রবীন্দ্রনাথ কি বাঙালির বহিরঙ্গের প্রসাধন

বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত

 

তখন আমি বরিষ্ঠ বালক। শীঘ্রই কৈশোরে আমার উত্তরণ ঘটবে। থাকি কলকাতার এক পুরোনো পাড়ায়। ভাড়াবাড়িতে। খেলবার সাথি বিশেষ কেউ নেই। কাছেই গঙ্গা। সুযোগ পেলেই ছুটে যাই তার কাছে। পাড়ে বসি। কোনো বাধানিষেধ নাই। কারও কোনো কৌতূহল অনুভব করিনি আমাকে নিয়ে। আমি বসে থাকি আর গঙ্গাকে দেখি। আর দেখি তাকে ঘিরে মানুষের চলতি জীবনের ছোট বড়ো ঘটনা। 

বিকেলে গঙ্গার ঘাটে চান করতে আসেন কিছু মানুষ। তারা বেশি সংখ্যায় দিনমজুর। কুলি কামিনের কাজ করা মানুষ। সকালের স্নানার্থীদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম। স্নানের উপকরণ বলতে পরে থাকা কাপড় আর এক খানা গামছা সম্বল। অতিরিক্ত, কাগজ কি শালপাতায় মোড়া এক খানা সাবান কারো হাতে। পরে থাকা কাপড়খানা খুলে রেখে গামছা পরে স্নান। সারা হলে আবার কাপড়খানা পরে ফিরে যাওয়া। তারা কোথায় যান জানি না। অনেকে আবার কাচা কাপড়খানার দুই খুট ধরে মাথার উপরে তুলে হাওয়ায় শুকিয়ে নেন। ততক্ষণ গামছা পরেই হাঁটতে থাকেন। এছাড়া দু’একজন মহিলাকে দেখতাম। প্রবীণা। স্বামীহারা। আর দেখেছি, কিছু মানুষ, সন্ধ্যা আহ্নিক সেরে এক ঘটি গঙ্গার জল নিয়ে ফিরে যান। 

এরই মাঝে একজনকে দেখতাম, মাঝে মাঝে। যাকে আমি দূর থেকে চিনতাম। সাধারণ ভদ্র বাঙালি বললে যেমন ছবি ভেসে ওঠে ইনিও সেই রকমের ছিলেন। তাকেও দেখেছি স্নান করতে বিকেলের গঙ্গায়। আমার জানা তিনি সমাজে ভালো মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন না। কেমন করে জানি না। তার সম্পর্কে শুনেছি, জীবীকা তার ট্রামে যাত্রীদের পকেট কাটা। প্রমাণের জন্য যেমন আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না তেমন পাইওনি। বিশ্বাস করে গেছি শোনাকথায়। সামাজিক মানুষের স্বাভাবিক অভ্যাসে। মানুষটি থাকতেন আমাদের পাড়ায়। আমাদের বাসার কাছাকাছি বাড়িতে।  

ছোট থেকে বড় হয়েছি। বুড়োও হয়েছি, গঙ্গার অনেক মাহাত্ম্য শুনে শুনে। কিন্তু এই যে স্নানের কথা বললাম, সে তো মানুষগুলোর বহিরঙ্গটাই পরিচ্ছন্ন করে দিল। যেখানে ভেতরের মানুষটার স্বভাব আর সংস্কৃতি সেখান অবধি পৌছবার  সাধ্য কি গঙ্গার । গঙ্গার জল যারাই ব্যবহার করছেন ফল একই পাচ্ছেন। বহিরঙ্গের পরিচ্ছন্নতা।  

হঠাৎ এ প্রসঙ্গের তাৎপর্য কী। গঙ্গা নিয়ে পড়লাম কেন এই সময়কালে। গঙ্গার কথা মনে এল, কারণ পড়া লেখা জানা মধ্যবিত্ত বাঙালি ছাত্র শিক্ষক কবি লেখকদের বড় উৎসব  বৈশাখ মাসে। পচিশে বৈশাখ তারিখে রবিঠাকুরের জন্মদিন। উৎসব চলবে পক্ষকাল ধরে। যত্ন করে তুলে রাখা কাসুন্দি আর আচারের বোয়ামের মতো রবিঠাকুরের রচনা নামানো হবে শেলফ থেকে। ঝাড়পোঁছ চলবে। পৃষ্ঠা খুঁজে খুঁজে পছন্দের পাতায় চিহ্ন গুঁজে রাখা হবে। 

বক্তাদের নিয়ে টানাটানি চলবে, কোজাগরি লক্ষ্মীপুজোর পুরুতঠাকুরকে নিয়ে যেমন চলে। গায়ক বাদকেরা ব্যস্ত, কে কত বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। এর পরেই আবৃত্তিকার, নতুন নামে বাচিক শিল্পীদের ব্যস্ততা কবিতা চয়নে। নাচের শিল্পীদের চাহিদা তুলনায় কম। সংখ্যায় ছোটরা সেখানে বেশি। তাদের জন্য আছে নিজের নিজের নাচের স্কুল। আর পাড়ার অনুষ্ঠান। বাংলামাধ্যম স্কুলগুলো বন্ধ, করোনা আর গরমে। না হলে কিছু অনুষ্ঠান অবশ্যই হোত। অন্যভাষার স্কুলে রবীন্দ্র জয়ন্তীর রেওয়াজ আছে বলে শুনিনি। যাই ঘটুক রবীন্দ্রজয়ন্তী শুরু হচ্ছে বৈশাখের পঁচিশ তারিখ। স্থায়ী হবে পক্ষকাল। আরেক কবি কাজি নজরুলের জন্মদিনের উৎসবের সাঙ্গ করে এক বছরের জন্য বাৎসরিক এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে। 

রবীন্দ্রনাথ আদি অন্ত একজন নিপাট বাঙালি। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির ধারায় এক নবতম প্রবাহ রচনা করেছেন।  যে ধারায় স্নাতক হয়ে বাঙালি নিজেকে বিশ্বের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করে এক নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্র সাহিত্য বাঙালির পারিবারিক জীবন তার গ্রামীন জীবন তার সামাজিক জীবন মায় তার রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় জীবনকে প্রভাবিত করেছে। 

পরাধীন দেশকে স্বাধীন করবার বিবিধ আঙ্গিকের যে প্রচেষ্টা সে সশস্ত্র যুদ্ধ বা রাজার সঙ্গে আপস রফা অথবা শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহী সংগ্রাম কিংবা বয়কট আন্দোলন যে রূপেরই হোক প্রেরণা পেয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে। সাধারণ ভাবে ধর্মীয় সংস্কারের বিপক্ষে যুদ্ধ করবার শক্তি এবং রসদের ভাণ্ডার রবীন্দ্র সাহিত্য আর সংস্কৃতি।  তাঁর জীবনের শেষ অঙ্কে বিশ্ব এক ধ্বংসের মুখোমুখি। রক্তের বিশুদ্ধতার আদর্শে গড়ে ওঠা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ বিশ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। যা কি না মানবতাবাদী সাম্যবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা। 

মানব ইতিহাসে এই প্রথম পুঁজিবাদ আর সাম্যবাদ মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। যার পরিণতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সমাজতন্ত্রকে বিনাশ করবার জন্য পুঁজিবাদ তার ঘৃণ্যতম কুৎসিত চেহারা ফ্যাসিবাদের আকারে বিকশিত করেছে। কিন্তু সাম্যবাদী ভাবনা তাকে পরাস্ত করেছে তখনকার মতো। যদিও ভাবনার মরণ হয় না। 

আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। সে-ও সত্তর বছর হয়ে গেল। দেশ গঠনে আমাদের নেতারা না পুঁজিবাদ না সাম্যবাদ নীতি নিয়ে দুই বিশ্বশক্তির মাঝখান দিয়ে দেশ গড়ার চতুর নীতি গ্রহণ করলেন। বাংলায় একেই বলে গাছেরও খাই তলারও কুড়াই। সত্তর বছরে ফল ফলেছে। দেশ আজ আমাদের পুঁজিবাদের খপ্পরে মাকড়সার জালে মাছির মতো দশায় অবস্থান করছে। অপর দিকে সমাজতন্ত্রের প্রথম সন্তানকে হত্যা করে এবার দ্বিতীয়টির দিকে হাত বাড়িয়েছে বিশ্বপুজিবাদ। পরিণতি ভবিষ্যৎ বলবে। 

আসি এবার নিজেদের কথায়। মার্ক্সবাদী তত্বে সাম্যবাদে বিশ্বাসী যে সকল দল ভারতে আছে বা ছিল তাদের নিকেশ করবার কর্মসূচির বাস্তবায়ন ঘটছে আমার দেশে একুশ শতকে। ধর্মের জিগির তুলে বিধর্মীদের যে কোন উপায়ে বশ করে দেশে হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়েছে বর্তমান ভারতের একক সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি। তাদেরই মদত নিয়ে বাংলা থেকে কমিউনিস্ট খতম করবার ঘোষিত নীতি বাংলার তৃণমূল কংগ্রেস পার্টির। কংগ্রেসের উগ্র স্বৈরাচারি ইন্দিরা কংগ্রেসের উত্তরসূরি তৃণমূল কংগ্রেস। আজ বাংলায় শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত।  অপেক্ষায় থাকতে হবে কবে বাঙালি দিল্লিতে প্রধান মন্ত্রীর মসনদে বসবে। যখন বাংলার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। শরৎ পণ্ডিত দাদাঠাকুরের কথায়, গাই বিয়োলে দুধ দেবো মাছ কাটলে মুড়ো দেবো, এমনি আর কি। 

যে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে গেছেন আজীবন, মৃত্যুশয্যা থেকেও যিনি উগ্রজাতীয়তাবাদী জার্মানদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত বলশেভিকদের বিজয় কামনা করছেন,  তাঁরই রচনা করা গান শুনিয়ে বর্তমানে কমিউনিস্টনিধন যজ্ঞের বিজয় উৎসব চলছে বাংলায়। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতির ব্যবহার চলছে। বাংলায় তৃণমূল প্রতিষ্ঠিত সরকার ট্র্যাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসংগীত বাজাবার ব্যবস্থা করেছে। থমকে যাওয়া চালক আর যাত্রীদের বিরক্তি দূর করবার তাৎক্ষণিক আয়োজন। কোনো মনোবিদের পরামর্শ নিশ্চয় আছে এর পেছনে। 

একদা মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথকে জনতার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল মার্কসবাদীরা। তাঁর বিভিন্ন উদ্ধৃতির ব্যাপক আকারে প্রচার করে। সে ছিল নিজেদের দার্শনিক মতবাদ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষজনের কাছে পৌছে দেবার তাগিদে। আজ সেটা অতীতের কথা। 

তাই বলছিলাম গঙ্গার জল দেহের বাইরেটাকেই পরিচ্ছন্ন করতে পারে। করেও। কিন্তু দেহের অভ্যন্তর সংস্কারের ক্ষ্মতা সে ধারণ করে না। রবীন্দ্রসংস্কৃতিরও সেই একই দশা। গান কবিতা আর পোশাকে তাকে সুস্থ রুচিসম্পন্ন দেখালেও ভিতরের বাঙালি ধর্মীয় বিদ্বেষ জাতপাতের বিভাজন পড়ালেখা জানা আর না জানার পার্থক্য ভদ্রলোক আর ছোটলোকের বিভাজন যথেষ্ট মান্যতা দিয়েই রক্ষা করে। আবার নিয়ম করে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে। রবীন্দ্রসংস্কৃতি বাঙালির বহিরঙ্গের আবরণ। এমন দ্বিচারিতা ভারতে আর কোনো জাতের মধ্যে আছে কি।

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views