প্রকৃতি পরিবেশ প্রেম ঘৃণা

বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত 


৫জুন দুনিয়া জুড়ে পালিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আলাদা করে বছরের একদিন এই অনুষ্ঠানের অর্থ কী। প্রকৃতি আর তার পরিবেশ তো সৌরমণ্ডলের স্বাভাবিক বিষয়। কোনো নির্দিষ্ট দিন ক্ষণের সীমানা দিয়ে ঘেরা নয়। 

প্রকৃতি বলতে বুঝি জীব আর জড় বস্তুর একত্র সমাবেশ। আর পরিবেশ তো একের প্রতি অপরের স্বাভাবিক নির্ভরতা নিয়ে গড়ে ওঠা অবস্থা বা ব্যবস্থা অথবা সম্পর্ক। 

প্রেম হল মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে সম্পর্ক সেই ভাব বা আবেগ। জীবের সঙ্গে প্রকৃতির এই সম্পর্ক সহজাত। জড়ের আবেগ মানুষের আবেগের মতো পাঠযোগ্য নয় বলে মানুষ সেটা স্বাভাবিক ভাবে বুঝতে পারে না। সেই আবেগ দৃষ্টির গোচরে আসে পরিবর্তণের রূপ ধরে। এক সময়ের অরণ্য ঊষর মরুর রূপে দেখা দেয়। ক্ষুব্ধ সমুদ্রের অতল তল মাথা উঁচু করে গভীর জলরাশি ভেদ করে পর্বতের রূপ নিয়ে আকাশ স্পর্শ করে। 

এর পরে আসে ঘৃণা এ বস্তু  মানুষ ছাড়া আর কোনোও জীবের আছে বলে জানা নাই। ঘৃণার উৎপত্তি অন্যের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবার আবেগ। যা থেকে সৃষ্টি হয় লোভ। একা থাকা একা পাওয়া। একা ভোগ করবার আকাঙ্ক্ষা।অন্যের উপর প্রভুত্ত্ব করবার তীব্র বাসনা। যার পরিণতি অবশ্যম্ভাবি ধ্বংস। নিজের। নিজের পরিবেশ । নিজের প্রতিবেশ। সকল কিছুকে নিয়ে সার্বিক ধ্বংস। পুরাণের গল্পে কথিত আছে ভষ্মলোচন দৈত্যের মরণকথা। যার মাথা স্পর্শ করবেন সে-ই পুড়ে মরবে। এমন ক্ষমতার অধিকারির মৃত্যু ঘটল শেষমেশ নিজেরই মাথায় হাত দিয়ে। বিশ্বে মানব্জাতির আজ সেই দশা।

ছোটবড় শ্রেণিতে ভাগ করা সমাজে এই ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে সভ্য নামের মানুষের আচরণের মধ্য দিয়ে। শিশুদের হাত ধরে। জল মাটি গাছ আর পশু-পাখির প্রতি মানব শিশুর স্বাভাবিক প্রেম  নিবৃত্ত হয় বরিষ্ঠ জনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। 

শ্রেণিবিভক্ত মানুষের সমাজে এক শ্রেণি অপর শ্রেণির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলবার অভ্যাস রপ্ত করে শৈশব কাল থেকে। শহুরে মানুষ প্রকৃতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজের প্রজাতির দুর্বল অংশের ছোঁয়া বাঁচিয়ে থাকাকে মনে করে সভ্য থাকা। মানুষের এই স্পর্শকাতরতা প্রতিবেশী মানুষকে প্রকৃতিকে প্রাণীকে সহ্য করতে না পারার অবস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সভ্যতার সমাজ নামে। মানুষের সভ্যতার আবিষ্কারগুলির উপর আধিপত্য কায়েম করে এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মানুষ লোভ  আর লালসায় মজে গিয়ে প্রকৃতি আর পরিবেশকে দুষিত করে চলেছে প্রতিটি মুহূর্তে। যার পরিণতিতে আজ তাগিদ জেগেছে পরিবেশের ভার সাম্য রক্ষার। 

প্রতিকার একটাই। সমাজের শ্রেণি বৈষম্য  দূর কর প্রথমে। লোভীর লোভ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করেই করতে হবে। এবং এর দায় নিতে হবে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে সমান ভাবে। কিন্তু দুঃখের হলেও বাস্তবে সে বড় কঠিন কাজ। কারণ আমাদের রাস্ট্র ব্যবস্থাটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে পুঁজিবাদের ভ্রান্ত তত্ত্বের ভিতের উপর। আর এ বিষয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেকটা তাদের মতো বাংলা প্রবাদে যাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে “ চোরকে বলে চুরি কর। আবার গৃহস্থকে বলে সজাগ থাক।“ এখানে সরকারি সহযোগিতায় দূষণ উৎপাদন করা হয় একদিকে। অপর দিকে জনগণকে উপদেশ দিয়ে চলেছে দূষণ না ছড়ানোর জন্য। অবাধ্য হলে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা আছে জনতার জন্য। আর এই ব্যবস্থায় পাহারা অপরাধী আর বিচারের নামে আরও এক সামাজিক দূষণ উৎপাদনের সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে, অনেক যত্ন আর অর্থের বিনিয়োগে।

প্রয়োজন প্রতিরোধ আর চরম ব্যবস্থার প্রস্তুতি। এ শুধু ধোঁয়া বন্ধ করবার আবেদন নয়। গাছ কাটা প্রতিরোধের আর্জি নয়। জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া বা মাটি খুঁড়ে সম্পদ আহরণের প্রতিবাদ নয়। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের আবেদন নয়। এর জন্য চাই সার্বিক বদল। প্রকৃতির সম্পদের উপর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মালিকানার বদল। চাই সেই ব্যবস্থার বদল যেখানে যেকানে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিমানুষ বা সম্প্রদায়ের লোভ প্রভুত্ব করবে না সমগ্র মানব সমাজের উপর। 

Comments

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?