ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

শংকর

ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং কমিউনিষ্ট বিপ্লবী শিবিরে সুবিধাবাদের বাড়বাড়ন্তের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কি? দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। এমন নয় যে, অতীতে কমিউনিষ্ট বিপ্লবী শিবিরে সুবিধাবাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু বর্তমানে দেশে ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমতাদখল এবং রাষ্ট্রের ক্রমশ ফ্যাসিকরণের আবহাওয়ায় এই সুবিধাবাদ যেন ফুলে ফলে ভরে উঠছে। 

সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মামে তিনটি কমিউনিষ্ট বিপ্লবী দলের একীকরণ হল বলে প্রভূত ঢাক বাজানো হল। মনে হতে পারে দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের এই সময়ে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের মধ্যে এক পার্টিতে বিলীন হওয়ার এক মহা তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে। যেন-বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীরা এতটাই সচেতন হয়ে উঠেছেন যে, তাঁদের দীর্ঘদিনের নিজস্ব খুপরি দোকানঘর চালানোর অভ্যাস ত্যাগ করে, গ্রুপ মানসিকতা ত্যাগ করে তাঁরা মহান ঐক্যের জন্যে নিবেদিত প্রাণ হয়ে উঠেছেন।

যদি সত্যিই এমন হত তবে তা হত অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। কিন্তু এটা সত্যিকারের দুঃখের বিষয় যে, বিষয়টি এমন মোটেও নয়। কেন? কেন এমন কথা বলছি? এটি কি কোনো গোষ্ঠীগত দলাদলি? গোষ্ঠীগত ঈর্ষা? না, তা নয়। আসল ঘটনা হল এটি কমিউনিষ্ট বিপ্লবী শিবিরে আরও বড় এক অধঃপতনকে চিহ্নিত করে। বিষয়টিকে একটু খোলাখুলি বোঝা দরকার।

খাম্মামে তিনটি দলের ঐক্য হল বলে প্রচার করা হলেও প্রকৃত সত্য হল, যে তিনটি দল সেখানে ঐক্যবদ্ধ হল সেগুলি তিনটি কমিউনিষ্ট বিপ্লবী দল থেকে সাম্প্রতিক অতীতে ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া তিনটি ছোট ছোট গোষ্ঠী। যদিও এত প্রচারের মাঝে এই কথাটি কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। ঐক্যের ঢক্কানিনাদে ভাঙ্গনের সাম্প্রতিক দগদগে ইতিহাসকে মরীয়া হয়ে ঢাকা দেওয়া হয়েছে। এটা তাই প্রথমেই বুঝে নেওয়ার আছে যে, খাম্মামের সম্মেলন আসলে দলত্যাগীদের সম্মেলন ‘যারা নিজ নিজ পার্টিতে থেকে কাজ করতে পারছিলেন না’। তাতে কতই না প্রচার! কতই না দেখনদারি! কথায় বলে শূণ্য কলসী বাজে বেশি। যেহেতু কলসীটি শূণ্য, হাজার ছিদ্রের বাসরঘর, তাই তাকে বাজাতে হল তারস্বরে। এখন কেউ বলতে পারেন, ভাঙ্গন তো সব সময়ে খারাপ নয়। বরং অনেক সময়েই ভাঙ্গনের প্রয়োজন আছে। বৃহত্তর মিলনের জন্যে, সেই মিলনের পথে যারা বাধা তাদের থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা তো একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। সুতরাং, এই ভাঙ্গন তো একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতেই পারে। অন্তত বিষয়টাকে সেভাবে তো দেখা যেতেই পারে। ঠিকই, ভাঙ্গন দুই ধরণেরই হতে পারে। তা যেমন দলত্যাগীদের কাজ হতে পারে, তেমনই তা রাজনৈতিকভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রপদক্ষেপও হতে পারে। আসুন, আমরা বিচার করে দেখি যে ধরণের ভাঙ্গন এবং তৎপরবর্তী মিলন এরা ঘটালেন তার প্রকৃত চরিত্র ঠিক কী? তা কি সুবিধাবাদী দলত্যাগীর চরিত্রসম্পন্ন নাকি কোনো মহান অগ্রপদক্ষেপ।

কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের ঐক্য প্রচেষ্টা

নতুন দলের হোতারা এমন একটা হাবভাব করছেন যাতে করে মনে হতে পারে যে, যে দলগুলি ছেড়ে তারা বেরিয়ে এসেছেন সেগুলি সব কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের ঐক্যের বিরোধী ছিল। তাই ঐক্যের জন্যে মরীয়া হয়ে তারা উপায় না দেখে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আসল ঘটনা কি সত্যিই তাই?

সিপিআইএমএল রেড স্টার বিগত এক দশক ধরে বিভিন্ন কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে ঐক্যের প্রচেষ্টা নিয়ে চলেছে। পাশাপাশি তারা খুব পরিষ্কার করে এটা বারেবারেই বলে এসেছেন যে যদি বর্তমান কর্মপদ্ধতির বিষয়ে মতৈক্য থাকে তাহলে বিভিন্ন মতপার্থক্যসহ কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের একটি ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় দল গঠন করা উচিত। এই লক্ষ্য গত পঞ্চাশ বছর ধরে অধরা রয়েছে এবং ভারতীয় বিপ্লবের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে চলেছে। দীর্ঘদিনের গোষ্ঠী মানসিকতা, ক্ষুদ্রস্বার্থ প্রভৃতির কারণে চলা এই অনৈক্যের অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। রেড স্টার এই কথা যেমন বলেছে তেমনই তা হাতেকলমে করার চেষ্টাও করেছে। তার ফলশ্রুতিতেই গত এক দশকে রেড স্টারে বিভিন্ন ধারার কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমাগম হয়েছিল। তাহলে ‘ঐক্যপ্রয়াসী’ দলত্যাগীদের দলত্যাগ করার কারণ কী? কারণ হিসাবে তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতপার্থক্যকে তুলে ধরেছেন। অথচ তারাই আবার বলছেন যে, মতপার্থক্য নিয়েই দল গঠন করতে হবে। নতুন যে পার্টি তারা গঠন করলেন সেখানে কি মতপার্থক্য নেই? অবশ্যই আছে। শুধু তাই নয়। রেড স্টারে যে ধরণের মতপার্থক্য ছিল তার থেকে বেশি মতপার্থক্য সেখানে আছে। তাহলে ফারাকটা কোথায়? কোথাও কি ফারাক ঘটল? নিশ্চয়ই ঘটল। নইলে তারা পুরনো দল ভেঙ্গে নতুন দল করলেন কেন? কিন্তু যা ঘটল তা কোনো ধরণের রাজনৈতিক উল্লম্ফন নয়। পরিষ্কার যা ঘটল তা হল ব্যক্তির পদমর্যাদা বাড়ল। এই হল সুবিধাবাদের, নির্লজ্জ ক্যারিয়ারিজম আর উচ্চাকাঙখার এক বিশুদ্ধ প্রতিফলন। 

কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের ঐক্যের প্রচেষ্টা শুধু যে রেড স্টার চালাচ্ছিল তা নয়। অন্য যে দুটি দল থেকে দলছুটরা বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গঠন করেছেন সেই দুটি দলও চালাচ্ছিল। পিসিসি সিপিআইএমএল-এর কমরেডরা বিভিন্ন কমিউনিষ্ট বিপ্লবী পার্টির সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছিলেন। সেই আলোচনা যেমন সিপিআইএমএল রেড স্টারের সঙ্গে তাদের চলছিল তেমনই অন্য দলগুলির সঙ্গেও চলছিল। এই আলোচনার ফলশ্রুতিতেই পিসিসি সিপিআইএমএল এবং সিপিআইএমএল এনডি অনেক কাছাকাছি চলে আসে এবং তাদের মধ্যে ঐক্যের সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত একসময়ে উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে যখন কলকাতায় উভয় দলের ফাইনাল যৌথ মিটিং ডাকা হয় তখন পিসিসির একটি অংশ বেঁকে বসেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, যেদিন মিটিং হবার কথা তার আগের দিন সন্ধ্যেতে দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কলকাতায় পৌঁছে গেছেন, সেই রাতে পিসিসির উক্ত অংশ ঐক্য আলোচনায় অংশ নিতে রাজি হন না। ফলে আলোচনা ভেস্তে যায়। দলদুটির মধ্যে ঐক্য হতে পারে না। মজার ব্যাপার হল, পিসিসির উক্ত অংশটিই পরবর্তীকালে রেড স্টার এবং এনডির দলছুট অংশগুলির সঙ্গে নতুন দল গঠন করে নিজের দলের বাকিদের মতামতকে তোয়াক্কা না করেই। ফলে পিসিসি ভেঙ্গে যায়। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন। এনডি-র সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া গেল না। কিন্তু এনডি-র দলছুটদের সঙ্গে ঐক্য করা গেল। আমরা ধরে নিতে পারি উভয় ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। এখন, তারাই তো বলছেন, মতপার্থক্য নিয়েই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলে ফারাকটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে? রাজনীতির থেকেও কোথাও কি অরাজনৈতিক কারণগুলি বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

সিপিআইএমএল এনডি-র দলছুটদের অবস্থাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। তারা নাকি বেশ কিছুদিন ধরে দলের মধ্যে কিছু বিতর্ক চালাচ্ছিলেন। তার মধ্যে একটি বিতর্ক হল যে, তারা মনে করছেন ভারতবর্ষ একটি পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী দেশ। এনডি-র সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই মতকে সঠিক বলে মনে করেননি। ফলে বিতর্ক চলেছে। এখন মজার ব্যাপার হল, এইসব বিতর্কের কারণে তারা দল ভাঙ্গলেন। কিন্তু যে নতুন দল তারা গঠন করলেন সেখানেও তো এই প্রশ্নে বিতর্ক রয়েছে। নতুন দলের যিনি সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সেই প্রদীপ সিংহ ঠাকুর নিজেই তো মনে করেন যে, ভারতে ব্যাপক জনগণ বনাম সামন্ততন্ত্রই হল প্রধান দ্বন্দ্ব। রেড স্টারের মধ্যেও তিনি এই বিতর্ক বিভিন্ন সময়ে উত্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এখন কথা হল, দলের মধ্যে এই ধরণের বিভিন্ন বিতর্ক থাকা খুবই স্বাভাবিক। নতুন দলের হোতারাও তো বলছেন যে, বিতর্ক নিয়েই দল গঠন করতে হবে। তাহলে তারা এনডি ভাঙ্গলেন কেন? কী ফারাক হল এনডি আর নতুন দলের মধ্যে? ফারাক তো নিশ্চয়ই কিছু হল। না হলে তারা নিজেদের দল ভেঙ্গে নতুন দল গড়বেন কেন? কিন্তু ফারাকটা কী? ফারাকটা যা চোখে দেখা যাচ্ছে তা হল, এনডি-তে তারা ছিলেন সংখ্যালঘু আর নতুন দলে তারা হলেন সংখ্যাগুরু। ফলে এনডি-র পার্টি লাইনে তাদের মতামত প্রতিফলিত হতে পারত না যা নতুন দলে হলো। সুতরাং, ঐক্য তারা চান, কিন্তু নিজেদের সংখ্যাগুরু হবার শর্তে, নিজেদের মতামত পার্টি লাইনে প্রতিফলিত হবার শর্তে। সংখ্যালঘু হয়ে তারা দল করতে রাজি নন। এই হল তাদের অবস্থা।

