উদ্দেশ্য কাস্ট সেনসাস - বাম ডানের পার্থক্য
প্রিয়াংশু দে
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার একটি কাস্ট সেনসাস করার ঘোষণা করেছে। কাস্ট সেনসাস আমাদের দেশের বামপন্থীদের দাবী হলেও বিজেপি ও তার আদর্শগত অভিভাবক আরএসএস শুরু থেকে এর বিরোধিতা করে এসেছে। ফলে হঠাৎ করে এই অবস্থান বদল অনেকটা "ভূতের মুখে রাম নাম"-এর মত ঠেকছে। এই সেনসাসে সম্মতির পেছনে তাদের কোন রাজনৈতিক ও আদর্শগত স্বার্থ রয়েছে? বিজেপি ও আরএসএস তাদের সূচনাকাল থেকেই ঐক্যবদ্ধ হিন্দু পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। প্রাক্তন আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকার তার লেখায় বর্ণব্যবস্থাকে সামাজিক স্থিতিশীলতার উৎস বলে প্রশংসা করেছিল। ফলে দলিত আন্দোলনের ঢেউকে আটকে ব্রাহ্মণ্যবাদকে মজবুত করাই তাদের একটা বড় প্রোজেক্ট।
৯০-এর দশকে বিজেপি ওবিসিদের মধ্যেকার কিছু জনকে, যেমন উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং এবং মধ্যপ্রদেশে উমা ভারতীকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ করে দিতে শুরু করে। উচ্চবর্ণের বাইরেও নিজেদের প্রভাব বিস্তারই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এটা পিছিয়ে পড়াদের গেরুয়া মোড়কে নিয়ে এসে চিরাচরিত ব্যবস্থাকে কায়েম রেখেই নিজেদের ভোট ব্যাংক প্রসারের নীতি। বর্ণব্যবস্থাকে না ভেঙে তা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম অস্ত্র হল দলিতদের মধ্যে 'সাবক্যাটেগরাইজেশন'। অর্থাৎ দলিতদের ছোট ছোট উপজাতিতে বিভক্ত করে রাখার নীতি, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়। এই নীতি আন্তঃজাতি দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সীমিত প্রতিনিধিত্বের জন্য রেষারেষি তৈরি করে দলিতদের সামাজিক ন্যায় ও অধিকার প্রাপ্তির আসল লড়াই থেকে বিচ্যুত করবে।
এবার আমাদের দেশে দলিতদের মধ্যে বিভাজনের কিরূপ ইতিহাস রয়েছে তা দেখে নেওয়া যাক। ১লা আগস্ট, ২০২৪-এ সুপ্রিম কোর্ট সংরক্ষণে বিভাজন আনার রায় দেয়। এই রায়ের উদ্দেশ্য হল দলিতদের অন্তর্গত বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করা। বিভিন্ন জাতি বা উপজাতিদের মধ্যে কারা এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে তা বিচার করে পিছিয়ে থাকা জাতিদের সংরক্ষণের বেশি অংশ দেওয়া। ১৯৯০ সালে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের মাদিগা সম্প্রদায় দলিতদের মধ্যে প্রথম সাব-ক্যাটাগরাইজেশনের দাবী তোলে। নিজেদের জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের অংশ দাবী করে। সামগ্রিক দলিত পরিচয়ের চেয়ে নিজেদের 'মাদিগা' পরিচয় জাহির করতে শুরু করে। এই আন্দোলনের নেতা মন্দ কৃষ্ণ মাদিগা সমগ্র দলিত আন্দোলনের অংশ না হয়ে নিজ জাতির আত্মপরিচয়ের আন্দোলনের সূচনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে মাদিগাদের (যারা অন্ধ্রপ্রদেশের মোট দলিত ভোটের ৬০%) একটি স্পষ্ট পৃথক ভোট ব্যাংক গড়ে ওঠে। এরই সাথে মাদিগাদের বিশেষ সংরক্ষণের দাবী উঠতে থাকে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর আমলে বিচারপতি রামচন্দ্র রাজুর নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজ্যে দলিতদের জনসংখ্যার বিচারে চারটি ভাগে ভাগ করে নির্দিষ্ট সংরক্ষণের সুপারিশ করে। ১৯৯৭ সালে অন্ধ্রের সরকার দুটি নির্দেশনামা জারি করে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দলিতদের চার ভাগে ভাগ করে। মাদিগারা গ্রুপ এ-তে জায়গা পায়। ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশনামাগুলি বাতিল করে বলে যে দলিতদের মধ্যে সাব-ক্যাটেগরাইজেশন করার অধিকার রাজ্য সরকারের নেই। রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে দলিতরা হল আভ্যন্তরীণভাবে সমসত্ত্ব একটি গোষ্ঠী। অর্থাৎ তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করা যাবে না। ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসেবে সংবিধানে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের মধ্যে কোনো অংশকে আলাদা করে মর্যাদা দিলে তা সংবিধান বিরোধী কাজ হবে। পরবর্তীকালে কর্ণাটকে মাদিগার ও হোলেয়ারদের মধ্যে সংরক্ষণ নিয়ে সংঘাত ও তামিলনাড়ুতে তুলনামূলক প্রভাবশালী পারাইয়ার ও পাল্লারদের সাথে তুলনামূলক পশ্চাদপদ চাকলাইয়ার ও অরুন্থাথিয়ারদের সংঘাত শুরু হয়। ২০০৩ সালে মহারাষ্ট্রে লাহুজি সালভে কমিশন মাঙ জাতির মধ্যে সংরক্ষণ ভাগ করার সুপারিশ দেয়। ২০০৫ সালে কর্ণাটকে সদাশিব কমিশন ১০১টি জাতিকে ৪টি ভাগে ভাগ করার সুপারিশ দেয়। ২০০৭ সালে বিহারে মহাদলিত কমিশন ১৮টি অতি প্রান্তিক জাতিকে চিহ্নিত করেছিল, যাদের মধ্যে অন্যতম মুসাহার, ভুঁইয়া, ডোম এবং রাজোয়ার। ২০০৮ সালে তামিলনাড়ুতে জনার্থনম কমিটি অরুন্থাথিয়ার সম্প্রদায়ের জন্য পৃথকভাবে সংরক্ষণের সুপারিশ করে। তবে ২০০৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের ভিত্তিতে এগুলোর কোনোটিই কার্যকর হয়নি।
৯০-এর দশকে দেশের অর্থনীতি উন্মুক্ত করা হল। সেই সময়ই মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে সামনে রেখে সংরক্ষণ নিয়ে নতুন করে আলোড়ন তৈরি হয়। আর ঠিক সেই সময়ই রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদের প্রবল উত্থান শুরু হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদী আরএসএস-এর ড: আম্বেদকরের প্রতি ছিল বরাবরই প্রবল বিদ্বেষ। কিন্তু এই নয়া অর্থনৈতিক যুগে তারা তাদের দলিত ও আম্বেদকর নীতিতে পরিবর্তন আনে। দলিতদের মধ্যে 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' কায়েম করার অস্ত্র হিসেবে তারা সাব-ক্যাটেগরাইজেশনের প্রশ্নকে তুলে আনল। তাদের এই পলিসির প্রথম পর্যায় ছিল প্রচুর বইপত্র বের করে আম্বেদকরের গৈরিকীকরণ। আর দ্বিতীয় পর্যায় হল আম্বেদকরের নিজের জাতি মাহারদের এবং সংরক্ষণের সুবিধায় যে সকল জাতি কিছুটা হলেও এগিয়েছে, তাদের ব্যতীত বাকি জাতিদের আইকনদের তুলে ধরে সেই জাতিদের আত্বপরিচয়ের দাবী তোলা। আম্বেদকরবাদী দলিতদের বাইরে এই 'অন্যান্য' দলিতরা তাই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শুরু করল। ব্রিটিশরাও বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত ভারতীয় সমাজে নিপীড়িতদের মধ্যে বিভাজন করে সফলতা পেয়েছিল। তাই ড: আম্বেদকরের বর্ণব্যবস্থার বিনাশের জন্য আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। আরএসএস-এর পাতা ফাঁদে পা দেওয়াতে আম্বেদকরবাদী দলিত ও অন্যান্য দলিতদের মধ্যে বিভাজন ঘটল। এই বিভাজনই ২০১৪ সালে বিজেপিকে দলিত ভোট পেতে সাহায্য করে। তাই ২০১৪ ও ২০১৯-এর বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে সাব-ক্যাটাগরাইজেশনের দাবী জায়গা পায়। ২০১৭তে বিজেপি সরকার ওবিসিদের সাব-ক্যাটেগরাইজেশনের জন্য রোহিণী কমিশন স্থাপন করে। পরে এসসিদেরও এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। দলিতদের মধ্যে কোন কোন জাতি সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তা নির্ধারণ করাই নাকি উদ্দেশ্য! ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে তেলেঙ্গানায় গিয়ে নরেন্দ্র মোদী দলিতদের সাব-ক্যাটাগরাইজেশনের প্রতিশ্রুতি দেন। মাদিগারা বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বিপুলভাবে সমর্থন করে। সেই কথা মত ৫ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি করা হয় দেশের ১২০০-র বেশি দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে সংরক্ষণকে বন্টন করার উদ্দেশ্যে।
কোর্টের অবস্থান পরিবর্তনের ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে সংরক্ষণ কেবলই নিপীড়িতদের সামাজিক উত্তরণের উদ্দেশ্যে কার্যকর রয়েছে। তাই এগিয়ে থাকা - পিছিয়ে থাকার প্রসঙ্গ আসছে। আম্বেদকর নিজেই নিপীড়িতদের মধ্যেকার বিভেদ ও উচ্চ-নীচ স্তরীকরণকে চিহ্নিত করে বলেছিলেন 'গ্রেডেড ইন-ইকুয়ালিটি'। কিন্তু এই সংরক্ষণ নীতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল উচ্চ বর্ণ পরিচালিত সামাজিক বৈষম্যের মাঝে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষদের সম-সুযোগের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।
বাবাসাহেব আম্বেদকর বলছেন, "আমরা আইনসভা এবং পরিষেবা ক্ষেত্রগুলিতে সংরক্ষণ পেয়েছি এবং আমাদের বেশিরভাগ দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে ...
বিধানসভাগুলিতে তফসিলি জাতির জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত করা হয়েছে কিন্তু আমাদের প্রকৃত প্রতিনিধিদের এই আসনগুলিতে নির্বাচিত হতে দেওয়া হয়নি। এই সংরক্ষণ কেবল দশ বছরের জন্য এবং এর পরে কী হবে, আমি বলতে পারব না। আপনি কি মনে করেন যে দশ বছর পরে আমরা সমাজের উচ্চ বর্ণের লোকদের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য সক্ষম থাকব? ...
তফসিলি জাতির জন্য আসন সংরক্ষণ কেবল দশ বছরের জন্য। আমি চেয়েছিলাম যে এই সংরক্ষণ যতদিন অস্পৃশ্যতা থাকবে ততদিন পর্যন্ত থাকুক, কিন্তু কংগ্রেস নেতা প্রয়াত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আমার বিরোধিতা করেছিলেন। তাই কমিটিতে থাকা অন্যান্য ব্যক্তিদেরও সর্দারকে সমর্থন করতে হয়েছিল কারণ তারা তাঁর দলের সদস্য ছিলেন"।
দলিতদের মধ্যে কোন গোষ্ঠী শিক্ষা বা রোজগারের দিক থেকে তথাকথিত এগিয়ে থাকলেও সামাজিক বৈষম্য থেকে তারা মুক্ত নয়। সুতরাং অস্পৃশ্যতা কিংবা উচ্চ বর্ণের সামাজিক বৈষম্য/নিপীড়ন স্তিমিত না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক উত্তরণের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতিতে এগিয়ে থাকা - পিছিয়ে থাকার প্রসঙ্গ নিরর্থক। আর সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সামাজিক উত্তরণের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কও রয়েছে।
বামপন্থীরা সংরক্ষণের পরিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িতদের নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে কাস্ট সেনসাস চাইছে। কিন্তু আরএসএস সাব-ক্যাটেগরাইজেশন করে দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন এনে দলিত আন্দোলনকে আঞ্চলিক পরিচিতি সত্ত্বার আন্দোলনে রূপান্তরিত করে বর্ণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে।
তাই 'সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম' দাবী করছেঃ
১। কাস্ট সেন্সাস থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানগত তথ্য জনগণের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে।
২। কাস্ট সেনসাসকে সামনে রেখে এনপিআর প্রক্রিয়া চালু করা যাবে না।
৩। সংরক্ষণ নীতির মূল নিপীড়ন দূরীকরণকামী উদ্দেশ্যকে বহাল রাখতে হবে। একই সাথে সমস্তরকম জাতি দাঙ্গা রুখতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্যসূত্র
1. সংরক্ষণ প্রশ্নে দলিতদের নানা জাতে ভেঙে ফেলবার রায় সুপ্রিম কোর্টেরঃ একটি পর্যবেক্ষণ; Raktim Ghosh; ddkosambirf.org.in
2. BJP’s 2019 victory: How caste-based politics has been redefined and reinvented; Christopher Finnigan; LSE
3. OBC Sub-Categorisation: Repositioning the Subaltern Castes in BJP’s Electoral Arithmetic; Veeraiah Konduri; Newsclick
4. Right Wing Politics and Construction of Dalit Identity in India; Manoj Kumar Mishra; mainstreamweekly.net
5. RSS supports caste census for welfarism, opposes its use as political tool; Smriti Kak Ramachandran; Hindustan Times
6. BJP sought caste census during UPA rule: OBC Morcha chief; The Times Of India
7. RSS backs caste census for welfare, opposes its use for electoral purposes; Archis Mohan; Business Standard
8. The Politics with the Dalits; AlignIndia
9. Dr. Babasaheb Ambedkar: Writings and Speeches; Dr. Ambedkar Foundation; Vol 17 Part III
Picture Courtesy: Craiyon AI
Comments
Post a Comment