কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!

রুমেলা দেব 

ভারতের নব্য কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল লাদাখের পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র সরকারের থেকে চার দফা ন্যায্য দাবি আদায় করতে লাদাখবাসীর গণঅনশনের বিষয়ে দেশের মানুষ পরিচিত রয়েছেন। প্রতিবাদের প্রধান মুখ সোনাম ওয়াংচুক-কে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষ একত্রিত হয়েছেন। তিনি লাদাখের একজন বিখ্যাত পরিবেশবিদ, শিক্ষা সংস্কারক এবং সমাজকর্মী। বলিউডের রূপোলী পর্দাতেও তাঁকে অনুকরণ করে "3 Idiots"-এর ফুংসুক ওয়াংড়ু (র‍্যাঞ্চো)-র চরিত্রে আমির খানকে দেখা গেছে। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি বলেন "আমি সিনেমায় নই বাস্তবে বাঁচি। আমাদের দেশের অধিকতর লোক সিনেমা এবং ক্রিকেট নিয়ে এত বিভোর যে তারা সেখানেই আবিষ্কার করতে চান ও জিততে চান"। তিনি ফ্রান্স থেকে "Earthen Architecture"-এর প্রশিক্ষণ গ্ৰহণ করেন। তাঁর "Ice Stupa" খ্যাতি অর্জন করেছে। বড় বড় বরফের খন্ডকে একত্রিত করে কৃত্রিম তুষারস্রোত সংরক্ষিত করে রাখা হয় যাতে গ্রীষ্মের মরশুমে জলের অভাব চলাকালীন বরফ গলে সেচের কাজে লাগতে পারে। এছাড়াও বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'SECMOL'-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর নেতৃত্বে 'সাস্টেনেবেল' পরিবেশ, শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদির সামাজিক প্রচার ও কর্মসূচী লাদাখে নেওয়া শুরু হয়। UNESCO-র পক্ষ থেকে তিনি Chair Earthen Architecture পুরস্কার ছাড়াও দেশ, রাজ্য ও আন্তর্জাতিক ভাবে বহু অ্যাওয়ার্ড তিনি অর্জন করেছেন। 

আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি বিগত কয়েক বছর ধরে পরিবেশের উপর ব্যাপক আক্রমণ এবং বনভূমির বিনাশ। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশ, সর্বত্র চলছে মাফিয়াদের বন সাফ করা, জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলা, পাহাড় খনন, নদীর তলা থেকে বালি চুরি, চাষের জমিকে যান্ত্রিক উপায়ে নষ্ট করা, অপরিকল্পিত নগরোন্নয়ন ইত্যাদি। এর ফলে সামগ্রিক ইকোলজিক্যাল ভারসাম্যহীনতার অঙ্গ হিসেবে ভবিষ্যতে তীব্র প্রাকৃতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে পৃথিবী। 

কেন্দ্র সরকারের অধীন ভারতের সর্বোচ্চ শীতল, দূষণহীন, আদিবাসী কেন্দ্রিক লাদাখেও অশনি সংকেত ঘনিয়ে এসেছে। গত ৬-২৬ই মার্চ সোনামের নেতৃত্বে 6th Schedule সহ পূর্ণ রাজ্যের দাবিতে লাদাখে জলবায়ু অনশন পালিত হয়। সোনামের সমর্থনে -১০° তাপমাত্রায় রাস্তায় সবার আগে এগিয়ে ধর্ণায় বসেন মহিলারা। এরপর যুব সম্প্রদায়, সাধু-সন্ন্যাসী সহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অধিকাংশ লাদাখবাসী এসে পৌঁছান। তিনি মহাত্মা গান্ধীর ঐতিহাসিক ২১ দিনের আমরণ অনশনকে অনুসরণ করে অহিংস পথে সরকারের কাছে তাঁর দাবি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময়ে বিজেপির ইস্তাহারে লাদাখের statehood এবং 6th Schedule-এর অন্তর্ভুক্তির উল্লেখ থাকলেও ভোট পরবর্তী পর্যায়ে বিন্দুমাত্র পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্র সরকার। লাদাখের সাংসদের সাথে গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের এই বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা হলেও কোনও লাভ হয়নি। ১৯৪৭ সালে জন্মু-কাশ্মীরের রাজা হরি সিং-এর সময় জম্মু-কাশ্মীর স্বাধীন থাকবে নাকি ভারত অথবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। সহিংসতার প্রেক্ষাপটে হরি সিং-এর ইচ্ছানুসারে ভারতের সংবিধানের অধীনে ওই উপত্যকার রাজনৈতিক অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়। সে সময় Ladakh Buddhist Association (LBA) লাদাখকে স্বতন্ত্র রাজ্য করার জন্য প্রচুর লড়াই করে কারণ লাদাখের সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। ফলে লাদাখ জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অঙ্গ হিসেবেই থেকে যায়। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য সমস্যা ছিল প্রত্যাশিত বৈষম্য। জমি, বাজেট, শিক্ষা, কর্মসংস্থান সমস্ত বিষয়ে বৈষম্য থাকলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল লাদাখবাসীদের অধিকাংশ আদিবাসী হলেও তাঁরা Scheduled Tribe (ST)-এর শংসাপত্র পেতেন না। বিভিন্ন সাংবিধানিক  এবং গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত আছেন তাঁরা। লাদাখের পূর্ণ রাজ্য হওয়ার দাবীতে আন্দোলন কেবল আজকের নয়, এটা দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক দাবি। এরপর ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধী লাদাখের সমগ্র জনসংখ্যাকে ST ঘোষণা করে দেন। ফলে তাঁদের পরিচয় সমস্যা মিটে গেলেও পড়ে থাকে আরও মৌলিক দাবি। এরপর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দীর্ঘ লড়াই শুরু হয়। শেষে ১৯৯৫ সালের ৮ই মে Autonomous Hill Development Council (AHDC) প্রতিষ্ঠিত হয়। 

AHDC আইন পাশ হওয়ার পর লাদাখের বৌদ্ধ অধ্যুষিত লে এবং মুসলিম অধ্যুষিত কার্গিল-এর দুই সংগঠন LBA ও Ladakh Muslim Association (LMA) ২০০২ সালে একসাথে দাবি করে যে লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু তা ফলপ্রসু হয় না। বহু বছর পর RSS-এর তৈরি ব্লু প্রিন্ট অনুযায়ী বিজেপির ইস্তেহারে লাদাখবাসীর উদ্দেশ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় statehood সহ তাঁদের এতদিনের সমস্ত দাবি পূরণ করা হবে গেরুয়া শিবির পুনরায় ক্ষমতায় এলে। পরবর্তীতে গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে দুটি আলাদা Union Territory-তে বিভক্ত করার ঘোষণা করেন। লে-র সাধারণ মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন এই বক্তব্য শুনে কারণ বহু বছর পর তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হবে, কর্মসংস্থান ইত্যাদির সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে, এমন আশা ছিল। কেবল এক বছর যেতে না যেতেই তাঁরা বিজেপির আসল রূপ দেখতে পান। তাঁদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক দেখা দেয়। তাঁরা এতদিন যেটুকু নিজস্ব সাংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, যেমন বহিরাগত লোকের জমি ক্রয় করা কিংবা যথেচ্ছ খননকার্যের মাধ্যমে পরিবেশের উপর আঘাত হানার উপর নিষিদ্ধকরণ, সেগুলো থেকেও এবার তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে উপলব্ধি করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন যে কেন্দ্র সরকার কি উদ্দ্যেশ্যে ৩৭০ ধারা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিকভাবে বলপূর্বক বিলুপ্ত করেছে। 

পরিবেশবিদ সোনামের দাবীগুলির অন্যতম হল 6th Schedule, যে সাংবিধানিক অধিকারের ফলে ভারতের আদিবাসী  এবং বনজঙ্গলকে কেন্দ্র করে থাকা জনজাতি নিজেদের ভূমি, জল-জঙ্গল, চাষাবাদ, সম্পদ এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি-কে রক্ষা ও তা সংক্রান্ত আইন তৈরি করতে পারে; এই সাংবিধানিক অধিকার ভারতের উত্তর-পূর্বের বেশকিছু রাজ্যে রয়েছে। 

দ্বিতীয় দাবি হল লাদাখের পূর্ণ রাজ্যের স্বীকৃতি চাই, যেখানে তাদের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে। তাদের লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিধান সভা নির্বাচিত হতে দিতে হবে। দিল্লী থেকে কোনো তুঘলকি শাসন চাপানো চলবে না। 

তৃতীয় দাবি হল তাদের নিয়োগ সংরক্ষিত করার জন্য রাজ্যের স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন থাকতে হবে। 

চতুর্থ দাবি হল কমপক্ষে দুটো আসন থাকবে লোকসভায় - একটি লে ও একটি কার্গিল জেলা থেকে। 

এই দাবিগুলোর ভিত্তিতে ২০২০ সাল থেকে লাদাখবাসী এক নাগাড়ে পথে নেমেছে। এখন নিজ ভূমি রক্ষার গর্জন দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, যাদের অবশ্য কর্তব্য জনতার মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া, দেশের বিভিন্ন কোণা থেকে প্রান্তিক, বঞ্চিত মানুষের দুরাবস্থাকে সকলের সামনে নিয়ে আসা, সেই মূল স্রোতের জাতীয় "সু-পরিচিত" সংবাদমাধ্যমগুলো ন্যূনতম কর্তব্য পালন তো দূর অস্ত, যথারীতি কেন্দ্রের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। বিজেপির হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া সংবাদমাধ্যম ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে শুরু করে লাদাখের বিপর্যয় ইস্যু, সবকিছুই নিপুণভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। উল্টোদিকে প্রকৃত দেশপ্রেমী প্রচুর ছোট আকারের প্রচার সংস্থা, পরিবেশপ্রেমী জনগণ, পড়ুয়ারা নিজ উদ্যোগে এই আন্দোলনের খবর গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এর ফলে কেন্দ্র সরকারের অবস্থানের প্রতি তীব্র অসন্তোষ দেখা গেলেও গৃহমন্ত্রী ও ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ নীরব। এই বিষয়ে তারা ন্যূনতম সমাধানের পক্ষে দাঁড়াননি, উল্টে সেখানে এক বারও সফর করেননি। 

দেশের বুকে শুধু রেকড হারে মব লিঞ্চিং নয়, গত দশ বছরে রেকর্ড হারে পরিবেশ ধ্বংসের কৃতিত্বও গেরুয়া শিবির বহন করছে। উত্তর পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড় খনন করে বেআইনি হোটেল নির্মাণের কারণে সামান্য বৃষ্টিতে বন্যা, ধস নামছে প্রতি বছর। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ নষ্ট করে দেওয়া, রেইন ফরেস্টে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাণ ও প্রকৃতির ধ্বংস যজ্ঞ চলছে দেশে। বিকাশের নামে জনগণের করের টাকায় কেনা অস্ত্র ও প্রযুক্তি দ্বারা ড্রোনের মাধ্যমে বিস্ফোরক পদার্থ নিক্ষেপ করা হয়েছে ছত্তিসগড়ের আদিবাসী এলাকায়। কয়লা উত্তোলনের জন্য মাটি খনন করা হয়েছে ফলে ধস নেমেছে বিভিন্ন জায়গায়। ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের আদিবাসীরা যারা লাদাখের মতই প্রাকৃতিকভাবে সংবেদনশীল জায়গায় বসবাস করেন এবং যারা মূলত জঙ্গল কেন্দ্রিক বাসিন্দা। লাদাখের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই কিভাবে দ্রুত হারে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে সড়ক, বিল্ডিং ইত্যাদি তৈরির চেষ্টা চলছে এবং কিভাবে নির্দিষ্ট আইনের অভাবকে কাজে লাগিয়ে অঞ্চলটিকে খুলে দেওয়া হয়েছে জমি মাফিয়াদের কাছে। 

বিজেপিই যে দেশের সবচেয়ে বড় ইকোসিস্টেম-ঘাতী পার্টি তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং দেশকে এবং দেশের খনিজ সম্পদ এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করতে প্রত্যেকটি রাজ্যে জোটবদ্ধোভাবে লড়াই করতে হবে। নয়তো এর চেয়েও কঠিন সময় আসতে চলেছে... 

['ডিলিজেন্ট' পত্রিকার পর্যবেক্ষণ: সোনাম ওয়াংচুক লাদাখের সেচ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন, অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে তার ফলে উদ্ভিদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং তার সাথে সম্পর্কিত বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া অতিবৃষ্টির সৃষ্টি করছে। এর ফলে অতিরিক্ত প্রবহমান জল লাদাখের শীর্ণকায় নদীগুলি ধরে রাখতে অক্ষম। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে বন্যার মত পরিস্থিতি। এই মতামতকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা প্রয়োজন। লাদাখের 6th Schedule ও পূর্ণ রাজ্যের দাবী অবশ্যই সমর্থনযোগ্য কিন্তু সোনাম ওয়াংচুকের প্রদত্ত 'উন্নয়ন' পদ্ধতিগুলো কতটা সামগ্রিকভাবে ইকোলজি ও প্রকৃতি বান্ধব  এবং প্রকৃতি আন্দোলনের নামে এর পিছনে কোনও কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাত আছে কিনা সে বিষয়ে আমাদের সংশয়ী থাকা উচিৎ। ]

Picture Courtesy: Wikipedia 

Comments

  1. খুব ভালো লেখনী। প্রাকৃতিক জীবৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখা খুবই দরকার। কিন্তু মানুষের কার্যকলাপ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা