সমালোচনাঃ এবিপি-র ‘প্রধানমন্ত্রী ২’-তে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পর্যালোচনা
সুমিত ঘোষ
এবিপি-র দুটি পর্বের অনুষ্ঠানের লিঙ্কঃ
লাল সেলাম
থালা বাজানো, বাজি পোড়ানোই যখন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর করোনা সংক্রমণ রোধের
নামে সার্কাসের প্রধান শো থিম, তখন ‘প্রধানমন্ত্রী ২’ নামে এবিপি গ্রুপের অনুষ্ঠান
যে এর কাছাকাছিই কিছু একটা পরিবেশন করবে তা বলাই বাহুল্য। সাম্প্রতিক এবিপি আনন্দেও
এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে শুরু করেছে। প্রথম তিনটি পর্ব কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করার
বিজয় গাথায় নিবিষ্ট হয়ে অবশেষে তারা এবার কমিউনিস্টদের খিস্তি করতে মাঠে নেমেছে। দুটি
পর্বে ভারতের নকশালপন্থী আন্দোলন ও মাওবাদীদের লড়াই নিয়ে আলোচনা চলেছে। দেখলে মনে হবে
এই দুটোই যেন এ দেশের বাম রাজনীতির ধারা, অবশ্য সেটা দেখানোই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
অন্যান্য পর্বে, যেমন ধরা যাক কাশ্মীর নিয়ে কপচানোর সময়ে, রাজা হরি সিং-এর পুত্রের
সাক্ষাৎকার পর্যন্ত যেখানে নেওয়া হয়েছে, সেখানে আলোচ্য দুটি পর্বে মাওবাদীদের একটি
আঞ্চলিক বাহিনীর নেতা ব্যাতীত বাম রাজনীতির বিভিন্ন ধারার কোনও নেতারই সাক্ষাৎকার নেওয়া
হল না। ধারা ভাষ্য দিতে থাকলেন দুইজন সমাজ বিজ্ঞানের গবেষক। প্রথম পর্ব শুরুই হল নকশাল
নেতা চারু মজুমদারের বক্তব্যকে বিক্রীত করে, যাতে মানুষ খুন করে রক্তস্নাত হাতের দোহাই দিয়ে ‘লাল সেলাম’
স্লোগানকেই বিক্রীত করে দেওয়া যায়। ‘লাল’ বলতে এখানে যে পুঁজিবাদী সমাজের হাতে মৃত্যুবরণ
করা শ্রমিকদের রক্তের চিহ্ন বোঝানো হয় তা চেপে যেতে গিয়েই এই অভিনব পন্থার অবলম্বন।
উল্লেখ্য, এই রঙের তাৎপর্য ফরাসী বিপ্লবের সময় থেকেই কিন্তু সুবিদিত। নিজেকে কমিউনিস্ট
কর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেও নকশাল বা মাওবাদী কোনও মতধারাতেই আমার সমর্থন নেই কিন্তু সামগ্রিক
বাম রাজনীতির প্রতি যে আক্রমণ এবিপি গ্রুপ এনেছে তার বিরোধিতা এবং মিথ্যার পর্দাফাঁস
করা আমার একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি।
কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য
সঞ্চালক শেখর কাপূর (হিন্দি পর্বগুলিতে) নাটকীয়ভাবে আরেকটি মিথ্যার অবতারণা
করলেন যে গুলি বন্দুকের বদলে কুপিয়ে বা আরও নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে শত্রু নিধনের
কথা বলেছিল নকশালরা। আসলে গুলি বন্দুকের বদলে হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই শ্রেণী শত্রুর
আক্রমণ প্রতিহত করার একটি মতধারা বিদ্যমান ছিল এই আন্দোলনে। এরপর এল কমিউনিস্টদের লক্ষ্য
বর্ণনার প্রসঙ্গ। শেখর কাপূর আবারও নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়ে জমিদার ও পুঁজিপতিদের থেকে
নৃশংসভাবে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ টানলেন। বলে রাখা দরকার, কমিউনিস্ট পার্টির
উদ্দেশ্য শ্রেণির বিলোপ যার জন্য বুর্জোয়াদের সংগ্রাম মারফৎ ক্ষমতাচ্যুত করার প্রসঙ্গ আসবে, যেমন আসবে ব্যাক্তিগত মালিকানার জায়গায় রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানার
প্রসঙ্গও, যা শেখরবাবুর নাটকে বাদ পড়েছে।
ভগৎ সিং ও জহরলাল নেহেরু
এরপর এল পার্টি প্রতিষ্ঠার অংশ এবং ভগৎ সিং-এর লেনিন প্রীতির প্রসঙ্গ টানা হল এমনভাবে যাতে কমিউনিস্ট
পার্টি ও শহীদ-এ-আজম উভয়ই সন্ত্রাসবাদী ধারার প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিপন্ন হন। উল্লেখ্য,
আনন্দবাজারের অভীক সরকারের মত নির্লজ্জ ‘ধনতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী’ না হলে এই সিদ্ধান্তে
আসা বেশ মুশকিল, বিশেষ করে আজ যখন সকলে জানে ভগৎ সিং কিভাবে তাঁর কোর্ট বিচারকে ব্যবহার
করেছিলেন ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার নগ্ন ছবি সকলের সামনে তুলে ধরতে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের
জেলখানায় বিশেষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ করে দিতে, যাতে সাময়িক জল ঢেলেছিলেন গান্ধী,
আরুয়িন চুক্তিতে নিঃশর্তে সই করে। ভগৎ সিং অধ্যায় শেষ হতেই এল নেহেরুকে কমিউনিস্টদের
সমর্থক প্রতিপন্ন করার ভন্ডামি, সেই নেহেরু যে কেরলে নাম্বুদিরিপাদের প্রথম গণতান্ত্রিক
পদ্ধতিতে নির্বাচিত অকংগ্রেসি বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দু’বার ভাবেনি। নেহেরুর
অর্থনীতি ছিল কেন্সীয় মতাবলম্বী। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে পরিকল্পিত অর্থনীতি, শিল্প
ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, ব্যাক্তি মালিকানাধীন কম্পানীর সরকারী লাইসেন্স
প্রাপ্তির আবশ্যিকতা, ভূমি সংস্কারে অনীহা এবং জমিদার-জোতদারদের আধিপত্য বজায় রাখার
মাধ্যমে পুঁজিতন্ত্রের ভীত শক্ত করার প্রোগ্রামে কমিউনিজম-এর ‘ক’ কোথায় রয়েছে তা এবিপি
গ্রুপই জানে। অবশ্য বর্তমানে নেহেরুকে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন দেখিয়ে কংগ্রেসের বিরোধিতার
গেরুয়া লাইনেই যে এবিপি চলছে তা স্পষ্ট। অবশ্য
বর্তমান নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট একাকার হয়ে গিয়ে এই গেরুয়া লাইনকে
বেশ সুবিধাই করে দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
এরপর এক লাফে অনুষ্ঠান দর্শকদের নিয়ে এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধের শুরুতে
সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতীয় কমিউনিস্টদের হিটলার প্রীতি এবং সেই প্রীতিবসত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের
বিরোধিতার কাহিনী তুলে ধরা হল। ইতিহাসের পাতাতে জ্বলজ্বল করছে, বিনা শর্তে ব্রিটেন
ও ফ্রান্সের হিটলারের হাতে চেকোস্লোভাকিয়া প্রদানের কাহিনী। হিটলার প্রীতি আসলে কার
ছিল তা আর বলার প্রয়োজন পড়ে না এখান থেকে। নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধটা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের
প্রতি ঘুরিয়ে দিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের এই পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার জন্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন হিটলারের
সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি (মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি) করতে বাধ্য হয়। ফলে হিটলারের পক্ষে
থাকার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে, দুটি বিশ্বযুদ্ধই ছিল সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের
ফসল। ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে ভারতীয় কমিউনিস্টরা কোনও ভুলই করেননি।
গান্ধী দেশে অহিংসার বাণী প্রচার করলেও সাম্রাজ্যবাদের মদত করতে ভারতীয় সেনাকে যুদ্ধে
অংশগ্রহণ করাতে বাধাদান করেননি যার অনিবার্য পরিণতি হয়েছিল ফ্রান্সের যুদ্ধে ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী চার্চিল কর্তৃক ভারতীয় সেনাকে নাৎসী শত্রুদের মুখে ফেলে দিয়ে পরিত্যাগ।
যতক্ষণে সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
অবতীর্ণ হল, ততক্ষণে ফ্যাসিস্টদের মধ্যে ত্রিশক্তি জোট সম্পন্ন হয়েছে এবং
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের উদ্দেশ্যস্বরূপ শত্রুপক্ষ ব্রিটেনের উপনিবেশগুলি নিজেদের
মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করার পরিকল্পনাও বলবত করা শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই
যুদ্ধে নাৎসীদের বিরোধিতা করা ছিল একান্ত আবশ্যক, ঠিক যে কাজটা কমিউনিস্ট পার্টি
করেছিল। ফলে যেটা দাঁড়ালো, এবিপি গ্রুপের মতে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে ভারতীয়
সেনাকে প্রেরণ করা উচিৎ ছিল এবং যুদ্ধ চলাকালীন গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে
যোগদান মারফৎ ব্রিটিশের বিরোধিতা করা দরকার ছিল। এতে ব্রিটিশ বিতারণ হত কি?
তাছাড়া, দেশের বিপ্লবীরা জঙ্গি আন্দোলনের পথে এগোলে গান্ধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন
প্রত্যাহার করে নেন, যাতে বোঝা যায় দয়া ভিক্ষা ছাড়া ব্রিটিশরাজের কাছে আর কিছু
চাওয়ারই উদ্দেশ্য ছিল না কংগ্রেসের। যুদ্ধের শেষে চুক্তি সই করে বিশাল ঋণের বোঝা
ঘাড়ে নিয়ে ভারত স্বাধীন হলে কমিউনিস্টরা এই স্বাধীনতাকে ‘মিথ্যা’ বলায়
জাতীয়তাবাদীরা সোরগোল করলেও আদতে তার
প্রকৃত অর্থ স্বাধীনতার ৭০ বছরে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ভালোভাবেই বুঝে গেছে।
তেলেঙ্গানা আন্দোলন
এবার এল
তেলেঙ্গানা আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কমিউনিস্টরা নিজামের কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর
বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় নেহেরু ভারতীয় সেনা প্রেরণ করলে প্রশ্ন ওঠে যে
কমিউনিস্টদের আর সশস্ত্র আন্দোলন চালানো উচিৎ কিনা। নেহেরুর সেনা হায়দ্রাবাদ কব্জা
করলেও নিজামকে পেনশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে, ফলে সমঝোতা কোন স্তরে হচ্ছিল তা বলাই
বাহুল্য। তেলেঙ্গানা আন্দোলন পরিত্যাগ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মতের
ভিন্নতা এবং কমঃ স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে এবিপি গ্রুপ স্তালিনের
আদেশেই আন্দোলন প্রত্যাহারের কাহিনী দাঁড় করাতে চাইলেও প্রকৃত পক্ষে কমঃ স্তালিন সরাসরি
তেলেঙ্গানা আন্দোলন প্রত্যাহারের পরামর্শ দেননি, বরং তা জিইয়ে রাখতে হলে ও সেই
আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে সাহায্য করতে হলে দেশের অন্য প্রান্তগুলিতে গণআন্দোলনের
উন্মেষের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন।
ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ
কমিউনিস্টদের
খিস্তি করার অনুষ্ঠানে ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধের প্রসঙ্গ আসবে না, তা হতেই পারে
না। আবারও শেখর কাপূর নাটকীয়ভাবে প্রশ্ন রাখলেন যে চীন ভারতকে যখন আক্রমণ করেছে,
তখন ‘কেন’ (বিশেষ জোড় দিয়ে) ভারতের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার বিরোধিতা করা হল। উত্তর
দিতে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে। ১৯৫৬ সালে সিআইএ মারফৎ কালিম্পঙে তিব্বতী
বিদ্রোহীদের ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে জানা যায় যে চীন ঝিঞ্জিয়াং ও তিব্বত
সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ করেছে যা ভারতের লাদাখ প্রদেশের আক্সাই চীন অঞ্চল দিয়ে
গিয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা চলার মাঝেই ১৯৫৯-এর অগাস্ট
মাসে ভারতীয় সেনা শিমলা চুক্তির অন্তর্গত ম্যাকম্যাহন লাইন অতিক্রম করে লংজু
অঞ্চলে চীনা সেনার কাছে পরাজিত হয়। একই সালের অক্টোবরে কংকা পাস অতিক্রম করে
ভারতীয় সেনা সগসালু ও শামাল লুংপা অঞ্চল দখল করতে গিয়ে চীনা সেনার কাছে পরাজিত হয়।
ফলে বারংবার ভারতের পক্ষ থেকেই আক্রমণ করা হচ্ছিল, চীন আত্মরক্ষা করছিল মাত্র। উল্লেখ্য,
১৯৬২-এর জুন মাসে যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে সগসালু অঞ্চল ভারতকে প্রদান করে চীন। ১৯৬২
সালে ভারতীয় সেনা আবার ম্যাকম্যাহন লাইন অতিক্রম করে থাংলার নিকটবর্তী ঢোলা অঞ্চলে
প্রবেশ করলে চীনা সেনার সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। একই সালের অক্টোবরে চীনা
প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ভারতে এসে সীমান্ত বিরোধ সমাপ্তির আহ্বান জানান। চৌ দাবী
করেন যে সীমান্ত বিরোধ সমাপ্ত হলে চীন নেফা (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ) পরিত্যাগ
করবে কিন্তু ভারত শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করল না। ১৪ ও ১৭ই নভেম্বর ওয়ালং ও বম ডিলা
অঞ্চলে সংঘর্ষ চলল। এবার চীন আগ্রাসী পদক্ষেপ নিল কিন্তু ১৯শে নভেম্বর চৌ যুদ্ধ
বিরতি ঘোষণা করলেন। চীনা সেনা আসামের তেজপুর অবধি এসেও পিছু হঠল; আক্সাই চীনের
একাংশ তারা দখলে রাখল আর নেফা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হল। উল্লেখ্য, চীন নেফা
প্রসঙ্গে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করলেও ভারতের কৃত্রিম বন্ধু দলাই
লামা একাধিকবার নেফাকে তিব্বতের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে ভারতকে বিপাকে ফেলেছে।
তাছাড়া, ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক ম্যাপে আক্সাই চীনকে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো
হয়। এই সীমান্ত বিরোধ ভারতের কাছে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে দেশবাসীর মনোযোগ
ঘোরানোরই যে একটা বাহানা ছিল তা স্পষ্ট হয় এই তথ্য থেকে যে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির
হার ১৯৫৮-৫৯-এর ৭.৫৯% থেকে বিভিন্ন চড়াই উৎরাই-এর মাধ্যমে ১৯৬২-৬৩-তে ২.১২%-এ
ঠেকেছিল। নাম্বুদিরিপাদের আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার উপদেশকে খাটো
করতে একটি প্রেস কনফারেন্সের নাট্যরূপ তৈরি করেছে এবিপি গ্রুপ যেখানে দাঙ্গে
কর্তৃক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে নাম্বুদিরিপাদের তোতলানোর কাহিনী ফুটে উঠেছে কিন্তু
এর কোনও ঐতিহাসিক তথ্যগত ভিত্তি আছে কিনা তা জানা মুশকিল। দাঙ্গে নাম্বুদিরিপাদকে প্রেসকে
দেওয়া স্টেটমেন্ট ফেরত নিতে বললেও তিনি তা যে করেননি তার উল্লেখ কিন্তু সমাজ
বিজ্ঞানের গবেষণাপত্রগুলিতে মেলে। এবিপি-র এই দাঙ্গে প্রীতিই স্বাভাবিক কারণ বম্বের ‘কারেন্ট’ পত্রিকা
অনুযায়ী কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে থাকাকালীন দাঙ্গে ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয়ের
কাছে সরকারকে সহযোগিতার পরিবর্তে নিজের মুক্তির আবেদন করেছিলেন।
নকশাল আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা
কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন এবং নকশাল আন্দোলনের উন্মেষের
কারণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঘেঁটে ঘ করেছে এবিপি গ্রুপ। যা কিছু তারা বাদ দিয়ে
গেছে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ এবং আন্তর্জাতিক
মতাদর্শগত মহাবিতর্ক (সোভিয়েত-চীন বিতর্কঃ জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
বনাম বিপ্লবের উদ্দেশ্যে সংগ্রাম)-এর প্রেক্ষাপটে
সিপিআই-সিপিআই(এম) বিভাজন ঘটে। সিপিআই খ্রুশ্চেভপন্থী লাইন নিলেও সিপিআই(এম)
সোভিয়েত চীন কোনও লাইনই গ্রহণ করল না। এবং সিপিআই(এম)-এর দীর্ঘ সংসদীয় রাজনীতির
পরেও তাকে এবিপি গ্রুপের থেকে ‘উগ্র মার্ক্সবাদী’ আখ্যা পেতে হল। পশ্চিমবঙ্গে
যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হলে কমিউনিস্টরা তাদের বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কারের পলিসি
গ্রহণ করে। কিন্তু সিপিআই(এম)-এর মধ্যেকার চীনপন্থী অংশের মধ্যে ভূমি সংস্কারের
গতিপথ এবং সমঝোতার বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয় যা হঠকারী প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে নকশাল
পার্টির সূচনা করে। এবিপি গ্রুপ চারুবাবুর মাও-এর প্রতি অনুরক্ততা সম্পর্কে
মাতামাতি করে ‘পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়’ প্রসঙ্গ টেনে আনলেও যেটা বলতে ভুলে
গেছে তা হলঃ (১) কমিউনিস্টরা বিপ্লবের পর পার্লামেন্টের মত তর্কবাগীশতার জায়গার
পরিবর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইন প্রণয়ন ও বিচার ব্যবস্থা সমেত একটি কাজ করার
সংগঠনকে অধিষ্ঠিত করতে চায়। (২) এটা লেনিনেরই শিক্ষা যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির
অনুপস্থিতিতে কমিউনিস্টরা পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে শ্রমিক শ্রেণীকে রাজনৈতিক
শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইবে এবং বৈপ্লবিক পরিস্থিতি এলে পার্লামেন্টের মোহ কাটিয়ে
বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে উৎখাত করতে সংগ্রামে লিপ্ত হবে। লেনিনের এই শিক্ষা থেকে
বিচ্যুতিই নকশালদের ভোট বয়কটের পথে চালিত করে। এবিপি গ্রুপ এবার মাও-কে দোষারোপ
করতে উদ্যত হয়। ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এর প্রসঙ্গ টেনে কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি
ছাড়াই, কেবল নিজেদের মনগড়া চিন্তাধারার ভিত্তিতে এবিপির অনুষ্ঠানের বুদ্ধিজীবীগুলো
বলে বসল যে মাও-এর ভারতের সাথে শত্রুতার দরুণ তিনি নকশালদের সমর্থন দিতে শুরু
করেন। রাজনৈতিক লাইন ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সামঞ্জস্যতার অভাবের প্রসঙ্গ বাদ
পড়ল এবিপি-র এই অনুষ্ঠানে।
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা পেটি বুর্জোয়া স্বার্থ রক্ষার
তাগিদে একচেটিয়াদের আধিপত্য বিনষ্ট করতে পুঁজির উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে
সওয়াল করে থাকে। সোশ্যাল ডেমক্র্যাটদের বামপন্থী অংশের শ্রেণিভিত্তি হল পেটি
উৎপাদক যারা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হলেও সর্বহারা নয়, বরং তাদের মধ্যে
মালিক শ্রমিক উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিই বর্তমান। মার্ক্স এদের প্রলেতারিয়েতের সংরক্ষিত
সৈন্য হিসেবে অবিহিত করেছেন। এদের শ্রেণি সমঝোতার ব্যাকুলতা সংশোধনবাদী মতধারার
প্রবর্তন করে আবার অতি স্বতঃস্ফূর্ত বামপন্থী হঠকারী প্রবণতা জন্ম দেয়
সংকীর্ণতাবাদের (যেমন নকশাল বিচ্যুতি)। বিপ্লবের সাব্জেক্টিভ এবং অব্জেক্টিভ
পরিস্থিতির সামঞ্জস্যতার কথা বিচার না করে এবং ব্যাক্তি খতমের লাইনে উপনীত হয়েই
জনগণের থেকে দূরে হঠতে শুরু করে নকশালপন্থীরা। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে নকল করে
শহরে মনীষীদের মূর্তি ধ্বংস করার লাইনের প্রবর্তন জনবিচ্ছিন্নতা ত্বরান্বিত করে। এ
প্রসঙ্গে এবিপি গ্রুপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা একটু বেশী ফলাও করে বলে কোন
রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। নকশাল
আন্দোলনের অন্তিম পর্বে কংগ্রেসী গুন্ডাদের সাথে সংযোগ ‘কংশাল’ গালির উন্মেষ ঘটায়।
কিন্তু রাজনৈতিক বিচ্যুতির জন্য নকশাল আন্দোলনের পতন হলেও সেই বীর যোদ্ধাদের
সাহসিকতা, আত্মবলিদান এবং বিপ্লবের প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রাম
তাদের শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছে।
মাওবাদী আন্দোলন
মাওবাদী পার্টির জন্ম ২০০৪ সালে, যদিও যে দুটি
পার্টির সংযুক্তির ফলে তার উৎপত্তি তাদের রাজনীতির ময়দানে উপস্থিতি অনেক আগে থেকেই
ছিল। এবিপি গ্রুপ তাদের ‘প্রধানমন্ত্রী ২’-এর একটি পর্বের পুরোটাই নিবিষ্ট করেছে
মাওবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে। আদি নকশাল ও বর্তমান মাওবাদীদের মধ্যে রাজনৈতিক মিল
তাদের চীনের বিপ্লবের পথের সমর্থনে। চীনের মতই ভারতকে ‘আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা
ঔপনিবেশিক’ আখ্যা দিয়ে তারা কেবল মুৎসুদ্দি পুঁজিতন্ত্রকে স্বীকার করে দেশের জাতীয়
বুর্জোয়াদের অর্থনৈতিক স্বতন্ত্রতা ও সাম্রাজ্যবাদী ঝোঁককেই খাটো করেছে, নিজেদের
আন্দোলনকে মূলত কৃষি প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রেখেছে। ছোট কৃষকের সশস্ত্র অভ্যুত্থান,
গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা ও মুক্তাঞ্চল তৈরির আদি নকশালদের রাজনৈতিক লাইন এখনও বহন করছে
মাওবাদীরা, যদিও মুক্তাঞ্চলের প্রশ্নে জঙ্গল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তাদের
আদিবাসীদের অধিকার অর্জনের সশস্ত্র আন্দোলনে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। এবিপি গ্রুপ
নকশাল ও মাওবাদীদের এক করে দেখাতে চাইলেও মাওবাদী পার্টি নকশাল আন্দোলনের একটি
ধারা মাত্র, অন্যান্য ধারার মধ্যে সংশোধনবাদী পূর্ণ পার্লামেন্টী পার্টিও রয়েছে
আবার বিপ্লবী পার্টিও রয়েছে।
এবিপি গ্রুপ এই পর্বে বিহারে মাওবাদী পার্টির
পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় মদতে কৃষকদের পাল্টা সংগঠনের সশস্ত্র কার্যকলাপের
কথা তুলে ধরেছে। এই সংগঠনগুলির একটির অর্থাৎ ভূমি সেনার এক সদস্যের সাক্ষাৎকারও
নিয়েছে তারা এবং তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে নিউট্রাল থেকে
নকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে জনগণের বিরক্তির ছবি তুলে ধরতে চেয়েছে। আদতে এই ভূমি সেনা,
সানলাইট সেনা, কুমার সেনা, ডায়মন্ড সেনা, লোহরিক সেনাগুলি ছিল বিভিন্ন উচ্চবর্ণের
জাতি এবং বড় কৃষক ও জমিদারদের প্রতিনিধি যারা রাষ্ট্রীয় মদতে নিম্নবর্গের মানুষ ও
ছোট কৃষকদের উপর জুলুমি ও হত্যালীলা চালাত। এবিপি-র প্রোজেক্ট করা এই জনপ্রতিরোধ
প্রকৃত অর্থে ছিল বর্ণ ব্যবস্থা ও বুর্জোয়াদের কুখ্যাত গণহত্যার
কাহিনী মাত্র। এই অনুষ্ঠান পর্বের শেষে এবিপি গ্রুপ কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়ার
নেতৃত্বে মাওবাদী পার্টির উত্থানের কথা তুলে ধরে সমাপ্তি ঘটাল সেই চিরাচরিত নাকে
কান্না দিয়ে যে রাষ্ট্র গরীব মানুষের দায়িত্ব নিলে এই উগ্রতার অবসান হবে। একদিকে
তারা জ্ঞানেশ্বরী হত্যাকান্ড কিংবা তৃণমূল বা কংগ্রেসের সাথে জোট প্রসঙ্গ এড়িয়ে
গিয়ে মাওবাদীদের সুবিধাবাদকে ছাড় দিল, অন্যদিকে সমগ্র কমিউনিস্ট রাজনীতিকে
নৃশংসতার কাপড়ে ঢেকে সশস্ত্র সংগ্রামকে জনমানসে হীন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করল।
আসলে ‘ধনতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী’-দের কাছে সর্বহারার সশস্ত্র সংগ্রাম নঞর্থক
হওয়ারই কথা কারণ এই সংগ্রাম মারফৎ-ই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ও সমাজতান্ত্রিক
বিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব।
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির চার নেতার সঙ্গে
সাক্ষাৎকারের সময়ে কমঃ স্তালিন সশস্ত্র সংগ্রাম ও সশস্ত্র বিপ্লবের পার্থক্য তুলে
ধরেন। তিনি দেখান যে চীনের বিপ্লবের লাইন ছিল সশস্ত্র বিপ্লব বা পার্টিজান যুদ্ধ
অর্থাৎ মুক্তি ফৌজ কর্তৃক মুক্তাঞ্চল গঠন কিন্তু এই লাইনের নঞর্থক দিক হল যে এই
মুক্তাঞ্চল সহজেই ঘিরে ফেলে পুনর্দখল করা যায়। চীনও এই লাইনে সফল হত না যদি না
মাঞ্চুরিয়াতে এসে বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা পশ্চাৎভূমি হিসেবে পেত। চীনের
তুলনায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আজও বিশেষ সৈন্যদল নেই এবং সমুদ্র ব্যতীত
পশ্চাৎভূমির অভাবও লক্ষণীয়। তাছাড়া, চীনের থেকে ভারতের ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং
শিল্পক্ষেত্র অনেকবেশি উন্নত। ফলে, শুধুই মুক্তাঞ্চল
তৈরি করলে তা বিনষ্ট করা এখানে খুব সহজেই সম্ভব। এখানেই তেলেঙ্গানা
আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, নকশাল বিদ্রোহের হঠকারীতা এবং মাওবাদী আন্দোলনের নঞর্থক
রাজনৈতিক লাইন স্পষ্ট। কমঃ স্তালিন ১৯৫১ সালেই বলেছিলেন যে
ভারতের ক্ষেত্রে বিপ্লবের লাইন হল সশস্ত্র সংগ্রাম অর্থাৎ কৃষকের পার্টিজান যুদ্ধ
এবং তার রাজনৈতিক মেরুদণ্ড স্বরূপ শহরের শ্রমিকদের লাগাতার ধর্মঘট ও অভ্যুত্থান।
১৯৯১ সালে ভারতে নয়াউদারবাদের প্রবেশের ফলে তার ‘আধা
সামন্ততান্ত্রিক আধা পুঁজিবাদী’ চরিত্র পরিবর্তিত হয় পূর্ণ পুঁজিতন্ত্রে। কৃষিতেও
পূর্ণ পুঁজিতন্ত্রের উন্মেষ সামন্তবাদকে সীমাবদ্ধ করে সাংস্কৃতিক পরিসরে। বিপ্লবের
স্তরও জনগণতন্ত্রের থেকে সমাজতান্ত্রিক পর্যায় উন্নীত হয়।
Comments
Post a Comment