বেসরকারি কলেজে টেকনিক্যাল কোর্স করেও কাজ নেই!
বেসরকারি কলেজে টেকনিক্যাল কোর্সের এক শিক্ষার্থীর প্রতিবেদন [নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক]
বর্তমানে দেশে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বহু ছাত্রছাত্রী টেকনিক্যাল কোর্স করে চাকরি পাওয়ার আশায় সেই কলেজগুলোতে ভর্তিও হচ্ছে। এই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে গেলে অত্যাধিক মাত্রায় টিউশন ফি দিতে হয় যা সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারের পক্ষে খুবই কষ্টদায়ক। তবুও ছেলেমেয়ে চাকরি পাবে এই আশা রেখে বহু অভিভাবক নিজের সারা জীবনের কষ্টার্জিত টাকা ব্যয় করে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থার মত চড়া সুদে লোন নিয়ে নিজের সন্তানকে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি করান। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিও এই স্বপ্ন দেখার ইন্ধন জোগায়। LiveMint-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে AICTE আরও ৪৪টি নতুন প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু The Economic Times-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের placement ৫০-৭০% কমে গেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে প্রাইভেট কলেজে পড়েও শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না। এবার আমাদের রাজ্যের বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দেখে নেওয়া যাক।
শহরতলির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বিবরণ অনুযায়ী, তাকে ভর্তির সময়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাইভেট কলেজে আগে থেকে সিট বুক করে রাখার প্রথা আছে জেনে সে MAKAUT বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলকাতার একটি প্রাইভেট কলেজে সিট বুক করতে যায়। সেখানে তার থেকে সিট বুকিং বাবদ ১০,০০০ টাকা ও brochure বাবদ ৮০০ টাকা নেওয়া হয়। তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে MAKAUT CET প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে সে ওই কলেজে সুযোগ না পেলেও তাকে সেখানে ভর্তি নেওয়া হবে। পরে তার থেকে প্রথম সেমিস্টারের ফি বাবদ ৪০,০০০ টাকা অগ্রিম নিয়ে তাকে 'provisionally admit' করা হয়। পরবর্তীতে সে সেই কলেজে alloted না হলে তাকে ভর্তি নেওয়া যাবে না বলে জানানো হয় কলেজ কর্তৃপক্ষের দ্বারা। সেমিস্টারের অগ্রিম ফি তাকে রিফান্ড করে দিলেও, সিট বুকিং-এর টাকাটা বহুবার ফোন করার পর তাকে রিফান্ড করা হয়। অনেকবার তার ফোন ধরাও হয় না। এরপর সে শহরতলির একটি বেসরকারি টেকনোলজি কলেজে যায় ভর্তি হওয়ার জন্য। সেখানে তাকে জানানো হয় যে MAKAUT বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বরাদ্দ সিট প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হয়ে যাওয়ায় তাকে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ওই একই কলেজে ভর্তি নেওয়া হবে। তার ক্লাস ওই কলেজের শিক্ষকরাই নেবে কিন্তু তার ডিগ্রি ওই অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হবে। ক্লাস শুরু হওয়ার পর দেখা যায় ওই কলেজের শিক্ষকদের বদলে উল্লিখিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই ক্লাস নিচ্ছে ক্যাম্পাসে এসে। তার দুমাস পর তাদের পুরো ব্যাচকে আগের থেকে কোনোকিছু না জানিয়ে সম্পূর্ণভাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টে পরিণত করা হয়। ওদের placement-এর সময়ে যা চাকরির সুযোগ এসেছে তা বেশিরভাগ কম বেতনের sales, marketing ও BPO-এর চাকরী। এই চাকরিগুলোর সাথে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সম্পর্কই নেই। বিজ্ঞাপনে বা ভর্তির মুহূর্তে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় placement-এর সময়ে যে কম্পানিগুলোর আসার কথা বলে, সেগুলোর কোনোটিকেই সে এখনও placement-এর জন্য আসতে দেখেনি। তাদের কোনোরকম internship-এর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়নি। বরঞ্চ তাদের Industrial Training-এর নামে যে সংস্থাগুলোতে যোগাযোগ করানো হয়েছে, তারা টাকার বিনিময়ে তাদের কিছু কোর্স করিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে দিয়ে তাদের বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরী পাওয়ার উপযোগী গুরুত্বপূর্ণ সেরকম কিছুই সেখানো হয়নি। এমনকি তাদের সেই সংস্থাগুলি ক্লাসে প্র্যাক্টিসের জন্য একটা কম্পিউটারও দেয়নি। তাদের সহপাঠীদের মধ্যে যারা চাকরি পেয়েছে তা সবই off campus-এ।
শহরতলির ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন ছাত্র সল্টলেকের একটি বেসরকারি কলেজে ভর্তির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাকে বলা হয়েছিল কোনো প্রবেশিকা পরীক্ষা ছাড়াই সে ভর্তি হতে পারবে। সেই অনুযায়ী সে ৬০,০০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়। সে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে যে তাকে MAKAUT CET পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হবে কিনা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানায় যে সেই পরীক্ষা নাম মাত্র, টাকা দিলেই নাকি ভর্তি হয়ে গেল। তবুও সে পরীক্ষা দেয় কিন্তু সেই কলেজে সুযোগ পায় না। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষকে বার বার কল করার পরেও তারা ফোন ধরে না। পরেরদিন কলেজে গিয়ে সে দেখে যে তার মতই প্রতারিত আরও অনেক ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক কলেজের সামনে ভিড় করেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয় তাদের ভর্তি MAKAUT-এর অন্তর্গত ওই কলেজে না হয়ে বরঞ্চ ওই কলেজ গ্রুপের অন্তর্গত নিজস্ব আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে হবে। তারা টাকা রিফান্ডের কথা বহুবার বলার পর কর্তৃপক্ষ প্রথম সেমিস্টার শেষের পরে তা করে। তাও সবাই রিফান্ড পেয়েছে নাকি তা বলা যাচ্ছে না।
শহরতলির আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের দাবী তাদের campusing-এ যা চাকরীর সুযোগ আসছে তার বেশিরভাগই sales আর marketing-এর এবং সবই স্বল্প বেতনের। তাদের অর্জিত স্কিলের সাথে এই চাকরির কোনো সম্পর্কই নেই। সে আরও দাবী করে যে এই চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে মেধার থেকে পক্ষপাতিত্ব বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
শহরতলির আরেকটি বেসরকারি কলেজের এক ছাত্রীর কথা অনুযায়ী B.Tech-এর শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু পরিমাণ চাকরি আসলেও BCA আর MCA-এর শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো চাকরিই আসেনি। এমনকি B.Tech-এর campusing চলার সময়ে BCA আর MCA-এর Laboratory class-ও বহুদিন বন্ধ রাখা হয়। সে এমনও দাবী করে যে তার আগের ব্যাচে যারা গ্র্যাজুয়েট হয়েছে তাদের কাউকেই campusing-এ চাকরি দেওয়া হয়নি।
শহরতলির আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর কথা অনুযায়ী তাদের যা চাকরি এসেছে তার সবই sales আর marketing-এর স্বল্প বেতনের।
শহরের পূর্বে বর্ণিত একটি বেসরকারি কলেজের এক ছাত্রের দাবী, তাদের কলেজে এখনও placement drive শুরুই হয়নি!
ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে টেকনিক্যাল কোর্স পড়েও শিক্ষার্থীরা কোথাও চাকরি পাচ্ছে না আর যেখানে তাদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে তার সাথে তাদের পাঠ্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এই সবই অতি সামান্য বেতনের কাজ। আবার কোথাও তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে internship-এর নামে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কোর্স করার দিকে।
Picture Courtesy: Craiyon AI
Comments
Post a Comment