‘শেয়ার’-এর সরকারের VIKAS পরিকল্পনা

অভিজ্ঞান চক্রবর্তী


২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় তাদেরকে ক্ষমতা ধরে রাখতে এনডিএ পুনর্জীবিত করে কিছু ফ্রিঞ্জ মন্ত্রীত্ব ‘শেয়ার করতে হচ্ছে। মন্ত্রীত্ব শেয়ার করার ব্যাপারে তাদের হিংসুটেপনা ধরা পড়লেও এই লেখায় মূলত আলোচনা করা হবে এদের অন্য ‘শেয়ার-এর প্রতি বিশেষ আনুগত্যের ব্যাপারে। শুরুতেই বিজেপির জোট সরকারের জয়নাদের মাঝে দেখে নেওয়া যাক দেশের বর্তমান কর্মসংস্থানের অবস্থা এবং ভারতের তিন ট্রিলিয়ন ইকোনমির অন্তঃসার: ভারত সরকারের ‘মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইম্পলিমেন্টেশন-এর ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের রিপোর্ট দেখাচ্ছে যে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে দেশের প্রতিটি শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সার্বিকভাবে বেকারত্বের হার ৬.৮-৮.২ শতাংশের মধ্যে থেকেছে। ‘অ্যানুয়াল সার্ভে অফ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সাম্প্রতিকতম সার্ভেতে দেখা গেছে প্রায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের প্রায় ৪০ শতাংশ কন্ট্রাক্টচুয়াল হিসেবে কাজ করছে। ভারতের আইটি ইন্ডাস্ট্রির টপ সার্ভিস প্রোভাইডারদের তথ্য অনুযায়ী আইটি সেক্টরে কন্ট্রাক্টচুয়াল হায়ারিং ২২ শতাংশ হারে বাড়ছে! এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশান-এর ২০২৩-এর রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র সরকারি স্কুলগুলোতেই প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষক প্যারাটিচার হিসাবে পার্মানেন্টদের এক-তৃতীয়াংশ বেতনে চাকরি করছেন। বিশ্বব্যাপী ছাঁটাই-এর পরিসংখ্যানের নিরিখে ভারতবর্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই দ্বিতীয়স্থানে অবস্থান করছে। দেশের সাধারণ মানুষ ক্রমাগত সংসার চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থের অনেক কম রোজগার করছেন, অনিশ্চিত কন্ট্রাক্টচুয়াল চাকরির ফাঁসে আটকে পড়ছেন এবং দেনার দায়ে জর্জরিত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় কেন্দ্রের মোটাভাইদের দাওয়াই হচ্ছে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ এবং স্টার্ট আপ।

শার্ক ট্যাঙ্ক-এর স্টার্ট আপ প্রোমোশানের মতো অনুষ্ঠান চাকরির বদলে স্টার্ট আপের ঝড় তোলার চেষ্টা করছে।প্রসঙ্গত এই অনুষ্ঠানের ইনভেস্টাররা আগে থেকে স্টার্ট আপ-এর হাই গ্রস মার্জিন (উৎপাদন খরচ আর মোট বিক্রয়ের মধ্যেকার তফাৎ) না থাকলে বিশাল ইনভেস্ট করে না এবং শো টেলিকাস্ট-এর ৬-৭ মাস পরেও স্টার্ট আপগুলির কাছে টাকা এসে পৌঁছয় না কারণ যে পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট দেখানো হয় সেই পরিমাণ টাকা এদের নিজেদের ব্যাঙ্কেই ক্যাশ হিসাবে নেই, এমনই অভিযোগ ওই অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারীদের। উল্টোদিকে মুনাফা নিয়ে জ্ঞান দেওয়া এই শার্কদের অধিকাংশই রয়েছে লোকশানে এবং এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ব্যাঙ্কের সাথে ফ্রড কেসে অভিযুক্তও হয়েছে!

দেশজুড়ে চাকরির পরিবর্তে স্টার্ট আপ-কে আয়ের ভালো উপায় বলে প্রতিপন্ন করে এবং তার জন্য সহজেই লোন এবং ট্রেড লাইসেন্স জোগাড়ের ব্যবস্থা করে সরকার উৎসাহিত করতে চাইলেও এই স্টার্ট আপ ইকোসিস্টেম-এর বাস্তবতা সরজমিনে দেখে নেওয়া যাক। ভারতবর্ষ কি সত্যিই স্টার্ট আপের নতুন ক্ষেত্র? আইবিএম-এর একটি রিপোর্ট বলছে ৬০ শতাংশ ভারতীয় স্টার্ট আপ প্রথম দুবছরে এবং ৯০ শতাংশ ভারতীয় স্টার্ট আপ প্রথম ৫ বছরে মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং অধিকাংশই উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ভারতের ১০০টি ইউনিকর্ন (যে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা তার বেশী) স্টার্ট আপের মধ্যে শুধুমাত্র ৩১টি স্টার্ট আপই ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মুনাফা করতে পেড়েছে, বাকি ৬৯টি ইউনিকর্নই লোকশানে চলছে। ১১২টি সুনিকর্ন্স (২০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ভ্যালুয়েশন)-এর মধ্যে মাত্র ৪৭টি ২০২৩ সালে তাদের ফিনান্সিয়াল রিপোর্ট পাবলিক করেছে, যার মধ্যে ৩৮টির মোট লোকশান ১ বিলিয়নেরও বেশী। বাকিদের রিপোর্ট কার্ড অপ্রকাশিত। এর মধ্যে ‘ক্যাশ ফ্রি-এর মতো ফিনটেক সুনিকর্নের লোকশানের পরিমাণ নজর কাড়া (৪৩৪১.৫ শতাংশ)!

এইরকম নজরকাড়া পার্ফরমেন্সের পর কয়েকটি প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে। এক, মুনাফা কি হচ্ছে না, না হলে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন বাড়ছে কিভাবে। দুই, স্টার্ট আপ ধুঁকতে থাকলে কিছু ইনভেস্টর ও বোর্ড-এর মেম্বাররা কিভাবে ঝামেলা থেকে বেড়িয়ে আসছে। একজন কোম্পানির ফাউন্ডার নিজের কোম্পানির পরিকল্পিত গ্রোথের প্ল্যান দেখিয়ে ইনভেস্টরের কাছ থেকে টাকা তোলে এবং নিজের ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট বাড়িয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, জমি, ফ্যাক্টরি এবং স্বল্প লেবার ফোর্স দেখিয়ে অঙ্গীকার করে যে সে বা তারা খুব তাড়াতাড়ি কম খরচে নির্দিষ্ট পরিমাণ গুডস বা সার্ভিস বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারবে এবং সাময়িকভাবে লস হলেও লং টার্মে মার্কেটিং-এ খরচা করে ইউজার বাড়িয়ে লাভের মুখ দেখবে। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ইনভেস্টর টাকা দেয় এবং ভ্যালুয়েশন অনুযায়ী সেই পরিমাণ অংশীদারী কোম্পানি থেকে নেয়। এই ইনভেস্টর বা অংশীদারও সারা জীবন ওই অংশীদারত্ব নিয়ে বসে থাকে না। সে কোম্পানিকে বাজার দখল করার জন্য আরও ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট করতে বলে এবং আগের চেয়ে ভ্যালুয়েশন বাড়াতে না পারলে তার লায়াবিলিটি অন্য কাউকে বেচে বাজারের ভাষায় এক্সিট নেয় বা চম্পট দেয়। একইসাথে কোম্পানিগুলো জনতার থেকে টাকা নেওয়ার জন্য ফাটকা বাজারে নিজেদের আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফার) লঞ্চ করে এবং একইভাবে নিজেদের অ্যাসেট এবং ইনভেস্টমেন্ট দেখিয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে ব্যবসার ঠেকনা দিতে চায়। প্রসঙ্গত, শার্ক ট্যাঙ্কের এক ইনভেস্টর গজল অলঘ-এর কোম্পানি ‘মামাআর্থ-কে সেবি ভুঁয়ো তথ্য দেখানোর কারণে ধমক দেয় এবং আইপিও লঞ্চ বিলম্বিত করায়। অর্থাৎ এই পুরো সিস্টেমে এটাই বোঝা যায় যে লাইবিলিটি ট্রান্সফার-এর মাধ্যমে ইনভেস্টর আসন্ন সংকট থেকে উদ্ধার পায় এবং একইসাথে বারংবার এই অংশীদারিত্ব লেনদেনের মাঝে ভ্যালুয়েশন-এর ফানুশ ফুলতে থাকে।

ইনভেস্টর-এর বকেয়া ও ব্যাঙ্কের সুদ মেটাতে গিয়ে এই কোম্পানিগুলো প্রফিটের মুখ দেখতে পারছে না। অল্প সংখ্যক শ্রমিক কর্মচারীর ব্যবহার একদিকে উৎপাদিত পণ্যের কোয়ালিটি কমিয়ে দিচ্ছে ও সময়ের মধ্যে উৎপাদনে ব্যর্থতা আনছে এবং অন্যদিকে সামাজিকভাবে কর্মহীনতার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে সেই পণ্য বাজারে বেচে ওঠা যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, সমস্ত স্টার্ট আপ-এর টার্গেট ইউজার বিশাল বেতনভুক নিওলিবেরাল কঞ্জিউমার না হওয়ায়, এই সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করছে। বড় ইনভেস্টমেন্টওয়ালা সংস্থা ছাড়া কম সংখ্যক নিওলিবেরাল কঞ্জিউমারকে টার্গেট ইউজার করাও সম্ভব নয়। একইসাথে কন্ট্র্যাক্ট টার্মের শেষে ভ্যালুয়েশন-এর সমপরিমাণ উৎপাদন দেখাতে না পেরে স্টার্ট আপগুলো চিরাচরিত নিয়মে ভেঙে পড়ছে এবং যে ব্যক্তি বা ফাউন্ডার তখনও নিজের সবটুকু অংশীদারী বেচে বেরতে পারেনি সে যাচ্ছে ফেঁসে। বড় ইনভেস্টররা তখন কোম্পানিকে ডিভ্যালু করে নিজেদের টাকা নিয়ে সড়ে পড়ছে। ফলে কোম্পানি না দিতে পারছে কর্মচারীদের বকেয়া বেতন, না মেটাতে পারছে ভেন্ডারদের প্রাপ্য। কোম্পানি ডিভ্যালু হওয়ার কারণে সাধারণ ইনভেস্টররা হারাচ্ছে ইনভেস্ট করা অর্থ। একদা ভারতের এক নম্বর এডটেক কোম্পানী বাইজুস-এর ব্যাপকভাবে বেড়ে ওঠা এবং মুখ থুবড়ে পড়া, কর্মী ছাঁটাই এবং কর্মীদের বেতন আটকে দেওয়া উল্লিখিত পরিস্থিতির আদর্শ উদাহরণ। ঠিক একই অবস্থা পেটিএম-এর মতো ভারতের প্রথম সারির ফিনটেক কোম্পানিরও।

ক্রমাগত ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট বাড়িয়ে মার্কেটকে একবগ্গাভাবে চালনা করা (যেমন অ্যামাজন) বা লাইবিলিটি ট্রান্সফার-এর খেলাটা ঠিকঠাক খেলে সঠিক সময়ে এক্সিট না নিতে পারলে ফাউন্ডার-এর অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেই চিত্রটা আশা করি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ স্টার্ট আপের মাধ্যমে বড়লোক হয়ে ওঠার যে স্বপ্ন মধ্যবিত্তের কাছে আনা হয়েছে তা কতটা ভুঁইফোঁড় সেটা বুঝে নেওয়া দরকার। 

একইসাথে বর্তমানে দেশের তথাকথিত বাড়ন্ত ইকোনমি-র মাঝে শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করে বিত্তবান হয়ে ওঠার তত্ত্বকেও একটু খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমত, এক্ষেত্রে দুধরণের ইনভেস্টমেন্টের কথা বলতে হয় - এক, অপশন ট্রেডিং (দিনের শুরুতে এবং ট্রেডিং ডে-এর শেষে কোনো একটি শেয়ারের দাম কত থাকবে তার ওপর খেলা ফাটকা) এবং ইনট্রা ডে ট্রেডিং (দিনের বিভিন্ন সময়ে দাম কত ওঠা নামা হবে তার ওপর খেলা ফাটকা)-এর মাধ্যমে প্রথাগত টেকনিক্যাল অ্যানালিসিস এবং শেয়ারের ব্যাপারে পড়াশুনা করে লটারির মতো টাকা বাড়িয়ে নেওয়ার খেলা এবং দুই, ইন্সটিটিউশনাল শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে (বিভিন্ন সেক্টরে ইনভেস্টকারী সংস্থার ফান্ড) ইনভেস্ট করে লং টার্মে প্রফিট সুরক্ষিত করা। অপশন বা ইনট্রা ডে ট্রেডিং শুনতে লটারির মত লাগলেও এ তার চেয়েও ভয়ানক কারণ লটারির মতো এ শুধু গেম অফ চান্স নয়। শেয়ার আগে বেচে দিয়ে পরে দাম পড়ে গেলে তা আবার কিনে নেওয়ার কাজ হিন্ডেনবার্গ তাদের ক্লায়েন্টদের দিয়ে আদানীর শেয়ারের উপর করিয়েছিল। যার কাছে যত বেশী টাকা সে শেয়ার মার্কেটকে ওঠাতে নামাতে পারে নিজের ইচ্ছেমতো, আর মাঝে পড়ে উলুখাগড়ারা নিজের সর্বস্ব খুঁইয়ে ফেলে, কোনো টেকনিক্যাল অ্যানালিসিসই তখন বাঁচাতে পারে না।

অন্যদিকে লংটার্ম ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে শর্ট টার্মে কিছু সামান্য লাভ হলেও (এক্ষেত্রেও যার যত ইনভেস্টমেন্ট তার তত বেশী প্রফিট) সামগ্রিকভাবে কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী টার্ম শেষে রিয়াল প্রোডাকশান দেখানো না গেলে বিশ্বব্যাপী ক্রাইসিস-এর (২০০৮-এর মত) খাঁড়ার ঘা এসে পড়ে সাধারণ ইনভেস্টরের ওপরে। একদিকে ক্রাইসিস রুখতে ছাঁটাই ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ নিরীহ মানুষের বেঁচে থাকার রসদটুকু কেড়ে নেওয়া হয় এবং অন্যদিকে শেয়ারে টাকা ডুবে যাওয়ায় কপর্দকশূন্যই হয়ে উঠতে হয় শেয়ারে ইনভেস্ট করে বড়লোক হওয়ার স্বপ্নময়ীদের। ওয়ারেন বাফেটের মত শেয়ার হাঙররা মার্কেট পড়ে গেলে শেয়ার কিনে নেওয়া এবং শেয়ার কখনও বিক্রি না করার পাঠ পড়ায় কিন্তু নিজেরা ঠিকসময়ে লাইবিলিটি ট্রান্সফার করে ক্রাইসিস থেকে মুক্তি পেলেও ছাঁটাই, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, বেতন হ্রাসের মাধ্যমে পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের ওপর নামিয়ে আনে রিসেশনের কোপ। এইসব হাঙরেরা নিজেদের গচ্ছিত বিপুল অর্থের জোড়ে টিকে গেলেও খেটে খাওয়া মানুষের (যে নিজে শেয়ারে ইনভেস্টই করেনি) মাজা ভেঙে যায় এবং জেনারেশন ট্রান্সফার হয়ে যায় আবার উঠে দাঁড়াতে।

কিন্তু বার বার পুঁজিবাদের ঘুঘু চাইলেও কি এই ক্রাইসিস থেকে মুক্তি পায়? বারংবার কন্ট্র্যাক্টের হাত বদল এবং বিভিন্ন কন্ট্র্যাক্টের লেনদেনের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত পুঁজির ৬ থেকে ১০ গুণ পরিমাণের ডেরিভেটিভ পুঁজির সৃষ্টি হয়। এই অঙ্ক মিলিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ, পণ্য উৎপাদন এবং তা বিক্রয়ের ফলে পুঁজিপতির কাছে মুনাফা পৌঁছলে কেবল তবেই ডেরিভেটিভ পুঁজির ফানুশ চুপসে গিয়ে সব হিসাব মিলে যায় আর তা না হলেই ফানুশ ফেটে গিয়ে আসে ক্রাইসিস, কেউ বেঁচে যায় তো কেউ দেউলিয়া হয়। এই পুরো ঘটনাটাই ঘটে সামাজিকভাবে, যার ফলে ক্রাইসিসের আকারও হয় বিশ্বব্যাপী। যেমন হয়েছে ২০০০, ২০০৮, ২০১৬ সালে... প্রসঙ্গত, ২০০৮-এর ক্রাইসিসের সময়ে তৎকালীন চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন্টাও সরকারী রাজকোষের দরজা খুলে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রাইসিস থেকে তার দেশের বিরাট সংখ্যক সাধারণ ইনভেস্টর এবং নিরীহ জনতাকে রক্ষা করেছিলেন (বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি ঝিনপিং “নো কোভিড পলিসির মাধ্যমে বারংবার লকডাউন করে প্রোডাকশান সেক্টরকে দুর্বল করে এবং ডেরিভেটিভ ট্রেডিং-এর রমরমা বাড়িয়ে নিজের দেশকেই ক্রাইসিস-এর একটি এপিসেন্টারে পরিণত করছে)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের ভারতবর্ষের ৫ ট্রিলিয়নের দিকে ক্রমধাবমান অর্থনীতি কি দেশবাসীকে ভবিষ্যতের বিশ্ব ক্রাইসিস থেকে রক্ষা করতে পারবে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশ বর্তমানে ৭৮.১২ বিলিয়ান ইউএস ডলার ট্রেড ডেফিসিট নিয়ে চলছে!  

আদতে ভারতবর্ষ কোনোভাবে ইউরোপ ও মার্কিনীদের সার্ভিস প্রোভাইডার এবং বিশ্বব্যাপী চিপ লেবার-এর মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে না তো। ১৯৮০ সালে যে সার্ভিস সেক্টর ছিল অর্থনীতির ৪০ শতাংশ তা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৮ শতাংশে। ভারতের রাশিবিজ্ঞান মন্ত্রকের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতের জিডিপিতে সর্বোচ্চ প্রদান করে সার্ভিস সেক্টর (প্রায় ৩৬ শতাংশ)। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া-র নামে যে প্রোগ্রাম চলছে, তাতেও দেখা যায় অধিকাংশ শেয়ার ইলেক্ট্রনিক গুডস-এর, যার অধিকাংশ পার্টসই তৈরী হয়ে আসে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান থেকে এবং ভারতে তাদের অ্যাসেম্বলি হয় (টাটার ন্যানো কারখানার কথা মনে পড়ছে?)। অন্যদেশ থেকে বিজনেস নিয়ে আসার নিরিখে ভারতের সবচেয়ে ভ্যালুয়েবেল কোম্পানি টিসিএস-ও আদতে একটি সার্ভিস কোম্পানি। উল্লেখ্য, রিসেশনের পরিস্থিতিতে টিসিএস, কগনিজেন্ট, ইনফোসিস-এর মত কোম্পানির ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই চলছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, হু জিন্টাও-এর সরকার যেভাবে চীনে ক্রাইসিস সামলাতে পেড়েছিল, সে ক্ষমতা আজকের মোদী সরকারের আছে তো। প্রসঙ্গত, অর্থমন্ত্রক-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ সালে ভারত সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩,৭৪,৪৮৪ কোটি টাকা যা ২০২২-২৩ সালে ৭,৪৮,৮৯৫ কোটির কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। রাজ্য সরকারগুলোকে বাদ দিলে ২০১৩-১৪ থেকে ২০২২-২৩-এর মধ্যে শুধু কেন্দ্র সরকারই ১৭৪ শতাংশ দেনা বাড়িয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড-এর তথ্য অনুযায়ী ভারতের ডেট-টু-জিডিপি রেশিও ৮৩ শতাংশ। একটি কথা আজকাল বারংবার শোনা যায় যে মোদী সরকারে থাকলে শেয়ার মার্কেটের আরও উত্থান হবে। ৪ঠা জুন I.N.D.I.A জোটের বেশি আসন প্রাপ্তি শুরু হতেই শেয়ার বাজারে ধস নামে। উল্লেখ্য, এই প্রথম নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে ভারতের রাজনৈতিক দলেরা ফাটকা বাজারকে কেন্দ্র করে তর্জায় নামলো। ৫ই জুন রাহুল গান্ধী সাংবাদিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচন চলাকালীন আদানী গোষ্ঠীর নিউজ চ্যানেলে শেয়ারে টাকা লাগানোর অভিযোগ করলেন। ১৩ই মে অমিত শাহ বিনিয়োগকারীদের ৪ঠা জুনের আগে শেয়ার কেনার কথা বলেন এবং মোদী ১৯ থেকে ২৮শে মে বারংবার বলেছিলেন যে ৪ঠা জুন স্টক মার্কেট রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছবে। ভুঁয়ো বুথ ফেরত সমীক্ষা দেখিয়ে শেয়ার বাজার চাঙ্গা করারও অভিযোগ ওঠে। এই তর্জা এটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে মোদী সরকার বর্তমান নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে কর্মসংস্থানের ব্যাপক হ্রাস করে যুব সমাজকে ফাটকা বাজারের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্ব সংকট ভারতে ঢুকে পড়লে সেই ক্রাইসিস থেকে পুঁজিপতিদের বাঁচাতে সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর শ্রম আইন, বিমুদ্রাকরণ ইত্যাদির ন্যায় নয়া আইন চাপিয়ে, তাদের অতিরিক্ত খাটিয়ে ক্রাইসিসকে ঠেকিয়ে রাখার মসীহা হতে চাইছে মোদী সরকার। এটাই তাদের VIKSIT ভারতের পরিকল্পনা। অন্যদিকে, বিভিন্ন জন বিরোধী আইন সংসদে পাশ হওয়ার সময় নিশ্চুপ থাকা এবং ভারতে ফ্রি মার্কেট ইকোনমিকে হাত ধরে টেনে আনার কাণ্ডারী জাতীয় কংগ্রেস-এর নেতৃত্বাধীন বিরোধী I.N.D.I.A জোট কি আগামীদিনে মোদীর জনবিরোধী নীতির বিরোধিতা করবে নাকি প্রশান্ত কিশোরের বাণী অনুযায়ী পুরনো জন মোহিনী ইমেজ ঝেড়ে ফেলে দলের স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্টের নামে মার্কিন ধাঁচে পুরোদস্তুর ইনভেস্টমেন্ট-এর লক্ষ্যের পার্টিতে পরিণত হবে কংগ্রেস সেটাই এখন দেখার। ফলে, শেয়ারের টাকায় চলা এই অপোজিশন বা সরকার পক্ষের থেকে মুক্তির উপায় লুকিয়ে আছে সেই রাস্তার আন্দোলনের মাধ্যমে খেটে খাও-বাদী সমাজ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্যেই।

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?