জাতীয় নাগরিকপঞ্জী : লিঙ্গবৈষম্যের আরেক নাম?

সাত্যকি দত্ত

জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নিবন্ধকরণের বিরুদ্ধে যখন সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন, তখন এর বিরুদ্ধে উঠে আসছে আরো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ।  কিছুদিন আগে আসামে সমাপ্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তালিকা আসলে লিঙ্গবৈষম্যেরই নিদর্শন- এই দাবি উঠে আসছে, কারণ এই তালিকায় আসামে বসবাসকারী প্রায় ২০০০ রূপান্তরকামীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বৈষম্য মূলক এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার দিশা খুঁজে পেতে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ নতুন নয়, কারণ আসামে এর জন্য যখন বংশতালিকা ও সম্পত্তির তথ্য জোগাড় করতে হয়েছিল তখন মহিলারা যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বিবাহসূত্রে অন্য জেলা বা রাজ্যে চলে যাওয়া মহিলাদের  পক্ষে তাঁদের বাবা মার ভোটার কার্ড অথবা সম্পত্তির তথ্য জোগাড় করা সহজ কাজ নয়, কারণ এখনো ভারতবর্ষে কন্যা সন্তানের নামে সম্পত্তি কেনার প্রচলন কম। প্রান্তিক শ্রেণীর সাথে তৃতীয় লিঙ্গ, রূপান্তরকামী অথবা হিজড়া বলে পরিচিত যারা, তাদের সমস্যা এই ক্ষেত্রে আরো অনেকটাই বেশী।
আসামে নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন অসমের লোক আদালতের বিচারক বিধান বড়ুয়া ওরফে স্বাতী, যিনি নিজে একজন রূপান্তরকামী নারী। তালিকায় যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের অধিকারের দাবীতে তিনিই সুপ্রীম কোর্টে জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেছেন। স্বাতী বিধান বড়ুয়ার মতে, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অন্তর্ভুক্তির কথা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে কখনোই ভাবা হয়নি। তাঁদের অনেকের কাছেই ১৯৭১ সালের আগের কোন নথিপত্র ছিল না, তাই তাঁরা চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পান নি।  এর পর এই প্রসঙ্গে অভিযোগ জানানোর জন্য ফর্মে লিঙ্গ পরিচয়ের জায়গায় শুধু পুরুষ বা মহিলা বলে পরিচয় দেওয়ার সুযোগই  আছে, সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের কোন উল্লেখই  নেই, যার ফলে সমস্যা আরো বেড়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় আরেকটি সমস্যার দিকও উঠে এসেছে। পরিবার ও প্রতিবেশীদের থেকে ছোটবেলা থেকেই দূরত্ব গড়ে উঠেছে অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের, ফলে তাঁরা অনেকেই জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাম ব্যবহার করেন না।  বর্তমানে তাঁরা আসামে কিছু 'ঘরানা' বা যৌথ পরিবারের মত একসাথে থাকলেও, অনেকেরই কোন আইনী নথি, যেমন ভোটার বা আধার কার্ড  ইত্যাদি নেই, যার ফলে দৈনন্দিন জীবনে অনেক পুলিশী ঝামেলার সম্মুখীন তাঁদের হতেই হয়।  জন্মগত পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বাবা-ঠাকুরদার নাম, ১৯৭১-এর আগের ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম, ভূসম্পত্তির দলিল, জন্ম অথবা স্কুলের সার্টিফিকেট খুঁজে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই তাঁদের, ফলে এই জাতীয় নাগরিকপঞ্জীতে নাম না ওঠায় বাসস্থানটুকুও হারানোর আশঙ্কায় ভীত হয়ে উঠেছেন আসামের তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিটি মানুষ।  এছাড়া কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে কয়েকজনের পুরোনো পরিচয় অথবা নাম উঠেছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তালিকায়, কিন্তু তাঁরা আটকে পড়েছেন শাঁখের করাতের মাঝে- নিজের পরিচয় না দেশের নাগরিকত্ব, এই দুইয়ের টানাপোড়েনে আটকে যাচ্ছেন তাঁরা।
লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে সারা পৃথিবীতেই, ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়।  কিন্তু স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টও যেখানে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তালিকার মত একটি বিষয়ে বৈষম্য এটাই বোঝায় যে সংগ্রামের পথ চলা এখনো অনেক বাকি। একই সাথে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর আসল অভিসন্ধি কি, এই প্রশ্ন উঠেই যায়।

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার