পুঁজির শোষণের ধারা যেভাবে খোলসা করেছিলেন মার্ক্স

প্রথম প্রকাশঃ 'জবরদখল' পত্রিকা, বর্ষ ৫, সংখ্যা ১ (২০১৬); কার্ল মার্ক্সের ১৯৯ জন্মদিবস উপলক্ষ্যে।

লেখকঃ বাসুদেব নাগ চৌধুরী
বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপল'স ব্রিগেডের কনভেনর।




গত বছর ৫ই মে কার্ল মার্কসের ১৯৮ তম জন্মদিবসে জবরদখল’-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত কিছুটা প্রাক-ইতিহাস----বাকিটা মার্ক্সবাদ’ পুস্তিকার ভূমিকায় আমরা বলেছিলাম “…তার উপর অবিরাম আক্রমণ যাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে চির বিজয়ী রূপে” --- তাই হল মার্কসবাদ’। এখানে আমরা সংক্ষেপে তুলে ধরব মার্ক্সের অর্থনৈতিক মতবাদের বিষয়বস্তুগুলোকে যার মাধ্যমে তিনি নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন পুঁজির শোষণের চরিত্র এবং তার ঐতিহাসিক গতিধারাকে। আমাদের সকলেরই অভিজ্ঞতা এই যে, আজকের দিনে মার্ক্সবাদী মহল থেকেই যখন একে পুরনো তত্ত্ব হিসেবে তুলে ধরে মিউজিয়ামে পাঠানোর চেষ্টা চলছে, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বৈঠকখানাগুলি থেকে সংকট জরাজীর্ণ শাসকশ্রেণী তখন নতুন করে ‘তাঁর’ চর্চা শুরু করেছে কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশের দেড়শো বছর পর ১৯৯৮-তে যখন বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি শীর্ষে অবস্থান করছে, অদ্ভুতভাবে তখনই সেই পুঁজিবাদের বাজারে মার্ক্স ও তাঁর তত্ত্বের চাহিদা বেড়ে ওঠে অকল্পনীয়ভাবে। ‘আজকের দিনে মার্কস প্রবন্ধে ঐতিহাসিক এরিক বসবম লেখেন, আশাতীতভাবে এই সময়ে সমাজতান্ত্রিক নয়, বরং পুঁজিবাদীরা তাঁকে পুনরাবিষ্কার করলে সমাজতান্ত্রিকরা এতই নিরুৎসাহ হয়ে পড়লেন যে এই বর্ষাযাপন তাঁরা কিছুই করতে পারলেন না আমার মনে পড়ছে আমার বিস্ময়ে কথা যখন ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’-এর পত্রিকার সম্পাদক আমায় আবেদন করলেন (এ বিষয়ে লেখার জন্য), যার ৮০% পাঠকই আমেরিকান বিজনেস যাত্রী”।
১৮৮৩-এর ১৪ই মার্চ মার্ক্স-এর মৃত্যুর পর ১৭ই মার্চ লন্ডনের হাইগেটে তাঁর সমাধিক্ষেত্রে এঙ্গেলস বলেছিলেন, “…মার্ক্স আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসে বিকাশের নিয়ম, মতাদর্শের অতি নিচে এতদিন লুকিয়ে রাখা এই সহজ সত্য যে রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রথম চাই খাদ্যপানীয়, বাসস্থান, পোশাক অর্থাৎ প্রাণ ধারণের আশু বাস্তব উপকরণ এবং সেই জন্য কোন নির্দিষ্ট জাতি বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রই হলো সেই ভিত্তি যার উপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেদিক থেকেই এগুলি ব্যাখ্যা করতে হবে এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টোদিক থেকে নয়”। মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক নির্দিষ্ট পর্যায়-পুঁজিবাদের সেই অর্থনৈতিক বিকাশের নিয়মগুলি কার্ল মার্কস তুলে ধরেছিলেন তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থে এই ব্যাপকতম ও গভীর ব্যাখ্যার প্রধান প্রধান দিকগুলি আমরা অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করব এখানে, যার বোঝাপড়ার অভাব থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রাম দিকভ্রান্ত হয়, আজও হচ্ছে, আর তা হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায় প্রত্যক্ষ বিচারের দিক থেকে দেখলে পুঁজিবাদই মেহনতী মানুষকে প্রথম যুক্তিগ্রাহ্য অধিকার দেয়,--- এখানে মালিক শ্রমিকদের সাথে এগ্রিমেন্ট করে তাকে মজুরি দেয়, এমন অধিকার আগের কোন ব্যবস্থা মেহনতী মানুষকে দেয়নি এই প্রকাশ্য রূপটা কোনোভাবেই এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না যে তাহলে শ্রমিককে শোষণ করছে কে? কিভাবে? আদৌ করছে কি? পর্দানশীন এই শোষণকে বেআব্রু করার কাজই মার্ক্সের অর্থনৈতিক মতবাদ

আজকের দিনেও অর্থনীতির সবচেয়ে চলতি কথাটা হলো এই যে বাজারে পণ্যের জোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকলে দাম বেড়ে যাবে, উল্টোটা হলে দাম কমে যাবে। কিন্তু ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’-এর দুই লেজের মাঝে মাছি বসলে কি হবে, চাহিদা আর জোগান সমান হলে দাম কি হবে, কিভাবে তা নির্ধারিত হ যার দুপাশে দাম উঠা-নামা করতে পারে, সেই দামটার উৎসই বা কি--- এই প্রশ্ন থেকেই মার্কস তাঁর গবেষণা শুরু করেন তার জন্য মার্ক্স ঝাঁপ দেন পণ্যের সংজ্ঞা খুঁজতে ইতিহাসের দিক থেকে দেখা যায়, ‘পণ্য’ কেবল সেই জিনিসগুলিই, যা তৈরি করা য় কেবল এবং কেবল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে মার্কসের গবেষণা শুরু হয় সেই যুগ থেকে যখন মানুষ সরাসরি একটা জিনিস সাথে অন্য একটা জিনিস বিনিময় করত (কমোডিটি-->কমোডিটিঃ C<-->C`)। মার্ক্স দেখালেন পণ্যের থাকে দ্বিমূল্য, এক, তার ব্যবহার মূল্য (শারীরিক বা মানসিক যে কোন দিক থেকে তাকে ভোগ করা হোক না কেন), আর দুই, তার বিনিময় মূল্য, যার সাথে তার ব্যবহার মূল্যের কোন সম্পর্ক নেই বিনিময়ের এই মাপকাঠি কেবল আর কেবল ই জিনিসটা তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা মোট যতটা শ্রম দিয়েছে, তা ছাড়া আর কিছু নয় পণ্যের বিভিন্নতা এবং তার বিনিময়ের এলাকার যত বাড়তে থাকে, তারই প্রেক্ষাপটে প্রথমে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ‘অর্থ’-এর আবির্ভাব এবং তার ক্রমবিকাশ মার্ক্স সবিস্তার ব্যাখ্যা করেন নতুন যুগের বিনিময়ের বৈশিষ্ট্য হল ‘কমোডিটি-->মানি-->কমোডিটি (C-->M-->C`)’ অর্থাৎ একটি পণ্য তৈরি করে, তা বেচে অর্থের আগম এবং সেই অর্থ দিয়ে অন্য পণ্য কেনার রীতি। অর্থ নিজেও একটা পণ্য, এমন পণ্য যার নির্দিষ্ট মূল্য (বিনিময় মূল্য) আছে এবং যা বিনিময় করা যায় সব রকমের পণ্যের সাথে (অর্থাৎ সব রকম ব্যবহার মূল্যের সাথে)। মার্কস দেখান যে অর্থের এই গুণগত সীমাহীনতা আর উল্টোদিকে তার পরিমাণগত সীমাবদ্ধতাই, আরো আরো, কার্যত অসীম পরিমাণ ‘অর্থ’ সঞ্চয়ের প্রবণতা সৃষ্টি করে থাকে। ‘অর্থের’ ব্যবহারিক দিকের বিকাশ ঘটতে থাকে পণ্যের বিনিময়ের মাধ্যম থেকে শুরু করে, সঞ্চালনের মাধ্যমে, পরিশোধের মাধ্যমে, বিশ্বজনীন অর্থ (যেমন সোনা, রূপা, আজকের দিনে ডলার) হিসাবে এবং একটা বিশেষ যুগে ‘পুঁজি’ রূপে।
এই যুগে অর্থ বিনিময় করে তাকে রূপান্তরিত করা হয় একটা পণ্যে আর সেই পণ্য বেচে আবার তুলে আনা হয় অর্থ, কিন্তু বেশি পরিমাণে এই বাড়তিটাই ‘মুনাফা’। এর আগের বিনিময়ের সমস্ত যুগগুলিতে বিনিময় হয়েছে (গড়পড়তায়) সমানে সমানে, কিন্তু এখন? এই বার্তিটা এল কিভাবে? আজকের দিনেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা কথা খুবই প্রচলিত, ‘বেচায় লাভ করা যায় না, লাভ করতে হয় কেনায়’। এই সত্যটা গভীর গবেষণার মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন মার্ক্স। কারখানার তথা পুঁজির মালিক তার অর্থ বিনিয়োগ করে কেনে কাঁচামাল-যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আর শ্রমিকের মজুরির বিনিময়ে কেনে তার ‘শ্রম’ নয় বরং তাকে দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম ব্যয় করানোর অধিকার। কাঁচামাল যন্ত্রপাতি ইত্যাদির পণ্য হিসাবে মূল্য ঠিক ততটাই যতটা ‘শ্রম’ লেগেছে ওগুলো তৈরি করতে। কিন্তু এই দ্বিতীয় পণ্য-টা যা শ্রমিকের থেকে কেনা হয়, সেটা কোন এমন পণ্য যার ব্যবহারমূল্যটা নিজেই ‘শ্রম’, ফলে এই ব্যবহার মূল্যটাই একটা বিনিময় মূল্যকে প্রকাশ করে। মার্কস-এর আবিষ্কার, এ হল ‘শ্রমশক্তি’, তার খাটবার ক্ষমতা, --- এমন একটা পণ্য যার বিনিময় মূল্য হল শ্রমিকের মজুরি যা দিয়ে আবার পরের দিন খাটবার ক্ষমতা তৈরি হয়; আর যার ব্যবহার মূল্য নিজেও শ্রম, শ্রমশক্তি ব্যয়ের ফল, ওই কারখানার ফাইনাল প্রোডাক্ট তৈরীর জন্য শ্রম যা কাঁচামাল যন্ত্রাদির খরচ-এর সাথে যোগ হয়ে তৈরি করে তার বিনিময় মূল্য। শ্রমশক্তির বিনিময় মূল্য অর্থাৎ মজুরি (যা শ্রমিকের খাটবার ক্ষমতা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি তৈরির শ্রমের সমান) তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ব্যবহার মূল্য (কারখানায় তার ব্যয় করা শ্রমের সমান) সৃষ্টি করতে পারে, যে বাড়তিটা তার হাতে আসে না, চলে যায় মালিকের হাতে মুনাফা হিসেবে। এখন যুগটার বৈশিষ্ট্য হয়ঃ মানি-->কমোডিটি-->এক্সট্রা মানি (M-->C-->M`)’। খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে শ্রমিক কিন্তু এখনও তার শ্রমশক্তি (পণ্য) বেচে মজুরি (অর্থ) ঘরে আনে, আর তা দিয়ে তার জীবনধারণে জিনিসপত্র (পণ্য) কেনে তার জন্য এখনো যুগটা আগের মতোইঃ (C-->M-->C`)।  

পুঁজি বেড়ে চলবার পদ্ধতি হলো মুনাফা বাড়া যা কেবল শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য যতবেশি সম্ভব শুষে নিয়েই সম্ভব। এর দুটি পদ্ধতি হলো একদিকে কাজের ঘণ্টা বাড়ানো (অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য) আর অন্যদিকে যন্ত্রপাতির উন্নতি যা দিয়ে একই সময়ে খাটিয়ে বেশি উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা যায় (আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য)। এজন্যই যন্ত্রপাতির পেছনে বিনিয়োগ (ফিক্সড ক্যাপিটাল) শ্রমিকের পেছনে বিনিয়োগ (সারকুলেটিং ক্যাপিটাল)-এর থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকে, আর সমাজে বেড়ে চলে বেকারত্ব। কিন্তু এর ফলে একটা স্তরে শ্রম কমার ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যও কমে যায়। যে কারখানায় বিনিয়োগ তথা ফিক্সড ক্যাপিটাল-এর বিনিয়োগ বেশি, শ্রম কমে যাওয়ায় তার উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয় মোট বিনিয়োগের তুলনায় কম; যেখানে বিনিয়োগ কম তথা সার্কুলেটিং ক্যাপিটালটুকুর অংশ বেশি, সেখানে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয় বেশি পরিমাণে। মালিকের দিক থেকে চাহিদা থাকে যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে সে তত বেশি মুনাফা করবে। এই দর্শন থেকেই নতুন যুগ আসে যখন ‘মূল্য’ রূপান্তরিত হয় ‘দামে’। বিনিময়ের মাপকাঠি এখন বিনিয়োগের অনুপাতে মুনাফা ধরে দাম নির্ধারণ করে, যদিও সমস্ত পণ্যের মোট দাম তাদের মোট মূল্যের সাথে মিলে যায়, মিলে যেতে হয়। না হলে অর্থনীতিটাই ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ এক একটা ক্ষেত্রের পুঁজি কেবল তার শ্রমিকের উদ্বৃত্ত ভোগ করে না, গোটা সমাজের সমস্ত শ্রমের উদ্বৃত্ত তারা ভোগ করে নেয় যার যার মোট বিনিয়োগ অনুযায়ী। ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে মার্কস বলেন, “গোটা সমস্যার উদ্ভব ঘটে এই ঘটনার থেকে যে, বিভিন্ন পণ্য, কেবল পণ্য হিসাবেই বিনিময় হয়না, বিনিময় হয় বিভিন্ন বিনিয়োগ করা পুঁজির উৎপন্ন হিসেবেও, যারা দাবি করে উদ্বৃত্ত মূল্যের মোট পরিমাণে ভাগ বসানো --- তাদের পরিমাণের অনুপাতে, আর যদি তাদের পরিমাণ সমান হয়, তো সমান সমান”।

যুগের এগানোর সাথে সাথে, বিশেষত স্কিল্ড লেবারের চাহিদা বাড়ার মধ্যে দিয়ে, শ্রমিক যে পণ্য তার মালিককে বেচে--- তার ‘শ্রমশক্তি’, তার বিনিময়ের মাপকাঠিও ‘মূল্যের’ থেকে রূপান্তরিত হয় ‘দামে’; এবং এই বিশেষ শ্রমশক্তি যার সাথে জুড়ে আছে একটা বিশেষ স্কিল, তা তৈরিতে যত বিনিয়োগ করতে হয়েছে বা তার পরিবারকে, তার সাথে সামাজিক গড় মুনাফা অনুযায়ী লাভ ধরেই ‘মজুরী’ তথা ‘শ্রমশক্তির দাম’ নির্ধারণ হয়। এরই ফলে অনেক বেশি শ্রমমূল্য তৈরি করেও ‘আনস্কিল্ড লেবার’-এর মজুরি নেমে যায় আর উল্টোদিকে স্কিল্ড লেবাররা কম খেটেও বেশি মজুরি পেয়ে, এমনকি বহু ক্ষেত্রে তার সৃষ্টি করা মূল্যের চেয়েও বেশি আয় করে যায় ‘হোয়াইট কলার’। পুঁজি তার অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ থেকে যতই একচেটিয়ার দিকে, সাম্রাজ্যবাদের যুগের দিকে এগিয়ে চলে, এই প্রবণতা ততই বাড়তে থাকে। লেনিন এই সমস্ত শ্রমিকদের চিহ্নিত করেছিলেন ‘কুলীন শ্রমিক’ হিসাবে, যাদের মধ্যে থেকেই অরগানাইজড ট্রেড আন্দোলনে ‘সুবিধাবাদ’ জন্ম নেয়। পুঁজি কেন্দ্রীভূত হতে থাকে যেদিকে, সে দিক থেকে সে শ্রমিকদের বিতাড়িত করে যে বেকারত্ব সৃষ্টি করে, সেখান থেকেই ক্রমে ক্ষুদ্র উৎপাদনের এক ব্যাপক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এভাবেই ‘ফরমাল’ ও ‘ইনফরমাল’ অর্থনীতিতে ‘আপাতভাবে’ ভাগ হয়ে যায় গোটা ব্যবস্থা। ‘ফরমাল ইকনমি’তে বিনিয়োগ বেশী, উৎপাদন বেশী, কিন্তু শ্রম কম, উদ্বৃত্ত মূল্যও কম। উল্টোদিকে ইনফরমাল ইকনমিতে শ্রমও বেশী, উদ্বৃত্ত শ্রমও বেশি কিন্তু বিনিয়োগ কম হওয়ায় দাম কম। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত মূল্যের একটা অংশ ইনফরমাল ইকনমি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়ে পৌঁছায় ফরমাল ইকনমির হাতে। একই বিষয় কৃষি ক্ষেত্রেও। ‘কার্ল মার্ক্স’ রচনাটিতে লেনিন উল্লেখ করেন, “কৃষক তার উদ্বৃত্ত উপেক্ষার একাংশ বিনামূল্যে সমাজের হাতে (অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে) ছেড়ে দেয়” এবং মার্কসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “সুতরাং (খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্যের) এই নিচু দাম হল উৎপাদকের দারিদ্রের ফল, কোনভাবেই উৎপাদনশীলতার পরিণাম নয়”। এভাবেই আজ ফরমাল ইকনমি দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণরূপে ইনফরমাল ইকনমির প্রতি পরগাছাবৃত্তি করে।
ফিন্যান্স পুঁজির কাজের ধরন, পুঁজি ধার দিয়ে মুনাফার একটা অংশ কিভাবে সুদে পরিণত হয়, তা প্রায় পোস্টমর্টেম করে দেখানোর পর, কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিবাদী অর্থনীতি কিভাবে কাজ করে, তা ব্যাপক সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন ‘ক্যাপিটাল’-এর তৃতীয় খন্ডে। পুজিভিত্তিক অর্থনীতিতে কিভাবে কৃষি অর্থনীতি কৃষি শ্রমিক, কৃষিতে বিনিয়োগকারী এবং জমির মালিক এই তিন শ্রেণীতে ভেঙে যায় তা তুলে ধরেন মার্ক্স, তাঁর ত্রিযোজী সূত্রের মাধ্যমে। এখানে কৃষিশ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য-এর একটা অংশ যায় বিনিয়োগকারীর হাতে মুনাফা বা সুদ হিসেবে আর অন্য অংশটা জমির মালিকের হাতে দুইভাবে; এক, তার একচেটিয়া মালিকানার জন্য (অনাপেক্ষিক খাজনা), আর দুই, তার জমির প্রাকৃতিক উর্বরতার তুল্য মূল্য কম-বেশী জন্য (আপেক্ষিক খাজনা)। জমিদারের হাতে আসা এই উদ্বৃত্ত কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয় না, এইটাই কৃষিতে পুঁজির কাজ। মার্ক্স বলেন, “তা জমির মালিক এবং জমির মধ্যেকার সংযোগটাকে এমন পরিপূর্ণরূপে ভেঙে দেয় যে জমির মালিক তার সারা জীবন কাটাতে পারে কনস্টান্টিনোপলে যখন তার জমি পড়ে থাকে স্কটল্যান্ডে”। এখন জমির মালিকের অস্তিত্বকে সামন্ততন্ত্র বলে ধরে নেওয়া এক বিরাট ভ্রান্তি। পক্ষান্তরে খাজনার ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা করেই সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী ভূমি খাজনার উৎপত্তি মার্ক্স ব্যাখ্যা করেন বিস্তৃতভাবে।
