‘রিলিফ’ ও বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন প্রসঙ্গে নতুন দিশা


রিপোর্টঃ সায়ন ও নিমো

লকডাউন এবং আমফানের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি যখন একে অপরের সাথে  প্রতিযোগীতা চালাচ্ছে, তখন ক্ষয়ক্ষতির  ও অনুদানের পরিমাণ নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতিতে  নেমেছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। ত্রাণ বা রিলিফের কাজ  প্রকৃতপক্ষেই রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের কর্তব্য,  সমস্ত দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছে দেওয়া ও ক্ষতিপূরণ-এর ব্যবস্থা করা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের অর্থভাণ্ডার ছাড়া সম্ভবও নয়। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্যের কথা ফলাও করে বলা হলেও,  গণবন্টন ব্যবস্থার করুণ পরিস্থিতির (যা কিনা স্বাধীনতার সময় থেকেই উন্নতিসাধন তো হয়ইনি উলটে আরো ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে) ফলে যার অধিকাংশটাই শাসক মদতপুষ্ট সুবিধাভোগীরা আত্মসাৎ করছে এবং বাকী ঘোষণা করা অর্থের বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই। দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকার ত্রাণ হিসাবে যে খাদ্যসামগ্রী বা ঘর নির্মাণের সামগ্রী প্রদান করছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং বাকী ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে সে সামগ্রী পাঠানোই হচ্ছে না। উলটে ত্রাণ পাচ্ছে মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগীরা এবং এর জন্য দায়ী রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের পলিসি। এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে, বহু মানুষ নিজ উদ্যোগে এবং  প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলি ত্রাণের কাজে নেমেছে। লকডাউন ও আমফানের ফলে গরীব, খেটে খাওয়া মানুষের সত্যিই ত্রাণ প্রয়োজন কিন্তু সেই ত্রাণের উদ্দেশ্যগত সীমাবদ্ধতা আদতে শাসকের হাতই শক্ত করতে পারে। সরকার ব্যতীত এই উদ্যোগগুলির ওপরেই রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সম্পূর্ণ ত্রাণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, দায়িত্ব এড়াতে একদিকে সক্ষম এবং অন্যদিকে শাসক মদতপুষ্ট গুন্ডাবাহিনীর থেকে কামাবার মতলব করছে। রাজ্যজুড়ে জনসাধারণের জন্য কমিউনিটি  কিচেন করা হচ্ছে কিন্তু প্রশ্নটা যেখানে উঠছে তা হল, কমিউনিটি কিচেনের নামে অনেক ক্ষেত্রে (সকলে মোটেই নয়) আসলে বৃহৎ সুবিধাভোগী অংশের মধ্যে খাদ্য বিতরণ চলছে, শুধুমাত্র খেটে খাওয়া গরীব অংশের মধ্যে নয়। এই কাজ চলছে রাজনৈতিক সংগঠনগুলির হাত ধরেই। তার সাথেই দেখা যাচ্ছে এই কমিউনিটি কিচেনে প্রদেয় বিরিয়ানী বা ফ্রায়েড রাইসের মতো বিলাসবহুল খাবার আসলেই বঞ্চিত করছে মেহনতী গরীব অংশকে অর্থাৎ যেখানে সাধারণ ডালভাত বা খিচুড়ি তৈরি করে অনেক বেশীদিন ধরে এই মেহনতী গরীবদের খাওয়ানো যেত সেখানে এই বিলাসবহুল খাবার পাড়ার প্রতিটা সদস্যকে বন্টন আদতে যে মানুষগুলোর তা প্রকৃতই প্রয়োজন তাদের না পাওয়ার অন্ধকারেই রেখে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি কিছু বামপন্থী সংগঠনের শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে; কমিউনিটি কিচেনের এই প্রবণতা কিছুক্ষেত্রে এলাকা স্তরে সীমাবদ্ধ আবার কিছু ক্ষেত্রে নেতৃত্ব স্তরেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন, ট্রান্সজেন্ডারদের ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে,  যেখানে সরকারী ত্রাণসামগ্রী আসলে পাচ্ছে এন.জি.ও-দের মদতপুষ্ট অ্যাক্টিভিস্টরা এবং খরচ বহনে সমর্থ লিঙ্গ রূপান্তরকামীরা;  রাস্তার হিজড়েরা সেই ত্রাণ থেকে আদপে বঞ্চিত। আরো দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় ট্রেড ইউনিয়নগুলি বিনামূল্য পরিবহনের ব্যবস্থা করছে, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে এই খয়রাতির রাজনীতি করেই কী জনগণের সমর্থন লাভ করা যায়?  জনগণ আসলে এলাকার রাজনীতি বোঝে এবং কর্মক্ষেত্র ও খাবার দাবার পাওয়ার প্রতিটা অংশে কাদের দখলদারী, তারা সেটা উপলব্ধিও করে। সুতরাং কে তাকে ভিক্ষার দান করল তাতে কী আদৌ জনগণের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নির্ভর করে?   

সংকট পরিস্থিতিতে ত্রাণ বন্টনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য প্রদান এবং সরকারের কাছে তাদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবীর শিক্ষা প্রদান। এই বৈপ্লবিক উপাদানকে সঞ্চার করাই যেখানে বামপন্থী দলগুলির লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেখানে শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গীহীন এই ত্রাণ বন্টন,  কমিউনিটি কিচেন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির খয়রাতির রাজনীতি আসলে সরকারের ত্রাণ বন্টনের ব্যর্থতা এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ভাঁওতা প্যাকেজের কথাকে ধামাচাপা দিতে আরো সাহায্য করছে। সরকারের আমলা থেকে গুন্ডাবাহিনী এবং ক্লাবগুলিতে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা অনুদান যাচ্ছে, সেখানে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষকে শোনানো হচ্ছে মিথ্যা অনুদানের গল্প। তার সাথে তো রয়েছেই রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের প্রাপ্য রেশন চুরির অভিযোগ। তৃণমূলের স্হানীয় সিন্ডিকেটের গুন্ডাবাহিনী থেকে শুরু করে বিজেপির সংগঠিত ধর্মের ধুয়ো তোলা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

ইউএস-চীন ট্রেড যুদ্ধ এবং বিশ্বজোড়া মহামন্দার প্রেক্ষাপটে আসা এই করোনা মহামারীকে ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশের উগ্র ডানপন্থী সরকারগুলি কিছু কেন্দ্রীয় আইন লাগু করেছে যার বলে বিভিন্ন জনবিরোধী কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বিনা বিরোধিতায় বলবত করছে এবং সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি খর্ব করা হচ্ছে। এই দেশে করোনা প্যান্ডেমিকের ভয়কে এক গণউন্মাদনায় পরিণত করেছে বিজেপি সরকার। আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্য, গণবন্টন প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক পরিকাঠামোর বেহাল অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত এবং তার উদাহরণ তারা এ কদিনে আরো পেয়েছেন,  যার ফলে এই প্যান্ডেমিকের ভয় জনগণের মধ্যে প্রবল হয়েছে এবং একইসাথে জাতীয় মিডিয়ার প্রাত্যহিক সংক্রমণের খবর এই ভীতিকে মানুষের মনের মধ্যে প্রথিত করতে অনুঘটকের কাজ করেছে, তা বলাই বাহুল্য। এই সমস্ত কিছুর ফলস্বরূপ লকডাউন উঠে যাওয়ার প্রথম পর্বেও মানুষ কাজে পৌঁছতে ভয় পাচ্ছেন।

রাস্তার আন্দোলনই যেখানে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ, সেখানে আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা নতুন ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক এমনকী বামপন্থী দলগুলিও ক্লাব বা এন.জি.ও এর মতো কাজ করা শুরু করেছে। লকডাউনের সময় থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট মারফত,  টুইটারে হ্যাশট্যাগ যুদ্ধ-এর মারফত ও বিভিন্ন ওয়েবিনার-এর মাধ্যমে প্রতিবাদ প্রদর্শণের পন্থা নেওয়া হচ্ছে, লকডাউন উঠে গেলেও শুধু সেই প্রবণতাতেই আটকে আছে রাজনৈতিক দলগুলি। ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যেও এই একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, অথবা তারা খয়রাতির রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ, এমনকী ছাত্রসংগঠনগুলিও,  যারা কিনা রাস্তার আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং যাদের কাজ করার প্রাণশক্তি প্রবল,  তারাও এই প্রতীকী আন্দোলনেই আটকা পড়ে আছে।

লক্ষণীয়, অনেক দেরী করে হলেও বিভিন্ন বামদলগুলি আন্দোলনে নামলেও, জনগণ আসলে এর থেকে বিমুখ। এর দুটি কারণ হিসাবে বলা যায়। প্রথমত আন্দোলনে নামতে অনেকটা দেরী হয়েছে,  দ্বিতীয়ত, সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে নির্দিষ্ট স্থানে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করা এই আন্দোলনগুলি আসলেই  প্রতীকী আন্দোলন, কোনো বৃহৎ উদ্দেশ্যে নয়, যার আদতেই যে কোনো কার্যকারীতা নেই তা জনগণ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝে এবং তাই এর থেকে বিমুখ। এই প্রতীকী আন্দোলনের ধার ভোঁতা হয়ে পড়লেও ছাত্রসংগঠনগুলি এখন সেই প্রবণতা নিয়েই চলছে। বিশেষত যেখানে রাজ্য সরকার সমস্ত স্কুল-কলেজের অনলাইন পরীক্ষা করাবার তাল তুলে আসলেই শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি নির্দিষ্ট অর্থবান সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ করতে রত সেই পরিস্থিতিতেও ছাত্র সংগঠনগুলি বৃহৎ ছাত্র আন্দোলনের ডাক না দিয়ে শুধু প্রতীকী আন্দোলনের কথাই চিন্তা করতে পারছে এবং একেই বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবী করছে। এই প্রসঙ্গে বলা যায়,  বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিকরা জানিয়েছেন,  তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে কখনই লকডাউন বা সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর মাধ্যমে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, বিশেষত পুঁজিবাদী অর্থনীতির অস্তিত্বে তো নয়ই। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ভিয়েতনাম এর মতো দেশ ইতিমধ্যেই করোনাকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে, মিশ্র অর্থনীতির দেশ হলেও সরকারের সমাজতন্ত্রমুখী কার্যকলাপই যে এই সাফল্যের কারণ - তা বলার অপেক্ষা রাখে না!

সারা রাজ্য জুড়ে চলা রাজনৈতিক দলগুলির ত্রাণকার্য,  কমিউনিটি কিচেন বা ট্রেড ইউনিয়নগুলির দেওয়া প্রদেয় বিনামূল্যে পরিবহন ব্যবস্থা আসলেই রাজ্য সরকারের হাত শক্ত করছে, এর কারণ এই খয়রাতির রাজনীতি আদতেই মানুষকে তাদের অধিকারের দাবীতে আন্দোলনমূখী করে তুলতে পারছে না এবং তার প্রচেষ্টাও নেই।  দেশ ও রাজ্য প্রতীকী আন্দোলনে মেতে থাকলেও সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ অধিকারের দাবীতে লকডাউন চলাকালীনই রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছে। যেমন, লেবাননে অর্থনৈতিক সংকট-এর বিরুদ্ধে জনগণ রাস্তায় নেমেছে,  ইউএসএ-তে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছে এবং তার সমর্থনে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে মানুষ সাড়া দিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। এমত পরিস্থিতিতে এখানকার বামপন্থীরা কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের সমর্থনে একটা ছোট মিছিল করলেও,  দেশের প্রধান সমস্যা যেমন পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, কলকারখানা ও শপিং মল কর্মীদের এই লকডাউন পিরিয়ড জুড়ে বেতন না পাওয়া, ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই, ক্লাস না হওয়া সত্ত্বেও প্রাইভেট স্কুলগুলির অতিরিক্ত এডুকেশন ফি আদায় এবং সরকারী ভর্তুকি না দেওয়ার ফলে পরিবহন কর্মীদের বেহাল অবস্থা ও পরিবহনের মাত্রাতিরিক্ত খরচ, ইত্যাদি, বর্তমান সমস্যাগুলি নিয়ে কোনো রাস্তার আন্দোলনই তারা করে ওঠেননি। বরং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসাবে তারা টুইটারে হ্যাশট্যাগ যুদ্ধ,  ফেসবুক পোস্ট,  ওয়েবিনার বা প্ল্যাকার্ড হাতে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে চেল্লামেল্লি করে প্রতীকী আন্দোলনেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন।



এই সময়ে দাঁড়িয়ে, গত ১লা জুন থেকে হাসনাবাদ অঞ্চলে আমফান ঘূর্ণীঝড় বিধ্বস্ত  গ্রামে গ্রামে (বোয়ালমারী, মনোহরপুর, জয়গ্রাম, ঠাকুরানীয়াবাদ, ঘুনি, বেলিয়াডাঙা, আমরুলগাছা) ত্রাণকার্য চালিয়েছে পিপল’স ব্রিগেড। ঘূর্ণীঝড় আমফানের দাপটে  ইছামতীর প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গিয়ে হাসনাবাদ অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম সম্পূর্ণ জলমগ্ন যা বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যে বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন এবং অকর্মণ্য রাজ্য সরকার। অপরদিক পিপল’স ব্রিগেডের এই ত্রাণকার্যে বারবার বাধা দিচ্ছে স্থানীয় তৃণমূলী প্রশাসনের মদতপুষ্ট এবং বিজেপির গুন্ডাদল। এদের শাসানীকে উপেক্ষা করেই  পিপল’স ব্রিগেড তাদের ত্রাণের কাজকে অব্যাহত রেখেছিল। বিভিন্ন জায়গায় রাজ্য সরকার ও বিজেপির গুন্ডাবাহিনীর এই দাদাগিরি এবং একইসাথে সরকারি প্রকল্পগুলির টাকা আত্মসাৎ-এর  খবর কোনো বাজারী মিডিয়াই প্রকাশ্যে আনছে না।

বাকী রাজনৈতিক দলগুলি যখন খয়রাতির রাজনীতি বা হ্যাশট্যাগ যুদ্ধে ব্যস্ত তখন, পিপল’স ব্রিগেডই প্রথম দল যারা হাসনাবাদ অঞ্চলের আমফান দুর্গত বিভিন্ন গ্রামে ত্রাণ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গ্রামের সমগ্র মেহনতী মানুষকে আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষিত করে মানুষের প্রাপ্য অধিকারের দাবীতে সরকারী দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সেখানকার বি.ডি.ও অফিস ঘেরাও করে। এর পরিণতিতে পুলিশের থ্রেট,  তৃণমূল ও বিজেপির গুন্ডাবাহিনীর সকল শাসানী, চোখরাঙানীকে  উপেক্ষা করেই গ্রামের মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের অধিকারের দাবীতে পিপল’স ব্রিগেডের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। পিপল’স ব্রিগেডের তরফ থেকে গ্রামবাসীদের অধিকারের পক্ষে তিনদফা দাবী রাখা হয়েছে, প্রথম; ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ-এর ব্যবস্থা করা,  দ্বিতীয়; সরকারী ত্রাণ-এর ব্যবস্থা করা; তৃতীয় এবং অন্যতম,  ভেঙে যাওয়া বাঁধের বিভিন্ন অংশের মেরামতি করা। লকডাউন বা লকডাউন পরবর্তী পর্যায়ে চলা এই আন্দোলনগুলিকে সরকার ভিড়ের অজুহাতে এবং সোস্যাল ডিস্ট্যান্সি-এর দোহাই দিয়ে এর দমন করতে চাইলেও, মানুষ যথেষ্ট সচেতন ভাবেই নিজেদের প্রতিষেধক ব্যবহার করে এবং সমগ্র বৈজ্ঞানিক বিধিনিষেধ মেনেই আন্দোলনে নেমেছে, আন্দোলনের ছবিতেও তা দেখা গেছে। এই আন্দোলনের ফলে সরকার বাঁধ মেরামতিতে নজর দিতে বাধ্য হয়েছে। 

প্রসঙ্গত, হাসনাবাদের বির্স্তীণ এলাকায় পৌছায়নি প্রয়োজনীয় ত্রাণ দ্রব্য, উপস্হিত হয়নি কোনো স্বাস্হ্যকর্মী থেকে ডাক্তার, এমনকী ভেঙে যাওয়া বাঁধ-এর মেরামতিতেও সরকারের তরফ থেকে কোনোরকম তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি। যার পরিপ্রেক্ষিতেই পিপল’স ব্রিগেডের নেতৃত্বে গ্রামবাসীদের এই আন্দোলন। পিপল’স ব্রিগেডের এই আন্দোলন  থেকে সমস্ত বামপন্থী দলগুলি শিক্ষা নিক, তাদের সাধু উদ্যোগকে সমর্থন করুক এবং নিজেদের খয়রাতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াইতে মনোনিবেশ করুক। সেটাই হবে কর্তব্য, সেটাই কাম্য। তবেই আগামী ২০২১-এ একটি বৃহৎ বিকল্প বাম ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করে উগ্র ফ্যাসিবাদী শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়!

সর্বশেষ যা বলা প্রয়োজন, তা হল বৈজ্ঞানিক ভাবে যেটুকু প্রতিষেধক নেওয়া প্রয়োজন তা কেন্দ্রীয় ভাবে বলা হলেও সমগ্র বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর ওষুধ আবিষ্কারের দিকে না ঝুঁকে ভ্যাকসিনের প্রতি মনোনিবেশ করার প্রবণতা দেখা  যাচ্ছে।  ভ্যাকসিন প্রকৃতপক্ষে যারা রোগাক্রান্ত নয় তাদের করোনার প্রকোপ থেকে কিছুটা রক্ষা করতে পারলেও আসলে মহামারী থেকে রক্ষা পেতে গেলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্থাৎ যাদের থেকে সংক্রমণ ঘটছে তাদের রোগনিরাময়কারী ওষুধ প্রস্তুত করাটাই এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি। আসলে ভ্যাকসিন একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা মাত্র যাকে ঘিরে বিশ্বের পুঁজিবাদী শক্তি সমগ্র বিশ্বে পু্ঁজিবাদী অর্থনীতির সঞ্চালন প্রস্তর স্হাপন করে ভগ্ন অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে ব্যস্ত। আর ঠিক সেই কারণেই কিউবার বিজ্ঞানীদের প্রস্তুত দুটি ড্রাগকে (যেটির একটি ইন্টারফেরন আলফা-২বি  সার্স, মার্স, ইবোলা প্রভৃতি ভাইরাস-এর শরীরে বৃদ্ধি রুখতে শরীরের অনাক্রম্যতার শক্তিকে আরো সজীব করে এবং দ্বিতীয়টি  বায়োমডিউলিনা-টি যা বয়স্কদের জন্য উপযোগী) মানুষের ব্যবহারে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন (হৃদরোগ উৎসেচক), রেমডেসিভির (ব্যয়বহুল আরেকটি ওষুধ ছাড়া কার্যকারী নয়) কিংবা ভ্যাক্সিনের গাল ভরা প্রচারে না মেতে উক্ত বৈজ্ঞানিক মতের পক্ষেও সরব হয়েছে পিপল’স ব্রিগেড।

বর্তমানে অনেক বাম দলই সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে রাস্তায় আন্দোলনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে পিপল’স ব্রিগেড-এর পথ অনুসরণ করেই আন্দোলনে ব্রতী হয়ে,  রাস্তায় নেমে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে না পারলে আগামী সময়ে মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবে, করোনা আদতে নির্মূল হবে না,  মানুষ তার প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ও ত্রাণ-এর অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, বিপুল সংখ্যক মানুষ আবারও কাজ হারাবে এবং কেন্দ্রীয় সরকার এন.আর.সি, এন.পি.আর., পরিবর্তিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন-এর মতো জনবিরোধী নীতিগুলি এই প্যান্ডেমিকের আড়ালে সহজেই পাশ করিয়ে নেবে। একে রুখতে রাস্তার আন্দোলনই একমাত্র ভরসা, আগামীদিনের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র আশার আলো।



Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার