ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

অনন্যা দেব 


বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় নার্সিং পড়তে আসা হোস্টেলে বসবাসকারী জনৈক ছাত্রীর একটি ফেসবুক পোস্ট ছিল - "আজ পাঁচ বছর কলকাতায় আছি, কখনো রাত আটটার পর কলকাতার আকাশ দেখিনি"। অর্থাৎ তাকে হস্টেলে ফিরতে হত গুনে গুনে রাত আটটার মধ্যে। এই বক্তব্য থেকে সহজেই অনুমেয় রাতের আকাশ মেয়েদের জন্য আজও অধরা। জরুরি বিভাগ,কর্পোরেট সেক্টর সহ শ্রমজীবী নারীদের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ প্রমুখ কর্মক্ষেত্রে প্রচুর সংখ্যক মহিলা বর্তমানে শ্রম দান করলেও মহিলাদের নিরাপত্তা যে আজও অন্ধকারেই রয়ে গেছে, তার হাজার উদাহরণের মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া আরজিকরের চিকিৎসক তরুনীর নৃশংসতম ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাটি অবশ্যই থাকবে। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সুরক্ষা প্রদান ও নিরাপত্তা বিষয় সংক্রান্ত যে আইনগুলি রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইনটি হল বিশাখা কমিশান। যদিও তা কতটা খাতায় কলমে আর কতটা বাস্তবিক প্রয়োগে রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। এরপর ফিরে আসি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত থাকা মহিলাদের কথায়। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় মহিলা চিকিৎসক, নার্স, আয়াদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ, পরিষ্কার বাথরুম সহ মহিলাদের অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধাগুলির যে ছিটেফোঁটাও নেই, তা পশ্চিমবঙ্গে খুবই স্পষ্ট। নিরাপত্তা তো অনেক পরের বিষয়। বলা বাহুল্য, চিকিৎসার মতন কৌলিন্য পেশা ছাড়া অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও অবস্থা একইরকম। মহিলাদের যে নিজস্ব দাবীগুলি দীর্ঘদিনের - কর্মসংস্থানে নিরাপত্তা, কাজের জায়গায় মায়েদের জন্য ক্রেশের ব্যবস্থা, পরিষ্কার টয়লেট, স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন  প্রভৃতি - তা নিয়ে আবারও যে লড়াই-আন্দোলন বর্তমানে চলছে, মিছিলে মিছিলে কর্মক্ষেত্রে তথা চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কথা উঠে আসছে যাতে আর একটিও মহিলাকে যৌন নির্যাতনের শিকার না হতে হয় - তাকে সাধুবাদ জানাই।

কিন্তু যে প্রশ্নগুলি থেকে যায় - সাধারণ মানুষ কেন আজও বিশ্বাস করেন, ধর্ষন এবং যৌন নির্যাতন হল পুরুষের লালসা চরিতার্থ করা বা টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটির বহিঃপ্রকাশ ব্যতীত আর কিছু নয়!!

চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বার করি। 

Simon De Beauvoir-এর মতে রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপে মহিলারা হয়েছে দ্বিতীয় লিঙ্গ। পুরুষ যেখানে অ্যাক্টিভ জেন্ডার, মহিলারা সেখানে থেকেছে প্যাসিভ জেন্ডার হয়ে। বিশ্বজুড়ে এই অবস্থার সামান্য কিছু হেরফের আছে বৈকি! কিন্তু এই অবস্থা থেকে আজ অবধি চলা ক্রমবর্ধমান নারীবাদী আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে নারীর চেতনা চেয়েছে মুক্ত হতে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক দিক থেকে। বহুলাংশে আর্থিক উপার্জনের মাধ্যম হয়েছে তার মুক্তির দিশারী। কিন্তু এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা টিকিয়ে রাখার যে প্রয়াস ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলগুলির মধ্যে দেখা যায় তা অত্যন্ত পশ্চাদপদ। পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে অ্যাসিড অ্যাটাকে রয়েছে প্রথম সারিতে। পার্ক-স্ট্রিট, কামদুনি, নদীয়া, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, বারাসাত সবই মাননীয়ার কাছে ছোট্ট ঘটনা হয়ে থেকেছে। আর দেশের সাপেক্ষে কাঠুয়া, হাথরাস, উন্নাও, বিলকিস বানোর ঘটনাগুলি সংখ্যালঘু, নিম্নবর্গের মহিলাদের উপর সহিংস আক্রমনের নির্লজ্জ নিদর্শন হিসেবে পরিগনিত। চিকিৎসক থেকে তরুণ প্রজন্ম - সাধারন মানুষ কি আরজিকর আর রাজ্য/দেশ জুড়ে চলা বাকি নারীদের প্রতি হিংসাত্মক ঘটনাগুলিকে একসূত্রে বাঁধতে পারছেন? এখানেই আসে লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতির প্রশ্ন। যৌন নির্যাতন নিছক পুরুষের পৌরুষত্বের আগ্রাসন নয়, ধর্ষণ হল চিরকালীন মহিলার প্রতি নিক্ষেপিত রাজনৈতিক অস্ত্র। তাছাড়াও এই দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা নাগরিককে শিক্ষা দেওয়ার অস্ত্র হল যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে চালানো হত্যালীলা। যে হত্যালীলা থেকে বাদ পড়ে না পুরুষও (প্রসঙ্গ - কয়েকবছর আগে আরজিকরে এক পুরুষ চিকিৎসকের আত্মহত্যা বা অন্য কিছু)। 

ফিরে আসি আপাতত রাজ্য উত্তাল করা আরজিকর ইস্যুতে!

ঘটনার প্রতিবাদ প্রথমদিকে নারী চিকিৎসকদের রাত্রিকালীন ডিউটিতে নিরাপত্তার বিষয়ে আবিষ্ট থাকলেও দিনদিন সামনে আসছে আরজিকর নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুর্নীতিগ্রস্থ, টাকা দিয়ে মেডিকেলের প্রশ্ন বিক্রি, প্রতিবাদ করলে সেমিস্টারে ফেল করিয়ে দেবার হুমকি সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে আরজিকরের অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে। তাছাড়াও রয়েছে অধ্যক্ষের ইন্ধনে হস্পিটালের কিছু ইন্টার্ন, পিজিটি, জুনিয়ার চিকিৎসক, হস্টেল আবাসিকদের হাত ধরে চলমান ড্রাগ র‍্যাকেট আর সেক্স র‍্যাকেট, যা আরজিকরকে পরিনত করেছে দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে। এই দুর্নীতির আঁতুড়ঘর থেকে টাকা ডাইরেক্ট শাসক দলের পার্টি ফান্ডে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই তথ্যগুলি ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া মারফত ভাইরাল। তরুণীকে হত্যার পিছনে কি রয়েছে এই দুর্নীতি ঢাকার মরিয়া চেষ্টা? তাই কি পুলিশ আন্দোলন দমনে এত তৎপর? তাই কি প্রমাণ লোপাটের এত চেষ্টা? তাই কি শাসক দলের মদতপুষ্ট লুম্পেন বাহিনীর আক্রমণ? সবই তদন্ত সাপেক্ষ, বিচার সাপেক্ষ। কিন্তু সকল দোষীদের শাস্তি না দিলে এই র‍্যাকেটগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং ভেঙে পড়া সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে পড়ুয়া সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে। 

এই বর্বরোচিত নৃশংসতা, এই ক্ষমতার আস্ফালনকে কি শুধুমাত্র নারী নিরাপত্তার প্রশ্নেই আবদ্ধ রাখা হবে নাকি দুর্নীতিগ্রস্থ শাসকের ঘাঁটিকেও প্রশ্নে বিদ্ধ করা হবে? সারা রাজ্য জুড়ে সর্বত্র সমাজ বিরোধী, দুষ্কৃতীদের প্রশাসনিক মহলে দাপিয়ে বেড়ানোকে কি আক্রমন করা হবে?

ইতিমধ্যে ১৪ই আগষ্ট রাত্রিবেলা শহর থেকে শহরতলি, গ্রাম থেকে মফঃস্বল, জেলা থেকে রাজপথ, লক্ষাধিক মহিলা দখল নিয়েছে রাতের। 'অর্ধেক আকাশ'-এর এই রাতের দখল নেওয়া ১৪ই আগষ্টকে পরিনত করেছে একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনায়। এই নারী অভ্যুত্থান তথা গণ অভ্যুত্থানকে  সঠিক রাজনৈতিক অভিমুখ দিতে হবে অচিরেই কারন একমাত্র তাহলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই নারীদের যে পরিনাম যুগ যুগ ধরে হয়ে এসছে, তাকে আটকানো যাবে এবং তরুণী চিকিৎসক মেয়েটি ন্যায় পাবে। এই আন্দোলনে যাতে সমাজের সকল স্তরের, সকল শ্রেনীর নারীর অন্তর্ভুক্তি হয় সেদিকে সচেষ্ট হতে হবে নারীবাদী রাজনীতিকদের। তবেই এই নারী অভ্যুত্থান সফলতার মুখ দেখবে।



Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!