নতুন পার্টির হোতারা যদি সত্যিই কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের ঐক্য চাইতেন, যদি সত্যিই যা তারা মুখে বলছেন তা তাদের মনের কথা হত, অর্থাৎ, মতপার্থক্যসহ ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তোলা, তাহলে তারা তাদের নিজ নিজ পার্টিগুলিকে ভাঙতেন না। আজ তারা একটা মোটের ওপর বড় একটা মিছিল করেই খুশিতে এতই ডগমগ হয়েছেন যে হাজারবার করে একই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে বেরাচ্ছেন। এদিকে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেছে, স্বাধীন ভারতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সামনে। ফ্যাসিবাদী শক্তি বনাম জনতার সংগ্রামে কীভাবে ভূমিকা পালন করা যাবে এসব নিয়ে কোনো চিন্তাই তাদের নেই। তারা আপনরসে এমনই জারিত যে একটা মিছিল করেই সেই ঘোরে দিন কাটিয়ে যাচ্ছেন। অথচ, যদি তারা নিজ নিজ পার্টিগুলিকে না ভাঙতেন, এবং গোটাগুটিভাবে পার্টিগুলির ঐক্য যদি হতে পারত (সেই প্রক্রিয়া চলছিল যা তারা নিজেরাই ভেস্তে দিয়েছিলেন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ আর ক্যারিয়ারিসমের কারণে), তাহলে এর চারগুন বড় মিছিল হতে পারত। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে কমিউনিষ্ট বিপ্লবী হস্তক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত।

সুবিধাবাদীদের ঐক্য

ঘটনা এদিকে গড়াল না। খারাপ দিকে এগোল। পার্টিগুলো ভাঙ্গল। এবং তিনটে টুকরো জোড়া লাগল। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হল? কেন অন্যথা হল না? এ কি আকস্মিক ঘটনা? পার্টিগুলির মধ্যে গণতন্ত্রের অভাব? কী এর ব্যাখ্যা? কী এর তাৎপর্য? শুধুমাত্র উচ্চাকাঙ্খা ও ক্যারিয়ারিজম দিয়েই কি এই ঘটনার ব্যাখা করা যায়? নাকি এসবের পাশাপাশি এর পেছনে গভীরতর কোনো রাজনৈতিক পটপরিবর্তন রয়েছে?

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, তিনটি পার্টিই, অর্থাৎ, সিপিআইএমএল এনডি, পিসিসি সিপিআইএমএল এবং সিপিআইএমএল রেড স্টার বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্নভাবে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের ঐক্যের জন্যে সচেষ্ট ছিল। তা সত্ত্বেও তিনটি পার্টি থেকে তিনটি টুকরো পৃথক হয়ে গিয়ে নিজেরা আলাদা করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নতুন পার্টি গঠন করল। এর অর্থ হল, কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের ঐক্য এদের লক্ষ্য ছিল না। এদের লক্ষ্য ছিল একটি বিশেষ ঐক্য। সেটি কী?

খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, যাদের মিলনে এই নতুন দলটি তৈরি হল তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ গত বেশ কয়েক বছর ধরে সোশ্যাল ডেমোক্রাট এবং বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রতি নরম নীতি নিয়ে চলেছে। ফ্যাসিবাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এদের এই বুর্জোয়াদের প্রতি নরম মনোভাবের রাজনীতি ক্রমশ উগ্র এবং অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। এমন নয় যে এরা সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের কথা এই প্রথম বলছে, বা কংগ্রেসের মত অ-ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের প্রকাশ্য সমালোচনা না করা বা অন্তত সমালোচনার ধার কমানোর কথা ইদানীং প্রথম বলতে শুরু করেছে। এসব কথা তারা অনেক আগে থেকেই বলছিল। কিন্তু ইদানীং তা উগ্র ও অসহিষ্ণু চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছে এবং পার্টি লাইনে এদের এই মতামতের প্রতিফলন না ঘটলে এদের পক্ষে সেই পার্টিতে টিঁকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রজাপন্থার নেতারা যেভাবে তাদের পার্টি অফিসে কংগ্রেসের বিধায়ক ও নেতাদের সম্বর্ধনা দিয়েছেন তা তারা যদি তারা এনডি-তে থেকে যেতেন তবে কিছুতেই সম্ভব হত না। অথবা, রেড স্টারের ভেতরে ভিন্নমতের নেতারা কোনোদিনই ঐ ধরণের একটি হাস্যকর ও সুবিধাবাদী কর্মসূচি তৈরি করতে সমর্থ হতেন না যা তারা নতুন পার্টিতে করেছেন। একই কথা পিসিসি সিপিআইএমএল সম্পর্কেও প্রযোজ্য।

সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে যা হল তা হচ্ছে কমিউনিষ্ট বিপ্লবী শিবিরে একটি নয়া মেরুকরণ ঘটছে। কমিউনিষ্ট বিপ্লবী পার্টিগুলির সুবিধাবাদী অংশগুলি ফ্যাসিবাদের উত্থানের এই সময়ে আর বিপ্লবী পার্টিতে থাকতে পারছে না। শ্রমিকশ্রেণি তথা কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আত্মঘোষণার রাজনীতি তাদের কাছে আতঙ্কের হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাঁচার জন্যে তারা অফ্যাসিবাদী বৃহৎ বুর্জোয়াদের পেছনে লুকোবার সোশ্যাল ডেমোক্র‍্যাটিক রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। ফলে, একে একে তারা নিজ নিজ পার্টি থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে একটি সুবিধাবাদী পার্টি গঠন করছে। এটাই হল বর্তমান ভাঙন ও ঐক্যের আসল মর্মবস্তু।

নতুন সুযোগ নতুন চ্যালেঞ্জ

এই পরিস্থিতি কমিউনিষ্ট বিপ্লবী আন্দোলনের সামনে যেমন নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে তেমনই তা নতুন চ্যালেঞ্জও উপহার দিয়েছে। সুবিধাবাদ কমিউনিষ্ট বিপ্লবী রাজনীতির পায়ে যে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল, যে শৃংখল লাগিয়ে রেখেছিল তা সহসা অপসারিত হয়েছে। ফলে বিপ্লবী আন্দোলনের নতুন গতিতে সামনে এগোনোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জ হল, কমিউনিষ্ট বিপ্লবী কর্মীদের একটি অংশ এইসব ভাঙনের ঘটনায় কিছুটা বিমর্ষ হয়েছেন। পরিস্থিতি যে নয়া সম্ভাবনা তৈরি করেছে তাকে করায়াত্ত করার জন্যে যে উৎসাহ প্রয়োজন, জায়গায় জায়গায় তার অভাব দেখা যাচ্ছে। এই ধরণের পরিস্থিতিতে সব সময়েই এটা ঘটে থাকে। গত শতকের প্রথম দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে অনেক বড় পরিসরে এবং বড় আকারে এমন ঘটনা আমরা ইউরোপে ঘটতে দেখেছি। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিগুলি ভেঙ্গে পড়ছিল, ইউরোপের কমিউনিষ্ট শিবিরে নয়া মেরুকরণ ঘটছিল। প্রতিষ্ঠিত নেতারা সুবিধাবাদ ও আত্মসমর্পনবাদের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছিল। তা যেমন একদিকে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সামনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছিল, যার ফলশ্রুতিতে এসেছিল রুশ বিপ্লব এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা, তেমনই তা বহু কর্মীদের প্রাথমিকভাবে হতোদ্যমও করেছিল, হতাশাগ্রস্থও করেছিল। অনেক ছোট আকারে হলেও মর্মবস্তুর দিক থেকে অনেকটা একই রকম ঘটনা আমাদের দেশে বর্তমানে ঘটছে। বিপ্লবী কর্মীদের তাই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হবে এবং পরিস্থিতি যে সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে তাকে ইস্পাতকঠিন মুঠিতে করায়াত্ত করতে হবে।

[লেখকের মতামত একান্ত নিজস্ব। রাজনৈতিক কর্ষণের জন্য প্রকাশিত। ডিলিজেন্ট পত্রিকা কোনো উল্লিখিত মতামত সম্পর্কে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত।]  

Picture Courtesy: Freepik

Comments

Popular posts from this blog

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার