সাম্প্রদায়িকদের মুখোশ খোলার সময় এখন: প্রসঙ্গ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন
সাত্যকি দত্ত
ভারতবর্ষ,তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ সহ আন্তর্জাতিক স্তরে এই মুহূর্তে অতি-আলোচিত এবং সমালোচিত যে দুটি বিষয়, তা হল 'জাতীয় নাগরিকপঞ্জী' এবং 'নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন'। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই কেন্দ্রীয় আইনের বিরুদ্ধে উঠছে প্রতিবাদের ঝড়। শাসকদলের সমর্থক ও নেতাদের সাথে বিরোধীদের সংঘাত তীব্র হয়ে উঠছে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া, এই আইন ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে সরাসরি আঘাত করছে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের নিদানের মধ্যে দিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে স্বতঃফূর্ত জনবিক্ষোভ অনেক ক্ষেত্রেই মাত্রা ছাড়িয়েছে। আন্দোলনকারীদের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা যথাযথ হলেও বাস-ট্রেনে আগুন লাগিয়ে হঠকারী কার্যক্রমে তাদের জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিছু সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ভূমিকা এক্ষেত্রে সদর্থক নয়। বিজেপির পক্ষে থাকা একাধিক গণমাধ্যম ভুয়ো খবর প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। আর তৃণমূল সরকারও সংসদে 'ক্যাব' সংক্রান্ত ভোটাভুটির সময়ে নিজেদের সাংসদদের অনুপস্থিতির কারণ দর্শাতে না পেরে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সুযোগ নিয়ে প্রতিবাদের নামে প্রহসন করছে।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু রাজনৈতিক দল নেমে পড়েছে তাদের নিজস্ব লাভ ও ভোটব্যাঙ্কের হিসাব করতে। কেন্দ্রে শাসক দলের নেতা এবং সমর্থকরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের সীমা লঙ্ঘন করছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সমর্থনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে। দিলীপ ঘোষ দাবি করেছে বিজেপি ক্ষমতায় এলেই রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর কাজ শুরু হবে আর মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় বিরোধীদের উত্তর কোরিয়া চলে যাওয়ার পরামর্শ দিতে গিয়ে নিজের পদ খুইয়েছেন। তৃণমূলের প্রতিবাদের আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। যখন বসিরহাটে অবস্থার অবনতির কারণে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তখনও সেখানের পরিস্থিতি নিয়ে কোনও বক্তব্য রাখতে দেখা যায়নি সেখানের সাংসদ নুসরাত জাহানকে, তার বদলে সে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছে নিজের নাচের ভিডিও! এই নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিমধ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করায় দেশজুড়ে ছাত্রদের ওপরেও আঘাত নেমে আসছে। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের ওপর পুলিশী অভিযানের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে আই. আই. টি , আই. আই. এম, যাদবপুর, টি. আই. এস. এস সহ দেশের প্রথম সারির অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। প্রধানমন্ত্রীর আন্দোলনকারীদের পোষাক নিয়ে সাম্প্রতিক বক্তব্য নির্যাসগত ভাবে উস্কানিমূলক এবং সাম্প্রদায়িক। ঝাড়খণ্ডের দুমকায় নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যই পুলিশকে এত নির্মম হতে উৎসাহ দিয়েছে। ফলতঃ সারা দেশেই এক আতঙ্কময় ও অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
অধিকাংশ বামদলগুলি প্রথম থেকেই জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর বিরোধিতা করলেও সিপিএম আসাম এবং ত্রিপুরাতে এই ব্যাপারে ইস্যুভিত্তিক সমর্থন করে এসেছে, যার ফলে এ ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। অপরদিকে কংগ্রেস এই মুহূর্তে বিরোধিতায় সরব হলেও রাজ্যে ও কেন্দ্রে তাদের কার্যকারিতা অনেকটাই কম। এছাড়া আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর মূল ভিত্তি যে 'আসাম চুক্তি' তা হয়েছিল কংগ্রেসের শাসনকালে, কাজেই এই পরিস্থিতির দায় তারাও এড়িয়ে যেতে পারে না।
কেন্দ্রে বিজেপি যখন বিভাজনের রাজনীতি করে হিন্দু ভোটের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চাইছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে নিয়ে, তখন রাজ্যে শাসকদল তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোটের দিকে নজর রাখছে যার প্রভাব পড়ছে আইন শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনেও। এরই তলায় খুব সহজে চাপা পড়ে যাচ্ছে ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, যা কেন্দ্রের ওপর চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দিচ্ছে।
মুম্বাইয়ের এক আদালত সাম্প্রতিক একটি মামলায় ভোটার কার্ড আর পাসপোর্টকে মান্যতা দিয়েছে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে, যা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এই শান্তি সাময়িক, তা বলাই বাহুল্য। কেন্দ্রে আসীন সরকার ও সহযোগী দলগুলি সংখ্যার জোরে আইন পরিবর্তনে যে সক্ষম ও আগ্রহী তা তারা দেখিয়ে দিয়েছে। এই সময় রাজনৈতিকভাবেই এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে দেশবাসীকে। দক্ষিণপন্থী দলগুলির সাথে সিপিএমের জোট ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচনে। তাই কংগ্রেসের মত দলের সাথে সমঝোতার রাস্তা থেকে সরে এসে বাম মনোভাবাপন্ন দলগুলির এক ছাতার তলায় এসে আন্দোলন গড়ে তোলাই এই সময় একমাত্র রাস্তা।
ইতিমধ্যেই ধর্মকে কেন্দ্র করে মেরুকরণে বিজেপি এবং তার সহযোগী দলগুলি যথেষ্ট সফল, আর বিরোধী দলগুলিও সেই ফাঁদে পা দিয়ে ধর্মভিত্তিক প্রচারে জোর দিচ্ছে। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে অন্যান্য সব দক্ষিণপন্থী দলও ভোট ব্যাংকের নামে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। বিভাজনের রাজনীতি আর ভেদাবেদকে ভিত্তি করেই জার্মানিতে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল। সারা বিশ্বের কাছে নাৎসী জার্মান সমাজ ও রাজনীতি চূড়ান্ত নিন্দিত এক অধ্যায়। আমরাও ধর্মভিত্তিক অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়ে দেশকে সেই একই পথে নিয়ে যাবো নাকি তার আগেই নিজেদের ভুল সংশোধন করতে পারবো, এক সুন্দর বাসযোগ্য দেশ রেখে যেতে পারবো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য- সেই প্রশ্ন আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। হিটলারের ঘৃণানির্ভর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে আদর্শ সফল হয়েছিল, এই মুহূর্তে ভারতেও তা-ই একমাত্র পথ এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য- 'মার্ক্সবাদ'।
Comments
Post a Comment