চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরীর আন্দোলনঃ একটি সাক্ষাৎকার

চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী বিষয়ক দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করে সরকার ও মালিকপক্ষের টালবাহানার প্রতিবাদে গত ২৩শে জুলাই, ২০১৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল 'জয়েন্ট ফোরাম', যার মধ্যে ২৯টি ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যভুক্ত। কিন্তু ১৭ই জুলাই রাজ্যের শ্রম কমিশনারের অনুরোধে ধর্মঘট স্থগিত রাখা হয় সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন করতে যাতে সময় পায়। কিন্তু ন্যূনতম মজুরী ১৭২ টাকা থেকে একচুলও নড়তে রাজি হয় না সরকার। ২০১৫ সাল থেকে চা বাগান শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি নিয়ে লাগাতার বৈঠক হলেও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। ৩০শে জুলাই-এর ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে দেখা যায় সরকারের ভূমিকা শ্রমিকদের অনুকূলে যাচ্ছে না। সরকার আবার ৬ই আগস্ট ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ডাক দেয় কিন্তু তাতেও কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি। ১৭২ টাকা ন্যূনতম মজুরী ধার্য করার প্রশ্নে সরকারের অনড় মনোভাবই  শ্রমিক স্বার্থের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, চা শ্রমিকরা ৭, ৮ এবং ৯ই আগস্ট, ২০১৮, ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৬ই আগস্ট সরকার মালিক পক্ষের সাথে মিটিং-এ বসে। ওরা নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ১৭২ টাকা বলা ভুল হয়েছে; ফলে ইন্টারিম মাত্র ১০-১৫ টাকা! 



১২ই আগস্ট, ২০১৮ 'দা ডিলিজেন্ট'-এর পক্ষ থেকে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের গতিপথ সম্পর্কে জানতে একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকার দেন কমঃ সমীক চক্রবর্তী, জয়েন্ট কো-অর্ডিনেটার, 'চা বাগান সংগ্রাম সমিতি'।

  
চা শ্রমিকদের সরকার কোন ধরণের শ্রমিক হিসেবে গণ্য করে- কৃষিশ্রমিক নাকি শিল্পশ্রমিক?
কৃষিশ্রমিক হিসেবেই ধরা হয়, কিন্তু 'জয়েন্ট ফোরাম' এবং আন্দোলনকারী ইউনিয়নগুলির বা আমাদের তথা এই আন্দোলনের মূল দাবি শিল্পশ্রমিকের মর্যাদা আদায় করা।
শ্রমিকরা ও তাদের পরিবারগুলি চিকিৎসার কতটা সুযোগ সুবিধা পায়?
প্রতিটা চা বাগানেই আইন অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উপযুক্ত পরিকাঠামো থাকার কথা। কিন্তু সবজায়গায় নেই, অনেক বাগানে তো MBBS ডাক্তারও নেই।পরিকাঠামো থাকলেও, ডাক্তার নেই। আবার কিছু বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা এতোটাও খারাপ না, ওখানে ডাক্তার অন্তত আছে। 2013-14 সালে প্রকাশিত এক সরকারি রিপোর্টে এই পরিস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন বাগানে বিভিন্ন মালিক তথা কোম্পানির উপর নির্ভর করে সার্বিক পরিস্থিতিটা।
কৃষিশ্রমিক দের সরকারীভাবে ধার্য্য ন্যূনতম দৈনিক  মজুরি তো এখন ২৪৪ টাকা। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকদের বর্ধিত ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ১৭২ টাকায় অনড় সরকার। সরকার যদি কৃষিশ্রমিক হিসেবে তাদের চিহ্নিতই করেই থাকে, তাহলে এই দ্বিচারিতা কেন?
সরকার এদের কৃষিশ্রমিক হিসেবে ধরলেও তাদের দৈনিক মজুরি থেকে 'Fringe benefits'-গুলো বাদ দিয়ে তাদের দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করতে চাইছে। Fringe benefits বলতে বোঝায়, এঁরা মাইনে ছাড়াও বাকি যে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন সেগুলো, যেমন ছাতা, জুতো, ঘর রিপেয়ারিং ইত্যাদি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আগে দৈনিক মজুরি ঠিকঠাকভাবে হিসেব হয়ে তারপর সেখান থেকে এইসব পাওনা জিনিস বাদ দিয়ে দৈনিক মজুরির হিসেব হওয়ার কথা। কিন্তু যে প্রস্তাব সরকারের কাছ থেকে এসেছে, সেই দৈনিক মজুরীর পরিমাণও খুবই কম। ২১০০ ক্যালোরি খাবার, বা অন্যান্য যেসমস্ত মিনিমাম ক্রাইটেরিয়া দৈনিক মজুরি নির্ধারণে নির্দিষ্ট করা হয়েছে পঞ্চদশ লেবার কনফারেন্স বা সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯২ সালের রায় থেকে, জয়েন্ট ফোরামের সেইসব ভিত্তিতে করা হিসেব থেকে দেখা যায়, শুধু খাবারের জন্যই মজুরী হওয়ার কথা ২৩৯ টাকা। এছাড়াও অন্যান্য দিকে বিচার করলে মোট হিসেব করে দৈনিক মজুরী দেখা গেছে যা তা প্রস্তাবিত মজুরীর প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এসব কিছুই এখনো প্রস্তাবিত। মিটিং হবার কথা আছে, ২০ তারিখ, ওদিন হয়তো কিছু ঠিক হবে।
ধর্মঘট কি এখনো চলছে?
না, ধর্মঘট তো মাত্র তিনদিনের ছিল। ৭, ৮, ৯-এই তিনটি দিন। তরাই ডুয়ার্সে সার্বিক বন্ধ আর পাহাড়ে 'তৈরি চাপাতা' রপ্তানী বন্ধ রাখা, এই ছিল প্রধান আজেন্ডা এবং বন্ধ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সফল বলা চলে।
বর্তমানে আপনাদের সম্ভাব্য পদক্ষেপ কি?
আমরা, মানে আমি যে সংগঠনে যুক্ত সেটির নাম 'চা বাগান সংগ্রাম সমিতি'। আমরা একটি নাগরিক সংগঠন, আমরা জয়েন্ট ফোরামের সদস্য নই, কারণ আমরা ইউনিয়ন নই কোনো। আমাদের সঙ্গে শ্রমিকরাও যেমন আছেন, সেরকম শ্রমিক নন এমনও বহু মানুষ আছেন। জয়েন্ট ফোরামে শাসকদলীয় চা শ্রমিকদের ইউনিয়ন ছাড়া বাকি যে শ্রমিক ইউনিয়নগুলি আছে সেগুলো, আর আমরা ওই আন্দোলনে পাশাপাশিভাবে ওদের সমর্থনে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছি, বিভিন্নভাবে সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছি। আন্দোলনের মূল হোতা কিন্তু ইউনিয়নগুলোর জয়েন্ট ফোরাম। মুভমেন্টের কোর্স ঠিক করছে তারাই।আমরা বিভিন্নভাবে মিটিং মিছিল ইত্যাদির দ্বারা ওদের সমর্থন জানাচ্ছি। দাবী একটাই, ঠিকঠাক 'মিনিমাম ওয়েজ' ঘোষণা করা হোক। কোনোরকম গোঁজামিল দিয়ে কিছু করা, যেমনটা এখন প্রস্তাবিত মিনিমাম ওয়েজে হয়েছে, তেমনটা যেন না হয়। ১৩ তারিখ একটা সরকার-মালিক-শ্রমিকপক্ষ ত্রিপাক্ষিক মিটিং হবার কথা ছিল, কিন্তু সেটা কোনো কারণে বাতিল হয়েছে। ২০ তারিখে একটা মিটিং আছে, সেটায় হয়তো কিছু সুরাহা হবে, বা অন্যত্র কোনো মিটিংয়ে হবে সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে যে সরকারের সঙ্গে মালিকপক্ষের মিটিং একটা হবে, এবং তারপরেই সরকার তাদের ডিসিশন ঘোষণা করবে।
আপনাদের এখানে শাসক দলের যে শ্রমিক ইউনিয়ন, তারা এই আন্দোলনে কিরকম ভূমিকা রাখছে?
তারা তো আন্দোলনের বিরোধিতাই করছে; স্বাভাবিকভাবেই বন্ধের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও, তাদের ইউনিয়ন যেখানে মেজোরিটি, সেখানেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়েছে।
শাসকদলের ইউনিয়নও তো শ্রমিক সংগঠন। তারা এই আন্দোলন নিয়ে কি বলছে? 
তারা সরকারের মতামতেই সায় দিচ্ছে। কিন্তু ন্যূনতম মজুরির দাবিটা এতটাই সর্বজনীন, তারাও এইটা মানতে বাধ্য হয়েছে। তারাও বলছে মিনিমাম ওয়েজ চাই, কিন্তু মিনিমাম ওয়েজ কত, সেটা নির্ধারণ হবে কিভাবে, সেইখানে তারা কোনোভাবেই সরকারের সঙ্গে বারগেনিং-এর জায়গাতে নেই। আর তারা কি বলছে সেটা তো তারাই ভালো বলতে পারবে। সরকারের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকবার ইনফর্মাল মিটিং হয়েছে এবং সেগুলো তাদের দলীয় মিটিং হিসাবেই ধরা যায়।
আপনাদের সঙ্গে কি সরকারপক্ষ কোনোরকম আলোচনায় এসেছে?
না। আমাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো জায়গাতেই সরকার আসবে না। সরকার তো ত্রিপাক্ষিক মিটিং করবে, সরকারপক্ষ, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষকে নিয়ে। আমরা সাধারণভাবে ওদের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনে যথাসম্ভব চেষ্টা করছি।
মহারাষ্ট্রে কৃষক আন্দোলনের পর সংগঠিতভাবে শ্রমিকদের খুব বড় আন্দোলন বলতে এই চা শ্রমিকদের আন্দোলন।এই সংগঠিত আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বৃহৎ সংগঠিত মেহনতি শ্রেণী সংহতি নিয়ে আপনারা কি ভাবছেন?
শ্রমিকরা চিরকাল বঞ্চিত, সমস্যাও প্রচুর আছে। কিন্তু, আপাতত আমাদের সামনে এই ন্যূনতম মজুরির বিষয়টিই প্রধান। এটা মিটলে পরবর্তী ইস্যুগুলো নিয়ে এগোনো হবে।
আন্দোলনের কোর্স বা গতিপথ নিয়ে আপনার কি মতামত?
আন্দোলনটা যে সর্বজনগ্রাহ্য সেটা এই স্ট্রাইকের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত। শ্রমিকরা তাদের ক্ষোভ জানিয়েছে, সরকারের প্রস্তাবনার বিরোধিতা করেছে, এবার সরকার কি স্টেপ নেয় সেটাই দেখার। একটা সমাধান এলেই যে সেটা সঙ্গে সঙ্গে লাগু হয়ে যাবে সেরকমও না, ব্যাপারটা নিয়ে একটা জায়গায় একমত হলেও তারপরেও আলোচনা চলবে সেটার পরিস্থিতির উপর ও আগামী ভবিষ্যতে প্রভাব কিরকম পড়বে তা নিয়ে।
এই আন্দোলনের মূল ইস্যু তো ন্যূনতম মজুরি। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছাড়াও আর কোন কোন বিষয়কে আপনারা তুলে ধরছেন?
এক তো হচ্ছে যে Fringe benefits যেগুলো, সেগুলো তো অধিকাংশ বাগানেই শ্রমিকরা ঠিকঠাক ভাবে পান না। কিছু কিছু জায়গায় পেলেও বহুদিনের বঞ্চনার পর একটু আধটু। তা ছাড়াও পিএফ, গ্রাচুইটি ও অন্যান্য বঞ্চনার বিষয়গুলোর লম্বা ইতিহাস আছে। এর পাশাপাশি রয়েছে বন্ধ বাগানের সমস্যা, প্রায় পঁচিশ বা তার থেকেও বেশি সংখ্যক বন্ধ বাগান রয়েছে, সেগুলোকে খোলার ব্যবস্থা করতে হবে, সেইসব বাগানের শ্রমিকদের প্রাপ্য ঠিকঠাক দিতে হবে। এইসবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত।
আপনি তো এখানে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত, এখানে আপনি আছেন ও বেশ কিছুটা সময় ধরে। আপনার কি মনে হয়, এখানে আন্দোলনের ক্ষেত্রে বা আন্দোলনের ক্ষেত্র ছাড়াও বাকি ক্ষেত্রে বিজেপির বা সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব কি বাড়ছে?
খুব বেশি বাড়েনি, তবে বেড়েছে, অল্প হলেও বেড়েছে। বিভিন্ন শেড এ বেড়েছে। কিন্তু আন্দোলনের ক্ষেত্রে বা চা বাগানের পরিবেশের উপর তার কোনো এফেক্ট পড়েনি তেমনভাবে।
এই বৃদ্ধি কি চাবাগানের ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেছে?
না, ধর্মীয় সম্প্রীতিতে কোনো প্রভাব পড়ছে না। বাগানগুলোতে সেইরকম কমিউনাল টেনশন নেই। বাগানের আন্দোলনের সঙ্গে তো হিন্দু মুসলমান কমিউনাল টেনশনের কোনো ডাইরেক্ট যোগাযোগ নেই। ওদের বৃদ্ধিও সিগনিফিক্যান্ট কিছু না।

সাক্ষাৎকারটি 'দা ডিলিজেন্ট'-এর পক্ষে নিয়েছেন ঋচীক আশ। 
Photo Courtesy: Chaaybagan Sangram Samity 


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার