ঊনিশের ভোটে ঈশ্বরচন্দ্র



বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত

কোথায় যেন পড়ে ছিলাম , --ঈশ্বরচন্দ্র সিমলা পাড়ার দিকে যাবেন । নিজের কোনও কাজে । পরিচিত একজন শুভানুধ্যায়ী সেটা জানতে পেরে উপযাচক হয়ে তাঁকে সতর্ক করতে এসেছেন । বলছেন , ওদিকে যাবেন না । খবর পেয়েছি , ঠনঠনের কাছে কিছু লোক জড়ো হয়েছে আপনাকে মারবে বলে । শুনে , বিদ্যাসাগর খানিক চুপ করে থেকে তাকে বললেন , ও-দিকের কোন লোকের উপকার করেছি বলে তো মনে পড়ছে না । তা-হলে মারবে কেন । 

বিদ্যাসাগরকে এতে রোখা গিয়েছিল না । তিনি যথানিয়মে তাঁর কাজে গিয়ে ছিলেন । এবং ফিরেও এসে ছিলেন অক্ষত । তাঁর জেদ আর সাহস নিয়ে অনেক কিংবদন্তি রচনা হয়েছে । সে সব কাহিনি আধুনিক কালের অ্যাডভেঞ্চারের পাঠকপ্রিয় গল্পের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই ।

অবাক হয়ে যা দেখলাম আজ , দেড়শ’ বছর আগের সেই দুর্বৃত্তরা এখনও তাক্ করে আছে , কবে ঠনঠনিয়ায় এ পথে বিদ্যাসাগর যাবেন । এলেই তাঁর মাথা গুঁড়োনো হবে ।

বিদ্যাসাগর রামমোহন রবীন্দ্রনাথ এঁরা প্রত্যেকে নিজের নিজের সমাজে ছিলেন একা । ব্রাত্য । নির্বান্ধব । এঁদের একজনও নিজের নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য লালায়িত ছিলেন না । তাতে-ও সমাজ এঁদের তিন জনের এক জনকেও রেহাই দেয় নি । পদে পদে হেনস্তা করে ছেড়েছে । রামমোহনের কথা জানি না । বাকি দু’জনেই শেষ জীবনে হতাশ হয়েছেন । অশ্রু মোচন করেছেন, দরিদ্র অশক্ত সহায়হীন অশিক্ষিত সর্বোপরি অশিক্ষা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জনতার গরিষ্ঠ অংশের মানুষের জন্য ।
ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যু ১৮৯১ সালে । সংস্কার আন্দোলনের শক্তিশালী সর্বশেষ নেতা । ১৮৮৬-তে জন্ম জাতীয় কংগ্রেসের । জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনকে আঁতুরে দেখে গেছেন বিদ্যাসাগর ।
বাংলা তথা ভারতে এর পরের সকল আন্দোলনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন । সে-ও আজ একশ’ত্রিশ বছরের বেশি প্রাচীন ।



জাতীয় নির্বাচনের শেষপাদে এসে স্বয়ং বিদ্যাসাগর ভোটে দাঁড়িয়ে গেলেন । ঠনঠনেতে তাঁর নিজের গড়া ইস্কুলে তাঁর মাথা গুঁড়োনো হল । আর চার দিক থেকে রে রে করে ছুটে এলেন রাজনীতির জগতের তাবত সৈন্যবাহিনি । ঊনিশ তারিখের ভোটারের কাছে তুরন্ত্ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন , --- আপনি এই ঘটনার পক্ষে না বিপক্ষে । আপনি কে । না , ভোটার । ভোটার কে । তিনি – দিনমজুর বস্তিবাসী ফুটপাতবাসী । হকার ছোট দোকানী । দালাল ফড়ে চাষী । কারখানার শ্রমিক বন্ধকারখানার মজুর । ফেরিওয়ালা মাদারি চিট । পকেটমার দেহপসারিনী । কৃষক ক্ষেতমজুর ।, বাউল ভিখারী ফকির । আরও আছে , --বাড়িওয়ালা গাড়িওয়ালা হোটেলওয়ালা । রিক্সা অটো টোটো লরি ভ্যানওয়ালা । আছে , পুলিস সান্ত্রী চৌকিদার । ষন্ডা গুন্ডা মস্তান ।

এখন প্রশ্ন --- বিদ্যাসাগরের ভগ্ন পাথরের মস্তকের সঙ্গে এ সকল মানুষের জীবীত মাথার সম্পর্ক কী এবং ঊনিশের ভোটের সঙ্গে তার যোগ কী ।

আরও আছেন । তাঁরা এক কথায় বুদ্ধিজীবী । এর মাঝে আছেন --- শিক্ষক উকিল মোক্তার ডাক্তার লেখক কেরানী অফিসের বাবু সঙ্গে আছেন , গায়ক বাদক নর্তক অভিনেতা অভিনেত্রির দল । এঁদের সঙ্গেই বা বিদ্যাসাগরের দৈনন্দিন সম্পর্ক কী ।

অতএব প্রশ্ন – এ উত্তেজনায় কা’র ক্ষতি বা কা’রই বা লাভ ।

এক দিন দেশের প্রভূত উন্নয়ন সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র উল্লাস প্রকাশ করতে পারেন নি , হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের দুর্দশার কথা ভেবে । আজকের এই কৃত্রিমশোকে সামিল হতে পারছি না । বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশ’ বছর পরেও সাধারণ মানুষের লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করে , যে দুর্গতি মোচনের জন্য সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছেন  বিদ্যাসাগর । 



Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার