বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা
সুমিত ঘোষ
বাম ঐক্য নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে মানে সামগ্রিক বা সর্ববৃহৎ বাম ঐক্য নেই। যা আছে তা হল - কিছু বামপন্থী দল, তাদের মধ্যেকার ঐক্য, কিন্তু সেই ঐক্যগুলিও এক্সক্লুসিভ নয়, বরং এদের সাথে বিভিন্ন ডানপন্থী দলকে জুড়ে নামে বেনামে তৈরি হয়েছে সম্মিলিত রামধনু জোট। আমাদের রাজ্যে একদিকে রয়েছে কিছু বামপন্থী গোষ্ঠী ও তৃণমূল কংগ্রেস এবং অন্যদিকে রয়েছে জাতীয় কংগ্রেস, আইএসএফ ও কিছু বামপন্থী দল। এই পরিস্থিতি জাতীয় স্তরেও বহাল রয়েছে 'ইন্ডিয়া' জোটের নামে।
আমাদের রাজ্যে এবং সারা দেশজুড়ে জাতীয় কংগ্রেসের সাংগঠনিক ক্ষয় হচ্ছে, কারণ সে এখনও তার সাংগঠনিক পরিচালনার ক্ষেত্রে অ্যানালগ মোডে রয়েছে, ডিজিটাল মোডে যায়নি। এমনটাই ডানপন্থীদের ইলেকশান ম্যানেজার প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্য। সারা দেশ জুড়ে কংগ্রেসের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। কংগ্রেসের এই শোচনীয় পরিস্থিতির বামপন্থী ব্যাখ্যা এটা হওয়াই স্বাভাবিক যে বিজেপির সাথে কংগ্রেসের অর্থনৈতিক পলিসিগত পার্থক্য না থাকা। পশ্চিমবঙ্গে এবং ত্রিপুরাতে বামপন্থীদের একাংশ জাতীয় কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট করে। বামেদের সাংগঠনিক শক্তির উপর ভর করে কংগ্রেস ত্রিপুরাতে বিধায়ক এবং এ রাজ্যে সাংসদ বার করে ফেলেছে। এ রাজ্য থেকে তারা একজন বিধায়কও পেয়েছিল কিন্তু সে এখন তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে "লেফট অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স"-এর ফলে এরা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে 'নেপোয় মারে দই' নীতি পালন করে। ডানপন্থীদের সাথে জোটের মাধ্যমে জগাখিচুড়ি সরকার প্রতিষ্ঠার ফানুশ উড়িয়ে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ করে বামেরা এ রাজ্যে শূন্য হয়ে পড়ে আছে। ২০১১ সালের পর থেকে এ রাজ্যে বামপন্থীদের যে ক্ষয় শুরু হয়েছে, সেই একই ট্রেন্ড ত্রিপুরাতেও দেখা যাচ্ছে। ত্রিপুরা যেন পশ্চিমবঙ্গকে অনুসরণ করছে বিভিন্ন পলিসি গ্রহণের ক্ষেত্রে; আত্মহননকারী পলিসি।
প্রশ্ন উঠবে আইএসএফ-কে নিয়েও। এই বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে কোনো নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে (মহিলাদের, দলিতদের, নিপীড়িত বর্ণের, আদিবাসীদের, এলজিবিটিকিউ-দের আন্দোলন ইত্যাদি) শ্রেণী প্রশ্ন ভুলে গিয়ে কেবল বিভিন্ন নিপীড়িত গোষ্ঠীকে অ্যাড্রেস করার পথেই কি হাঁটা হবে? বামেদের এলজিবিটিকিউ আন্দোলন কি কতগুলো এনজিও-র জোট হিসেবেই কাজ করবে? একইভাবে কি তাহলে বামেদের এই নিপীড়িত অংশের মধ্যে সরাসরি নিজেদের সাংগঠনিক বিস্তারের কোনো প্রয়োজন নেই? এনজিও সমষ্টি কিংবা আইএসএফ দিয়েই কি লড়াই হয়ে যাবে? বাম জোটে আইএসএফ থাকায় যে ক্ষতিটা হচ্ছে তা হল, এটা একটা ধর্মগুরুর দল; যতই বর্তমান নেতা নরমপন্থী মনোভাব দেখাক না কেন, মাথায় রাখতে হবে, যে কোনো সাম্প্রদায়িক দলেই একজন নম্র নেতা আর একজন উগ্র নেতা থাকে। যেমন বিজেপি-তে নম্র নেতা ছিল অটল আর উগ্র নেতা আডবানী। ঠিক তেমনিভাবে আইএসএফের ক্ষেত্রেও আব্বাস সিদ্দিকি উগ্র, পরধর্মবিদ্বেষী, পিতৃতান্ত্রিক কথা বলে আর তার ভাই নওশাদ সিদ্দিকী তুলনামূলকভাবে নম্র ও উদার হিসেবে প্রোজেক্টেড হয়। আইএসএফ-এর পতাকার পাশে যদি আহালে সুন্নাতুল জামাতের পতাকা না থাকে, তাহলে আইএসএফের সমর্থন ভিত্তি বলে কিছুই থাকে না। আমাদের রাজ্যে বামেরা ঐক্যবদ্ধ নয়। এই সুযোগে বাম আন্দোলনের ক্ষতি করে আইএসএফ নিপীড়িত মুসলমান জনগণকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করছে। ফলে এদের বর্জন করতেই হবে। এই যে বিভিন্ন নিপীড়িত গোষ্ঠীর দাবীগুলোকে অ্যাড্রেস করার কথা উঠছে, তা আমাদের দেশের বাম রাজনীতির ইতিহাসের নিরীখে নতুন কিছু নয়। এ বিষয়ে ত্রিপুরার আদিবাসী বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেবের অবস্থান অবশ্য উল্লেখ্য। যখন গণমুক্তি পরিষদ অস্ত্র ত্যাগ করে সিপিআই-তে যোগ দিল, তখন তৎকালীন সিপিআই নেতারা বলেছিলেন যে গণমুক্তি পরিষদের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী ও কৃষক হওয়ায় তারা কৃষক সভায় যোগ দিক। দশরথ দেবের মত ছিল, সবাই যেহেতু কৃষক, তারা শ্রেণী সংগঠন হিসেবে কৃষক সভায় অবশ্যই থাকবে। কিন্তু একইসাথে আদিবাসী হওয়ার দরুণ তাদের কিছু সম্প্রদায়গত দাবীদাওয়া আছে যার জন্য গণমুক্তি পরিষদ-কে বিলুপ্ত না করে আদিবাসী সম্পর্কিত গণসংগঠন হিসেবে পুনর্গঠন করা হোক। এই সংগঠন আদিবাসীদের দাবিদাওয়ার কথা বলবে। তাদের পৃথক ছাত্র সংগঠন থাকবে, যা মূল ছাত্র সংগঠনের শাখা হিসেবে কাজ করবে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এই যে শ্রেণী আন্দোলনের সাথে নিপীড়িত গোষ্ঠীর আন্দোলনের সংযোগ স্থাপন, এটাকেই আমরা CSA-র তরফ থেকে বলি 'দশরথ দেব ফর্মুলা'। সারা দেশজুড়ে এই দশরথ দেব ফর্মুলা বামেদের প্রয়োগ করতে হবে। দু:খের বিষয়, তাঁর মৃত্যুর পর এই পলিসির অবহেলার কারণে আজকে যখন ত্রিপুরাতে বামেরা নির্বাচনে হারছে, তখন গণমুক্তি পরিষদ অতীব দুর্বল এবং আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করছে রাজপুত্রের দল এবং বিজেপির পদলেহনকারী প্রতিক্রিয়াশীল আইপিএফটি। আমাদের রাজ্যের বামপন্থীদের বিভিন্ন ডানপন্থীদের সাথে জোট করে নিজেদের কোনো লাভ হচ্ছে না, উল্টে ক্ষতি হচ্ছে। সাধারণ জনতার কাছে বামেদের নিজেদেরকে একটা অল্টারনেটিভ ফোর্স হিসেবে তুলে ধরতে হবে। নইলে তারা শূন্য পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পারবে না। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে যে সাংগঠনিক ক্ষয় হয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসকেই রিপিট করছে, ভবিষ্যতেও করবে যদি না নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়।
এবার আসি কেরালার প্রসঙ্গে। সেখানে কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতি অটুট রাখার কারনেই বামেরা রাজ্য রাজনীতিতে আজও শক্তিশালী। সে কারণেই তারা অল্টারনেট বছরে জিতেছে আর এই প্রথমবার তারা পরপর দুটো টার্ম জিততে পেরেছে। আবার কেরালাতে যে "লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট" আছে তাতে বিভিন্ন ছোট ছোট ডানপন্থী দলও রয়েছে, কিন্তু সেই জোটের মধ্যে বামপন্থীরা শক্তিশালী, তারা নির্ণায়ক ভূমিকায় আছে। কেরালাতে লোকসভা নির্বাচনে বামাদের ফলাফল বারংবার ভালো হচ্ছে না। কিন্তু বিধানসভায় ভালো হচ্ছে। এ বিষয়ে ওখানকার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী থমাস আইজ্যাক বলছেন যে তাদের রাজ্য রাজনীতিতে বামপন্থীরা এখনও প্রাসঙ্গিক তাই মানুষ তাদের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে কিন্তু জাতীয় স্তরে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে না পারার দরুণ তাদের লোকসভা নির্বাচনে ফলাফল খারাপ হচ্ছে।
এটা চিন্তার বিষয় যে সেন্ট্রাল পলিটিক্সে বামপন্থীরা নেই। যবে থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণ বামেদের সমর্থন ভিত্তিকে নষ্ট করে জনতা ঘরানার পার্টিগুলোর জন্ম দিলেন, তবে থেকেই বামেরা কোণঠাসা। জেপি ঘরানার দুর্নীতিগ্রস্থ, নীতিহীন পার্টিদের সমর্থন ভিত্তি বিজেপি অচিরেই খেয়ে ফেলছে। কিন্তু বামপন্থীরা নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষয়ের বিনিময়ে তাদের সাথেই বারবার জোট করছে।
এবার আসি রাজস্থানের প্রসঙ্গে। রাজস্থানে ২০১৮ সালে বামপন্থীরা দুটো আসনে জিতেছিল কিন্তু তারপরে জাতীয় কংগ্রেসের জনবিরোধী রাজনীতি (যেমন ইলেক্ট্রিসিটি দুর্নীতি ইত্যাদি) নিয়ে আন্দোলন করার সদিচ্ছা না দেখানোয় সমগ্র বিধায়ক সংখ্যা ২০২৩ সালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের কৃষক আন্দোলনের লড়াইয়ে ভূমিকার ভিত্তিতে তারা আবার একজন এমপি পেয়েছে। ফলে বামপন্থীদের নিজেদের লড়াই থেকেই নির্বাচনী জয় এসেছে। বিহারে মহাগাটবন্ধন কেন জিততে পারছে না সেটা একটা প্রশ্ন। বিহারে একটি বাম দল কিছু আসনে বিজয় লাভ করে পশ্চিমবঙ্গের বাম আন্দোলনকে ধ্বংস করে তার লাশের উপর দাঁড়িয়ে বিহারে নিজেদের সাংগঠনিক পুষ্টির কথা ভাবছে। তাদের এ রাজ্যে প্রো-তৃণমূল অবস্থান সকলেরই জানা এবং অবশ্যই তা ন্যক্কারজনক। তামিলনাড়ুতে বামেরা জোট করে বিভিন্ন ওয়ার্কার্স বেল্টে তাদের সাংগঠনিক বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও এখনো বামপন্থীদের ডিএমকে-র পিছনে কেন চলতে হচ্ছে, তা ভাবা প্রয়োজন।
একটা প্রশ্ন ওঠে বারবার যে বামপন্থীরা নির্ণায়ক কোনও কাজ করতে পারবে কিনা নির্বাচনের সময়। উত্তর হল, ইলেকশানের সময় বামেরা কোনো নির্ণায়ক কাজ করতে পারবে না, কারণ আদতে তাদের কোনো সংগঠন নেই। তাই জোড় করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা করতে তৃণমূল কংগ্রেস বা জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে কাউকে জোটসঙ্গী হিসেবে বাছাই করে আদতে কোনও লাভ নেই। কারণ ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্যেই নিহিত আছে। ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশের বড় পুঁজিপতিদের সমর্থন বিজেপির দিকেই রয়েছে। কিন্তু এই বন্ড থেকে লক্ষ্মীলাভের নিরিখে তৃণমূল এবং কংগ্রেস রয়েছে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে। বন্ডের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক পুঁজিপতিরা তৃণমূলকেই অর্থসাহায্য করছে! যেসব বড় পুঁজিপতিরা আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির সাথে বেশি মাত্রায় সম্পর্কিত, তারা বিজেপিকে অর্থসাহায্য করছে। আর আঞ্চলিক পুঁজিপতিরা তৃণমূলকে সমর্থন করছে। এই যে পুঁজিপতিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে, তার ফলেই তৃণমূল-বিজেপির লড়াই দেখতে পাচ্ছি আমরা। তাই বামেরা জোট বা 'নো ভোট টু...'-গিরি করুক আর না করুক, ডানপন্থীদের মধ্যেকার লড়াই নিজ গতিতেই চলবে।
ডানেদের নিজেদের মধ্যেকার এই লড়াইয়ের ডাইনামিক্স কিন্তু বিচিত্র! তৃণমূলের হাত ধরেই এ রাজ্যে বিজেপির আগমন। কিছু তৃণমূল বিধায়ক আরএসএস-এর মেম্বার। অভয়ার মর্মান্তিক ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ায় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা, যাদবপুরের ঘটনায় এবিভিপির বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা... লিস্ট বিশাল। তৃণমূলের দুর্নীতির খবর কোনো সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করতে চাইছে না কিন্তু যারা তৃণমূল বিরোধী কথা বলছে, যেমন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বা তৃণমূলের দুর্নীতির খবর দেখাচ্ছে, যেমন রিপাব্লিক টিভি, এরা দিনের শেষে বিজেপির বাহিনী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করছে। রিপাব্লিক টিভি আজ বাম ছাত্রদেরকে টেরোরিস্ট বলে দেগে দিচ্ছে, গুন্ডাগিরি করছে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে।
এবার আসি আন্দোলনের প্রসঙ্গে। কারণ বাম ঐক্য তো শুধু নির্বাচনী লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয়। আন্দোলনগত ঐক্য তৈরী বাম ঐক্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তার আন্দোলনকে জোরদার করা প্রয়োজন। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সফল হয়েছে। কিন্তু ভারত জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন এখনো অনেক পিছিয়ে। শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নরা কংগ্রেস এবং অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এসেছে। ফলে শ্রমিকরা বাম-ডান স্পেকট্রামের বাইরে গিয়ে লড়াই করে আসছে। কিন্তু এই স্পেকট্রাম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করে বামেরা আদতে কতটা লাভবান হতে পারে, সেই প্রশ্ন একসময়ে তুলে গিয়েছেন কমরেড পুচলাপল্লী সুন্দরাইয়া।
সময়ের ফেরে বিভিন্ন পরিস্থিতির নিরীখে একটা প্র্যাগম্যাটিক পোজিশন হিসেবে আমাদের ভাবতে হচ্ছে এই বাম ঐক্যের কথা। এই যে যাদবপুরের ঘটনা, শিক্ষামন্ত্রীর কনভয় পিষে চলে যাচ্ছে ছাত্রকে, তার বিরুদ্ধে বিপরীত ধারার বাম রাজনীতি করা লোকজন একসাথে আন্দোলন করছে, তারা একে অপরের পাশে থাকছে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অমত থাকা সত্ত্বেও, এখান থেকেও বাম ঐক্যের প্রসঙ্গ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
আমাদের রাজ্যের ছাত্রসমাজের সংস্কৃতি পাল্টাছে এবং তা আরএসএস-এর পক্ষেই যাচ্ছে। মানুষ কত সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে যে ছাত্র রাজনীতির কিই বা প্রয়োজন, ছাত্রদের অধিকার বলে আদৌ
কি কিছু দরকার? সমাজে ডানপন্থী মতধারার প্রাবল্য দেখা যাচ্ছে, যা পাল্টানো প্রয়োজন। লড়াই মানে কি আদি অনন্তকাল ধরে 'নয়াউদারবাদ নিপাত যাক' বলে যাওয়া? নাকি
সত্যিকারের নিপাত যাবার ব্যবস্থা করা? তাই বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রশ্নকে পুরোপুরি
ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধু 'ঐক্য চাই' বললেও মুশকিল। বৈপ্লবিক রূপান্তরের ভাবনাও যে
গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
আরএসএস-এর মতাদর্শের বিরোধিতা করা প্রয়োজন। তারা যে বিকৃত ইতিহাসের প্রচার করে তার বিরোধিতা প্রয়োজন। ভারতের আম জনতার ইতিহাস অধ্যয়ন এবং ইতিহাসের বহুশৈলিক চরিত্র অনুধাবন করা প্রয়োজন। ওরা বলে, আমরা যদুনাথ পড়ি না। কিন্তু যদুনাথ সরকারের লেখা ভালো করে পড়লে দেখা যাবে ওদের সব বক্তব্যই খন্ডিত হচ্ছে।
দরকার ধর্মসংস্কারের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা; হিন্দু-মুসলিম উভয় ক্ষেত্রেই। লিবারেশান থিওলজি গরীব মানুষকে একত্র করতে সহায়তা করেছে গোটা ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে। থমাস আইজ্যাক আক্ষেপ করে বলছেন যে কেরালাতে লিবারেশন থিওলজির প্রভাব ক্যাথলিক চার্চের উপর একেবারেই নেই। কিন্তু আমাদের দেশে একেবারেই এ প্রবণতা দেখা যায়নি তা নয়। স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী থেকে শুরু করে স্বামী অগ্নিবেশ... বাংলাদেশে ছিলেন মৌলানা ভাসানী। ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে ধর্মের গণতন্ত্রীকরণ অর্থাৎ কথ্য ভাষায় মন্ত্র পুনর্লিখন, মেয়েদের ও বর্ণ নির্বিশেষে পুজোর অধিকার ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে ধরতে হবে। রিফর্ম না হলে রেভোলিউশান ব্যর্থ হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সমস্ত মানুষকে ধর্মীয় ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। বামপন্থী সদস্যদের মধ্যে ভাববাদের বিরোধিতাও বজায় রাখতে হবে। উভয় কাজই করতে হবে। একইসাথে আরএসএস যেভাবে শিশুমনকে প্রভাবিত করে চলেছে, তা রোখার প্রয়োজন আছে। ফলে আমাদের শিশু মনের কাছে পৌঁছতে হবে। তাদেরকে সেনসিটাইজ করতে হবে। যেমন, একটা পদ্ম ফুল সৌন্দর্য শুভ্রতার প্রতীক, আবার একটি নির্দিষ্ট আদলে সেই পদ্মই কিন্তু উগ্রতারও প্রতীক।
আমরা বাম ঐক্যের কথা যখন বলছি, তা নির্বাচন এবং/বা আন্দোলনগত যাই হোক না কেন, দিমিত্রভ থিসিসের প্রসঙ্গ আসবেই। উল্লেখ্য, দিমিত্রভ থিসিস প্রয়োগ হয়েছিল একটা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। আর দিমিত্রভ থিসিস যে সবসময় জয় এনে দিয়েছে তাও নয়। তবে মূলগতভাবে জয় এসেছিল। তাতে করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশ্বের বৃহদাংশ রক্ষা পেলেও পর্তুগাল, স্পেন রক্ষা পায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন জিতল ঠিকই কিন্তু মার্কিন ও ব্রিটিশ চাপে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষতি হয়ে গেল।আর পপুলার ফ্রন্ট তৈরি করতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর লড়াইকে শক্তিশালী করতে। সেই নিরিখে আজকের দিনে কংগ্রেস বা তৃণমূলের সাথে জোট বা ঘোঁট করে তা সম্ভব হচ্ছে কি? তাছাড়া ফ্যাসিবাদের পূর্ণ উত্থান কি হয়ে গেছে? আমরা CSA-এর তরফে মনে করি তা উত্থান পর্বে আছে কিন্তু পূর্ণ উত্থান এখনও হয়নি। তবে আমাদের ৪০-৫০ বছর আগের ফ্যাসিবাদের ধারণা নিয়ে চললে হবে না। পুঁজিবাদের চরিত্র সংকট অনুযায়ী পাল্টানোর সাথে সাথে ফ্যাসিবাদের চরিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর ফ্যাসিবাদের চরিত্র নির্ভরশীল। আজকের ফ্যাসিবাদের উৎস হল নয়াউদারবাদী সংকট। এই অধ্যয়ন সমস্ত বামপন্থীদের করা প্রয়োজন। এই অর্থনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হল ভবিষ্যৎ নির্ভর ফাটকা কারবার। আমরা এগুলো নিয়ে এখনো কথা বলি কম। বাম আন্দোলন এখনো অ্যানালগ মোডে রয়েছে, তাকে ডিজিটাল মোডে শীঘ্রই আনতে হবে। শেয়ার মার্কেটের ধ্বস থেকেই যে অর্থনৈতিক সংকটগুলো আসছে এবং সেটাই ফ্যাসিবাদের উত্থানকে বিশ্বজুড়ে ত্বরান্বিত করছে, তা অনুধাবন করতে হবে। মার্কিন মুলুকের মানুষজন শেয়ার মার্কেট নিয়ে বেশি সেনসিটাইজ হওয়ায় সেখানে ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন হয়েছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোক এতকাল এ বিষয়ে অবগত ছিল না। কিন্তু এখন তো শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের মুখে একটাই কথা, যতক্ষণ মোদী সরকার রয়েছে, শেয়ারে ধ্বস নামবে না। যদিও তাদের এই সুখের স্বর্গ কতদিন টিকবে সেটাই এখন দেখার মত বিষয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি সহ সমস্ত ক্ষেত্রেই সরকার যখন হাত তুলে নিচ্ছে মিতব্যয়িতার উদ্দেশ্যে, তখন অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্টমেন্টকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফাটকা কারবারে নামাতে আন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ জাতীয় গালভরা শব্দ নিয়ে আসা হচ্ছে। এসবই নয়াউদারবাদী অর্থনীতির জাঁতাকল। আজকের বেকারত্ব যেহেতু এই ফাটকা কারবারের জন্যই সারা সমাজে বিস্তৃত হচ্ছে, বেকারত্বও তাই অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল মোডে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ তার নিজের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না। দেশে এই কর্পোরেটবান্ধব নয়াউদারবাদের কান্ডারী মোদী আর রাজ্যে সেই একই কাজ করছে তৃণমূল।
ডান এবং উগ্র ডান তাদের নিজ আদর্শে অটুট। নিজেদের আদর্শগত জায়গা ধরে রাখার জন্য একনাথ শিন্দে লিবারাল জোট থেকে শিবসেনার এক খন্ডকে বের করে এনে উগ্রডানপন্থী জোটে ঢুকিয়েছে। তারা পারছে তাদের আদর্শে স্থির থাকতে, আমরা কেন পারব না? আমাদেরও পারতে হবে। একটা প্র্যাগম্যাটিক অ্যাপ্রোচের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে বামপন্থী আন্দোলনের অবস্থা খারাপ হলেও গ্রীসে তো সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। আমাদের দেশে হবে না কেন? আমরা কেন পারছি না, তা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন নিবিড়ভাবে। অভয়ার ন্যায়বিচারের আন্দোলনে জনতার অংশগ্রহণকে সংগঠিত শক্তিরা দিশা দিতে পারল না কেন? কেন তা উত্তর-আধুনিক স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকশিত হল? এ বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
রাস্তার আন্দোলনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহচর্য বাড়াতে হবে। সামাজিক এবং শ্রমিক ফ্রন্টের আন্দোলনের ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন কোন সাফল্য নেই। সাফল্য না আসতে আসতে পরাজয় আমাদের কাছে নর্মালাইজ হয়ে উঠেছে। তাই প্রাথমিকভাবে ছোট ছোট আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী ছিনিয়ে আনা খুব প্রয়োজন। তার জন্য দরকার বাম ঐক্য। আমাদের নিজেদের কর্মীদের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বাম ঐক্য জরুরি। বিভিন্ন বাম মহলের সকলের মধ্যে কালচারাল কো-অর্ডিনেশান প্রয়োজন যার মাধ্যমে একে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে আন্দোলনগত জায়গায় একে অপরকে সাহায্য করে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা যায়। একইসাথে অল্টারনেটিভ মিডিয়াদের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান ও মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন। যাদবপুরের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিভিন্ন ধারার বাম পড়ুয়ারা যখন একত্রিত হয়ে লড়াই করছে, তাদেরকে একত্রে দেখে ডানেদের বুকে ভয় ধরেছে।
বিভিন্ন বামপন্থীদের ঐক্যের কথা যে আমরা বলছি, প্রত্যেকটি বামপন্থী দলই শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি। ফলে এই বাম জোটে কুলীন শ্রমিক এবং অসংগঠিত শ্রমিক একইসাথে থাকবে। শ্রমজীবীদের মধ্যেকার বিভিন্ন অংশের ঐক্যই এই বাম ঐক্যের শ্রেণী অভিমুখ। ঠিকই, সাময়িক সমঝোতা। এই ঐক্যের মধ্যে টানাপোড়েন থাকবে কারণ কুলীন শ্রমিক আর অংসগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের স্বার্থ অনেকক্ষেত্রেই পরস্পরের পরিপন্থী। তাই বাম ঐক্যে বেশ কিছু বাধাও রয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে সামগ্রিকভাবে শ্রমজীবী রাজনীতি যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত, তাকে পুনরায় জাগরিত করে তুলতে বাম ঐক্যের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমাদের পারস্পরিক ভুল ত্রুটি স্বীকার করতে হবে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের পলিসির বিরোধিতা থাকবে, কেরালায় আদানীকে পোর্ট বেচার বিরোধিতা থাকবে, আবার একসাথে লড়াইয়ের বার্তাও থাকবে। ছোট দলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার, স্বজনপোষণ ও কাল্ট প্রবণতার বিরোধিতা থাকবে। কেউ নির্বাচনে থাকবে না, আন্দোলনে থাকবে। কেউ দুটোতেই থাকবে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐক্য থাকবে, যুদ্ধ বিরোধী ঐক্য থাকবে, প্যালেস্তাইনের জনতার অধিকারের পক্ষে ঐক্য থাকবে। অন্য দেশের সহযোগী বামেদের প্রতি সমর্থন ও সমালোচনা উভয়ই থাকবে। আন্তর্জাতিক তৈরির প্রচেষ্টা জারী থাকবে। আন্দোলনের মাঝে প্রত্যেকের দলীয় স্বার্থ থাকবে, আবার সেই স্বার্থের মাঝেও ঐক্য থাকবে। কোন একক প্রচেষ্টায় আর তরী পার করা যাবে না। লাগবে যৌথ প্রচেষ্টা...
Picture Courtesy: The Economic Times
Comments
Post a Comment