একথা স্পষ্ট, পুঁজিবাদ এবং পুঁজির শোষণ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে দুটো অংশ আবশ্যক, একদল যাদের হাতে আছে জায়গা জমি পুঁজি সহ উৎপাদনের সমস্ত উপায়-উপকরণ, আর অন্য দলের যাদের কেবল খাটবার ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই নেই। এমন একটা অবস্থান তৈরি হল কি করে? মার্কস তথ্য দিয়ে দেখান, প্রথম পক্ষ ওই সমস্ত কিছু জমিয়েছিল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লুঠ করে, যা তিনি তুলে ধরেন ‘আদিম’ বা প্রাথমিক সঞ্চয়ন হিসেবে। এর থেকে আলাদা করে বুঝতে হবে পুঁজিতন্ত্রে অবিরত চলতে থাকা পুঁজিবাদী সঞ্চয়নকে যেখানে ছোট প্রতিযোগিতারত পুঁজিকে গিলে বৃহৎ একচেটিয়া আকার ধারণ করে বড় পুঁজি এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয় আরও ছোট আরও বেশি সংখ্যায় ক্ষুদ্র উৎপাদন।
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগগুলোর মধ্যে দিয়ে পুঁজি ও পুঁজিতন্ত্রের ক্রমবিকাশ এবং তার ভবিষ্যৎ যাত্রাপথের বৈজ্ঞানিক অনুমান --- এই সুবিশাল কাজ সম্পন্ন করে তার অর্থনৈতিক মতবাদের ভিত্তিতে। এখানে দুটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এই প্রবন্ধ আমরা শেষ করব। প্রথমত, আজকের দিনে ডেরিভেটিভ মার্কেট নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির যুগে কোন উৎপাদনে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ না করেই পুঁজি বাড়িয়ে মুনাফা করতে দেখা যাচ্ছে, এক কথায়, মানি-->এক্সট্রা মানি (M-->M+M`)। এবিষয়ে মার্কসবাদী মহল দিকভ্রান্ত এবং বুর্জোয়া অর্থনীতি উৎসাহিত কারণ উৎপাদন ছাড়াই পুঁজি বাড়াতে পারলে, মুনাফা করতে পারলেই, ‘শোষণ’ বলে আর কিছু থাকে না আসল কথা হলো শোষণের আসল রূপটা আজ আবার পর্দার পেছনে চলে গেছে-- ওটা উন্মোচন করা দরকার--- যে কাজ আজকের মার্কসবাদীদের দ্বিতীয়ত মার্কস-এর ব্যাখ্যা করা এই গোটা মূল্য ও দামের তত্ত্ব, বিনিয়োগ ও উদ্বৃত্তের তত্ত্ব পণ্য ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশিত করে যার প্রধান ভিত্তি হল বিনিয়োগ’--- আরো বিদে বললে ব্যক্তির সাথে সমাজের পরোক্ষ বিনিয়োগ বিভিন্ন ব্যক্তি মারফত সার্বজনীন প্রাচুর্যে ভরা সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্ট সমাজে  সমস্ত মূল্য’-‘দাম’-‘বিনিয়োগ’-‘উদ্বৃত্ত ইত্যাদি বাস্তবে ও ফলত তত্ত্বে কোন ভাবে স্থান পেতে পারে না, ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’য় মার্ক্স স্পষ্ট করে বলেন, উৎপাদনের উপায়গুলোর উপর সার্বজনীন মালিকানার ভিতের উপর গড়ে ওঠা সমবায়ী সমাজে উৎপাদকেরা তাদের উৎপন্নগুলো বিনিময় করে না; ঠিক তেমনি, উৎপন্নে নিয়োগ করা শ্রম এখানে তার মূল্য রূপে, তার এক বৈষয়িক গুণরূপে দেখা দেয় না, কেন না পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে এখানে ব্যক্তিগত শ্রম আর পরোক্ষ নয়, থাকছে প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র শ্রমের অঙ্গাঙ্গী অংশ রূপে”। এমন সমাজ গড়বার লড়াই এগিয়ে চলুক। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার