই জারি থাকছে

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার