সমাজতান্ত্রিক কিউবার ষাট বছর


বিমলকান্তি দাশগুপ্ত

মেক্সিকো উপসাগরে আমারিকার শ’খানেক মাইল দূরে একটা সবুজ রঙের কুমীর যেন ভেসে আছে। এটা দূর থেকে দেখা। কাছে গেলে দেখা যাবে, সবুজ বনানী। পাহাড় আর কোটিখানেক মানুষের বসতি। একটা দ্বীপ। এই দ্বীপে থাকেন কারা। আছে আদিবাসী রেডইন্ডিয়ান।  ক্রীতদাস আফ্রিকাননিগ্রো আছে দখলকারী স্প্যানিশ আর আছে কিছু আমেরিকানকলোনির বিচ্ছিন্ন ভাগ্যান্বেষী নাগরিক। দ্বীপটার নাম কিউবা। শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা ভুল শুধরে দিয়ে বলেন,  আসলে নামটা হল গিয়ে কুবা। খুব ভালো। এ নাম ওদের খাতায় লেখা থাক। আমাদের মুখের ভুল উচ্চারণে সে যেমন কিউবা ছিল , তেমন কিউবাই থাকবে।


সাধারণ খাবার, ভাত বিন কলা আর চিকেন বা শূয়োরের মাংস। আর সামুদ্রিক মাছ। দেশটিতে পাহাড় আছে বন আছে। মাটির নিচে আছে লোহা কয়লা তামা জিংক ইত্যাদি। নিজেদের চলে যাবার পক্ষে যথেষ্ট। আর আছে গান সাহিত্য আর সংস্কৃতি।
অনেকটা সমুদ্র পার হয়ে আছে ইয়োরোপ। তারই এক দেশ স্পেন। সময়টা দেশ আবিষ্কারের যুগ। আজ থেকে চার শ’বছর আগের কথা। স্পেনের কলম্বাস পালের জাহাজে পারি দিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন। এ গল্প সকলের জানা। কিন্তু তিনি কিউবাও আবিষ্কার করেছেন। এ কথা তত প্রচারিত নয়। ছোট্ট দেশ। তার রূপে গুণে সম্পদে মুগ্ধ কলম্বাস তার রাণী ইসাবেলাকে সে খবর দিলেন।রাণীর অনুমতি পেয়ে শুরু হল কিউবাতে স্পেনের আধিপত্য। বাড়তি শ্রমশক্তির যোগান দিতে আফ্রিকা থেকে নিগ্রোক্রীতদাস সংগ্রহ করা হল।স্পেনের পরিযায়ী শ্রমিক কর্মের সন্ধানে কিউবাতে পারি দিল। কিউবার জনসমাজে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেল। সাদা আমেরিকান, কালো আফ্রিকান, লাল রেড ইন্ডিয়ান সঙ্গে স্পেনের অধিবাসী। কিউবা হল স্পেনের উপনিবেশ। কিউবা হল বহু ভাষা বহু ধর্ম বহু বর্ণের মানুষের সমন্বিত রূপ। কিউবা আধুনিক হতে থাকল। কিউবায় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটতে থাকল। আর ঔপনিবেশিক শক্তি কুমিরের মাংস কুরে কুরে খেতে থাকল।


কান টানলে মাথার দূরে থাকবার উপায় নেই। সে আপনিই এগুতে থাকে। পুঁজি ব্যবস্থার সঙ্গে তেমনই মিল তার। কিউবাতে কারখানা হল। কারখানাতে শ্রমিক হল। মধ্যবিত্তরা শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত হল। মালিকের শোষণ প্রত্যক্ষ হল। সঙ্গে শ্রমিকের বিক্ষোভ। শুরু হল রাজনৈতিক বিভাজন। তয়ের হল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দল। সকলেরই ইচ্ছা মানুষের দুর্গতির অবসান। কাজে কিন্তু এক দল মালিকের পক্ষে। তো অন্য দল শ্রমিকের স্বার্থে। এমনি চলল প্রায় তিন শ’বছর। এর নধ্যে রুশদেশে ঘটে গেছে শ্রমিক বিপ্লব।১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে। সেই বার্তা সমুদ্রের ঢেউ বেয়ে পৌঁছে গেছে কিউবাতে। আর তয়ের হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ববিক্ষোভে এগোনোই যাচ্ছে না। অথচ আখের ক্ষেতে খনিতে কারকখানায় কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ নিত্য ঘটনা। সরকারে আছে স্বৈরাচারি বাতিস্তা। তার বাস মনকাড়া দুর্গে। সেখানে প্রবেশের সাহস আছে কার। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা সেখানে।
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগগরের পারে এক রাজ্য। নাম তার চিলি।যুবক ডাক্তার চে গূয়েভারা। মার্ক্সবাদে দীক্ষিত বিপ্লবী। এলেন পুবের রাজ্য আটলান্টিকে ভেসেথাকা দ্বীপরাজ্য কিউবাতে। বন্ধু পেলেন ফিডেল কাস্ত্রোকে। দু’জনের পরিকল্পনা এবং কাজ অবর্ননীয় দুঃখ শোক সহ্য করে মাত্র আশি জন কমরেড নিয়ে অবাক করা পদ্ধতিতে মনকাড়াদুর্গ দখল করলেন। বাতিস্তার পরাজয় ঘটল। কিউবা সমাজতান্ত্রিকরাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করল। ফিডেল কমিউনিস্ট শুধু নয় পার্টির নেতা হলেন । চে থাকলেন না । বলিভিয়ায় মার্ক্সীয় বিপ্লব সংঘটিত করতে গিয়ে আমেরিকার বাহিনির কাছে নৃশংস ভাবে খুন হলেন।
কিউবা টিকে আছে আজও। সমাজ তান্ত্রিক রাস্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে, মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধকে ঠেকিয়ে। হিম্মতের সঙ্গে টিকে আছে আজও। আজকের কিউবা বিশ্বের নীপিড়িতের আস্থা সাহস উদ্দীপনা।
ঘটনাটা ঘটে ছিল আজ থেকে ষাট বছর আগে। ১৯৫৯ সালের ১ লা জানুয়ারি। আমি তখন পার্টির সদস্য কর্মী। রাজনীতির চর্চা আমাদের তখন দৈনিক কৃত্য। আড্ডার স্থান কানু ঘোষের চায়ের দোকান। রঞ্জিত রায় । গণনাট্য সংঘে অভিনয় করি এক সঙ্গে। এক খানা বই নিয়ে এলেন এক দিন। সৌরীন সেন-এর লেখা। নাম, ‘আখের স্বাদ নোনতা’। পড়তে দিলেন। এই হল কিউবার সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয়। আমাদের আড্ডায় আছেন, বেশি বোঝেন কম বোঝেন মোটামুটি বোঝেন মোটে বোঝেন না এমন সকল রকমের মানুষজন। ঊনষাট সাল, মানে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মতাদর্শে চির ধরা পড়েছে। রুশপন্থী চীনপন্থী কথাগুলো চালু হয়েছে। কে কোন দিকে যাব তখনও ঠিক হয়ে ওঠে নি। এ সময়ের ঘটনা কিউবার বিপ্লব। আমরা মার্ক্স পড়া কমিউনিস্ট নই। আমরা দাদাদের কথানির্ভর পার্টিকর্মী। বিদ্যে আমাদের জন্য ছড়ানো আছে স্বাধীনতা পত্রিকার পাতায়। এর বাইরে পড়ার মধ্যে পড়েছি খান কয় লেনিনের বই। অতএব লেনিনের স্কেলে ফেলে ফেলে কিউবার বিপ্লবের বিশুদ্ধতা মাপার চেষ্টা। আমাদের জ্ঞানে মার্ক্সবাদে শিশুসুলভ বিশৃংলার কথা আছে। রোমান্টিসিজম আছে। নিহিলিজম আছে। সংশোধনবাদ আছে। হঠকারিতা আছে। বোহেমিয়ানিজম সেও আছে। অর্থাৎ আমাদের তখনকার ধারণায় মার্ক্সবাদ আসলে পুরোহিত দর্পণের মতোই আচার-অনুষ্ঠানে ঘেরা। যার এক তিল প্রমাণ এদিক ওদিক হলেই শাস্ত্রদূষণ ঘটবে। এবং গৃহস্থের অমগংল অবধারিত।


ইতিহাসে পড়েছি, সতের জন অশ্বারোহী তুর্কি সেনা বাংলা দখল করে ছিল। মধ্যাহ্ণ আহারে ব্যস্ত রাজা লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে তখনকার মতো বেঁচে গিয়ে ছিলেন। অথচ কী ছিল তাঁর প্রতাপ। বাংলার সমাজে জাত-পাতের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আশ্চর্য, তুর্কিরা আজ আর নেই। কিন্তু জাত-পাতের অবৈজ্ঞানিক বিধান থেকে বাংলা আজও মুক্ত হতে পেল না।
 আমাদের আলোচনা, এটা কী ধরণের বিপ্লব। আশি জন লোক নিয়ে সর্বহারার বিপ্লব। লেনিনও কি কল্পনা করতে পেরে ছিলেন। আসলে এটা বিপ্লবই নয়। একে কয়েক জনের একটা বিদ্রোহ বলা যেতে পারে বড়জোর। কিন্তু ষাট বছর তো পেরিয়ে গেল। কিউবা টিকে আছে। স্পেনের চারশো বছরের অধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। এখনও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। কৌশলটা তো শিখবার আছে, আমাদের দেশের সঠিক মার্ক্সবাদীদের। যাঁরা একশ’ বছরেও সমাজতন্ত্রের দিকে এক ধাপ এগোতে পেরেছেন বলে আজ আর প্রত্যয় হয় না। পুঁজিবাদ নিজেকে বদলে বদলে মার্ক্সবাদকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে আজও।
                 ------
লেখার পরে ------
এই লেখা আবেগে লেখা। তত্ত্ব আর তথ্যের অনেক ত্রুটি ব্যকরণবিদেরা আবিষ্কার করবেন নিশ্চয়। যেমন করে থাকেন নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করবার জন্য। আবেগের বাস্তবতা স্থান পায় না তাঁদের কাছে। আমার পরিবেশে আমি কেন, কেউই কিউবার কথা খুব একটা জানতাম না। বাল্যকালে ব্রিটেনের ইতিহাস পড়তে হত আমাদের। মানচিত্র যা দেখছি তা ব্রিটিশভারতের। কিউবার কথা আমাদের পাঠ্যতালিকায় ছিল না। যেমন ছিল ইয়োরোপ। আজও সাধারণ ছাত্ররা কিউবার কথা খুব একটা জানে বলে আমার মনে হয় না। যদিও চে,র ছবি আঁকা গেঞ্জি তারা পছন্দ করেন। এ লেখা লিখেছি, আমার চেয়ে কম জানেন যাঁরা তাঁদের জন্য। উদ্দেশ্য, আরও জেনে আমার ভুল শুধরে নেবেন। সেই সঙ্গে আমার দাবি সকল মানুষের সঙ্গে থাকবেন। ছুঁৎমার্গ দূর করবেন। ফিদেল তাই করে ছিলেন। সর্ব শেষ কথা সাম্যবাদী হবেন।     

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার