ভোগের প্রসাদ
বিমল
কান্তি দাশ গুপ্ত
প্রসাদ।
দেবতাকে নিবেদন করা হয়েছে, এমন বস্তু। অথবা গুরুজনের ভুক্তাবশিষ্ট। এটি এখনকার
দিনে সহজলভ্য নয়। কারণ স্বাস্থ্যসচেতন আধুনিক মানুষ ও-টিকে এড়িয়ে চলেন আজকাল। সে
তুলনায় দেবপ্রসাদ সহজলভ্য। কেন না দেবতাকে তুষ্ট করবার প্রতিযোগিতা চলছে ইদানীং। শহর
বা পাতিশহর অঞ্চলে যতায়াতের পথে প্রসাদ বিতরণের দৃশ্য নজরে পড়ে হামেশা। অনুগ্রহপ্রার্থীর
লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেই হল। দেবতার প্রসাদ জুটে যাবে। অনেক কষ্ট স্বীকার করে বহু সাধ্য সাধনার অন্তে
দেবকৃপা লাভের যুগ শেষ হয়েছে। অতি আধুনিক গতির যুগে দেবতার কৃপার মাঝেও গতির
সঞ্চার ঘটেছে। এই যে লাইনে দাঁড়ানো মানুষজন, এঁরা কিসের প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
সে কি দেবতার অনুগ্রহ নাকি নিখরচায় আহারের আগ্রহ। খাবারের আগ্রহ মানে ক্ষুধার
চাহিদা, এটা তো সত্য।
এমনই এক
দৃশ্য দেখে আমার জীবনে স্মরণকালের প্রথম দিনটি দেখা দিল। আমি তখন নিতান্ত বালক।
প্রসাদের গুরুত্ব বোঝবার বয়স হয়েছিল না। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। চাঁদের কিরণ প্রথম
বাধা পেল গ্রামের সব চেয়ে উঁচু গাছের মাথায়। তাকে এড়িয়ে পড়ল এসে গাছগাছালিতে ছাওয়া
আমাদের বাড়ির টিনের চালে। তাকেও কোনো মতে পাশ কাটিয়ে অনেক কষ্টে আমাদের উঠানের
মাটি স্পর্শ করে পথশ্রমে ক্লান্ত চাঁদ যেন সেখানেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। এখন তার
বিশ্রামের সময়। রাতের শেষে সকালে সে চলে যাবে।
সকাল থেকে
মন সেদিন খুশিতে চঞ্চল। সন্ধ্যায় পেছনের বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো হবে। বাড়ির সকলে
যাবেন। প্রসাদ গ্রহণ করবেন। সে প্রসাদ লোভনীয়। তার উপকরণ, ঢেঁকিতে পেষা আতপ চালের
সফেদা। গাছপাকা সবরিকলা। নারকেলের জল। সঙ্গে কোরানো নারকেল। আখের গুড় আর আছে, জল
এবং জ্বাল না দেওয়া গোরুর দুধ। প্রসাদের পরিমাণ এতোটাই যে রাতে অন্য কিছু খাবার
প্রয়োজন হত না। যেখানে বাড়ির সকলের পক্ষে উপস্থিত থাকা সম্ভব হত না, সেখানে বাড়ি
থেকে পাত্র নিয়ে যাবার রীতি। তাই পুণ্যার্থীরা প্রয়োজন মতো পিতল কাঁসার ঘটি বাটি
গেলাস নিয়ে যাবেন, এটা বলা বাহুল্য মাত্র।
সন্ধ্যায়
আঁধারমাখা জ্যোৎস্নায় বাড়ির পেছনের ছোট জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বড়োদের সঙ্গে চলেছি,
পেছনের বাড়িতে সত্যনারায়ণের শিন্নি খাবো বলে। শিন্নি আমার চেতনায় তখন এক উপাদেয়
খাদ্য মাত্র। যা কি না পেটপুরে খাবার পরেও মন আরও খেতে চায়।
প্রসাদের
উৎস, দেবতার প্রতি আবেগ। ভক্তি ভয় আবদার বা আহ্লাদ সে যে রূপেই হোক না কেন। সেই
বুঝে কিছু চাই বা নাচাই-এর কারণে দেবতার নিকট প্রার্থনা। প্রার্থনার অনুসঙ্গ,
প্রথমে ভক্তি পরে কিছু আহার্য বস্তু কিছু পরিধেয় যা প্রার্থীর নিজের জীবনের স্বাভাবিক
চাহিদা, এমন কিছু দ্রব্য সামগ্রী। উপাদানগুলি চয়ন করবার সময় নজর রাখা হয় মানের
উৎকর্ষতার দিকে। যা কি না লঙ্ঘিত হয় নিজের
ব্যবহারের সময় আর্থিক কারণ দেখিয়ে। দেবতাকে সেরা জিনিসটি দিতে হয়, নিজেকে বঞ্চিত
করে হলেও।
মানুষের উপর
কর্তৃত্ব করবার ক্ষমতা, মানুষ নিজে আর প্রকৃতি ছাড়া যারা রাখেন, তারা হলেন, দেবতা
অসুর দানব দৈত্য ভূত প্রেত পিশাচ ইত্যাদি অশরীরী কাল্পনিক শক্তিধরগণ। এনাদের তুষ্ট
করতে যে ক্রিয়া তা-ই পূজা। আর এনাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের ভাষামাধ্যমের নাম মন্ত্র। সারা দুনিয়ায়
যেখানেই মানুষের অস্তিত্ব সেখানেই এনাদের অবস্থান, কোন্ সেই আদ্যি কাল থেকে।
আমার
প্রস্তাবনার পরিধি ছোট করে শুধুমাত্র বাংলার সীমানায় গুটিয়ে এনে দেখবার চেষ্টা
করছি। প্রসাদ বা ভোগের আয়োজন নিয়ে বাংলায় যে সকল পূজা হয়, যেমন দুর্গা কালী
সরস্বতী শনি সত্যনারায়ণ আর আছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মহোৎসব। এর সবক’টিতে
প্রসাদ বা ভোগ হিসেবে ভক্তদের মাঝে বিতরণের জন্য তয়ের করা শিরনি খিচুড়ি অন্ন(ভাতের
প্রসাদী নাম)। পাঁচমিশেলি সবজি চাটনি মিষ্টান্ন ইত্যাদি। শিরনি বাদ দিলে সবক’টি
তয়ের হয় রন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এবং এগুলো রান্না হয় অনেক ক্ষেত্রেই খোলা
আকাশের নিচে। স্বাস্থ্যবিধির অনেক নিয়মই না মেনে। অনেক ক্ষেত্রে এ সকল খাবার বিতরণ
করা হয় রান্না হয়ে যাবার পাঁচ-সাত ঘন্টা পরে।
সরকারের
‘স্বাস্থ্য বিভাগ’ নামে একটা দফতর আছে। ফেডারেল ব্যবস্থায় সেই বিভাগ চলে কেন্দ্র
রাজ্য যুগ্ম প্রচেষ্টায়। বাড়তি যোগ হয় বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার উপদেশ নির্দেশ এবং
শর্ত সাপেক্ষ সহায়তা। জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসচেতন করে তুলবার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক
প্রচারের ব্যবস্থা রাখা আছে সেখানে। তা’তে দেখানো হয়, হাত পা ধোওয়া থেকে খাদ্য
গ্রহণের স্বাস্থ্যসম্মত নিয়ম কানুন। আর আছে কিছু উপদেশ। যেমন, বাজারের রান্না করা খোলা খাবার
খাবেন না। রাস্তায় কাটা ফল খাবেন না। বাসি খাবার খাবেন না ইত্যাদি। নির্দেশ অমান্যকারিদের জন্য
শাস্তির বিধানও বলে দেওয়া আছে সেই বিজ্ঞাপনে।
মজার কথা,
প্রসাদগ্রহীতাদের লাইনে সাক্ষাৎ মিলবে এক কথায় আবালবৃদ্ধবনিতার। দেখা হবে
শিক্ষাঙগনে পা-নাদেওয়া বালক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের। আরও
দেখা যাবে, বিভিন্ন পেশায় যুক্ত গণ্যমান্য মানুষকে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হবে না,
খাদ্য নিয়ে নিজের ঘরে এই মানুষদের শুচিবায়ুগ্রস্ত চেহারার। আমার জিজ্ঞাসা, কোন্
জাদুর শক্তিতে এমনটা ঘটতে পারে। আমার ধারণায় সেটা একটা শব্দ। ‘প্রসাদ’। যার প্রতি
ভক্তি আর বিশ্বাস টিকিয়ে রাখবার জন্য যুগ যুগ ধরে নিরন্তর যে প্রচেষ্টা চলছে তার
কাছে যুগ যুগ ধরেই হার স্বীকার করে নিচ্ছে বিজ্ঞান যুক্তি আর বাস্তব অভিজ্ঞতা।
‘প্রসাদ’ টিকে আছে স্রেফ ক্ষুধার ভিতের উপর। সে ক্ষুধা মূলত উদরের ক্ষুধা। এই
ক্ষুধাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য আছে শর্তহীন ‘ভক্তিদর্শন’। ভোগের প্রসাদ আমার
বিবেচনায় নিম্নবর্গের মানুষের দারিদ্র্য এবং দুর্ভোগ টিকিয়ে রাখবার এক মসৃণ কৌশল।
Comments
Post a Comment