স্বাধীন প্রযুক্তি ও পুঁজির একনায়কতন্ত্র -উদ্ভাবন, গণতন্ত্র ও আধিপত্যের টানাপোড়েন

বঙ্কিম দত্ত


একটা সময় ছিল, যখন প্রযুক্তি বললে কেবল হাতের সরঞ্জাম-চাকা, লাঙল, টাইপরাইটার মনে ভেসে উঠতো। আজ প্রযুক্তি নিজেই হয়ে উঠেছে 'শক্তি'-এমন এক ক্ষমতা, যা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সম্পর্ক, চিন্তাধারা, এমনকি স্বাধীনতার পরিধিও। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, আমরা এক নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি:

প্রযুক্তি কি আজ শুধু উদ্ভাবনের ক্ষেত্র, নাকি পুঁজির সার্বভৌমত্বর একটি রূপান্তরিত মুখ?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব-ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব সেই প্রশ্নকেই জাগিয়ে তোলে। মাস্কের টেসলা রোবোট্যাক্সি প্রকল্পের গতি থামিয়ে দিতে ট্রাম্প রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারেন-এই আশঙ্কা প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নয়, বরং ক্ষমতার চরিত্র নিয়েই এক সতর্কবার্তা।

ইলন মাস্ক-একাধারে উদ্যোক্তা, স্বপ্নদ্রষ্টা, আবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর কোম্পানিগুলি-স্পেস-এক্স, টেসলা, নিউরালিঙ্ক-প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নির্মাণে অগ্রণী হলেও, তার চারপাশে গড়ে উঠছে এমন এক বলয়, যা ব্যক্তিমালিকানার ক্ষমতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমনকি রাষ্ট্রের বাইরেও।

মাস্কের একক সিদ্ধান্তে টুইটারের নাম বদলে যায় 'x', মতপ্রকাশের নীতি রূপান্তরিত হয় কয়েক ঘণ্টায়, দেখাতে চায় যে বিশ্বজোড়া 'নিয়ন্ত্রণ' যেন তাঁর হাতের মুঠোয়। এটা কেবল কর্পোরেট আধিপত্য নয়, পুঁজির একটি সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বর রূপ-যেখানে প্রযুক্তির ভাষা ও গতি নির্মাণে ব্যক্তির উদ্ভাবনীক্ষমতার চাইতেও বড় হয়ে ওঠে মালিকের মর্জি।

এই প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভূমিকাই কী? রাষ্ট্র চায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে-জনস্বার্থে, নিরাপত্তায়, নৈতিকতায়। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ কতোটা কার্যকর? আমলাতান্ত্রিক শ্লথতা, রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং প্রযুক্তির প্রতি অস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রকে এক ধরণের অসহায় পর্যবেক্ষকে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে, কিছুকিছু সময় রাষ্ট্র নিজেই হয়ে ওঠে কর্পোরেট স্বার্থের বাহক বা প্রতিপক্ষ। ট্রাম্প যদি মাস্কের বিরুদ্ধে গিয়ে গুগলের ওয়েমো-কে পৃষ্ঠপোষকতা দেন, তা হলে বুঝতে হবে-রাষ্ট্রীয় নীতিও অনেক সময় ক্ষমতার ব্যক্তিগত লড়াইয়ের অংশ।

এখানেই এসে পড়ে সেই প্রশ্ন: প্রযুক্তির গতি ও গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব কি?

বিখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক অ্যান্টোনিও গ্রামশি বলেছিলেন, আধিপত্য শুধু বাহুবলে নয়, সাংস্কৃতিক রূপেও গড়ে ওঠে। বর্তমান সময়ের কর্পোরেট প্রযুক্তি সেই সাংস্কৃতিক আধিপত্যেরই উদাহরণ-যেখানে নাগরিকের প্রতিদিনের আচরণ, চিন্তা, চাহিদা এমনকি প্রতিবাদও নিয়ন্ত্রিত হয় অ্যালগরিদম দিয়ে।

এ এক নতুন ধরনের ঔপনিবেশিকতা-যেখানে রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ভিতর থেকেও আমাদের পরিচয় নিয়ন্ত্রিত হয় কর্পোরেট কাঠামোয়। হাইডেগার যাকে বলেছিলেন 'enframing'; অর্থাৎ সবকিছুকে 'সম্পদ' বা 'ব্যবহারযোগ্য উপাদান' হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি-এটাই আজ প্রযুক্তির বাস্তবতা।

 

তবে, সবই কি নৈরাশ্য? একদম নয়। ভবিষ্যৎ নির্ধারণের রাস্তা এখনও আমাদের সামনে খোলা, কিন্তু তার জন্য দরকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি:

প্রযুক্তিনীতিতে সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ, কেবল আমলা বা কর্পোরেট নয় উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্ল্যাটফর্ম, যা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে সক্ষম আন্তর্জাতিক সহমর্মিতার নীতি, বিশেষ করে ডেটা, AIও নিরাপত্তার মত ক্ষেত্রে নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, যা প্রযুক্তিকে শুধুই পণ্যে রূপান্তরিত না করে সামাজিক দায়বদ্ধতার ভাষা শেখায়।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি যদি 'মুক্তি'র প্রতীক হতে চায়, তবে তা কেবল চিপ ও সফটওয়্যারে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রযুক্তি আমাদের মূল্যবোধ, সামাজিক কাঠামো ও নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। নচেৎ, আজকের উদ্ভাবনই হয়ে উঠবে আগামী দিনের এক নতুন দাসত্বের রূপ।

উপসংহার

প্রযুক্তির স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র-এই দুইয়ের সম্পর্ক এক জটিল টানাপোড়েন। যখন ব্যক্তি-মালিকানাধীন পুঁজি উদ্ভাবনের নামে সমস্ত কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত করে ফেলে, তখন গণতন্ত্র শুধু পর্যবেক্ষণ করে। কিন্তু প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র উদ্ভাবকের হাতে নয়-তা সমাজের সম্মিলিত কল্পনা, যুক্তি ও ন্যায্যতার উপর নির্ভর করে।

প্রশ্নটা আজ তাই প্রযুক্তির নয়-প্রশ্নটা ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, এবং কার জন্য প্রযুক্তি নির্মিত হবে।

মতামত নিজস্ব

লেখক নৈহাটি ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড কালচার (NISC)-র সদস্য।

Picture Courtesy: Craiyon AI

Comments

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?