অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনী: খেটে খাওয়ার স্বার্থের পরিপন্থী?
রিপোর্টঃ সাত্যকি দত্ত
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আগ্রাসন এবং দেশে করোনার লাগামছাড়া সংক্রমণ- এই দ্বৈত আঘাতে যখন সারা দেশে অর্থনীতির ভারসাম্য বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কুপ্রভাব এসে পড়ছে সাধারণ নাগরিকের ওপরেই। এই মুহূর্তে অশোধিত তেলের দাম কমতে থাকলেও পেট্রল-ডিজেলের দাম ক্রমবর্ধমান, রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমিয়ে ঘুরপথে দাম বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে। সারা দেশের সংযোগকারী প্রাণভোমরা রেলপথকে ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পথ নেওয়া হচ্ছে। আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের জনবিরোধী রূপ প্রকাশ্যে এসে পড়েছে, আর তার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ- কিছু দিন আগেই পাশ হয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনী।
১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন অনুযায়ী খাদ্যশস্য, ডাল, খাদ্যবীজ, তৈলবীজ, পেঁয়াজ ও আলুর মত কৃষিপণ্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকাভুক্ত ছিল। মূলতঃ খাদ্যশস্য নিয়ে কালোবাজারি বন্ধ করার জন্য এই আইনটি আনা হয়েছিল। বর্তমানে এই আইনটি সংশোধন করে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে, ফলে কৃষকরা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকারী, বড় পাইকার, রফতানিকারকদের সঙ্গে সরাসরি বন্দোবস্ত করতে পারবেন।
এই সংশোধনীর স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে এর ফলে কৃষকের কাছে বাজারের ব্যাপ্তি বাড়বে, ফলে তাঁদের আয়ের সম্ভাবনাও বাড়বে। এছাড়া এরই সাথে কৃষিপণ্য কেনার জন্য এপিএমসি লাইসেন্সও এই নতুন আইনের দ্বারা আর বাধ্যতামূলক নয়। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে মধ্যবর্তী দালাল বা ফড়িয়াদের দাপটও কমতে পারে, তাই কৃষকদের শোষিত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাওয়ার কথা। সাংবাদিক সম্মেলনে দেশের কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর জানান যে এই অর্ডিন্যান্স পাশ হয়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্যের বাধাহীন বাণিজ্যের সূচনা হবে।
এই সব গালভরা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন শস্য-মান্ডি থেকে অনেক সময়েই কৃষকরা অত্যন্ত স্বল্প-মূল্য পেতেন। খোলা বাজারে কোন সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তাঁরা যেমন বেশি দাম পেতে পারেন, একই সাথে তুলনামূলক অনেক কম দাম পাওয়ার সম্ভাবনাও থেকেই যায়। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে সংশোধনীর ফলে তালিকাভুক্ত সমস্ত শস্য উৎপাদন, মজুত, পরিবহন এবং বিক্রয় সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই সরকারের কোনো দায় থাকবে না। সম্পন্ন কৃষকরা এই নতুন ব্যবস্থায় কিছুটা লাভবান হতে পারলেও, প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকরা ন্যূনতম মূল্য না পেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন।
বর্তমানে ক্ষুদ্র কৃষকরা ঋণ শোধ করার জন্য ফসল ওঠার সময় অথবা তার আগেই ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ফলে অনেক সময়েই আন্তঃরাজ্য ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দাম দিতে ইচ্ছুক ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এই কারণে ছোট কৃষকদের জন্য সুলভ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা করা এবং তাঁদের কাছে সেই ঋণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। তা বাস্তবায়িত না হলে, আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যবস্থা ভাল মনে হলেও একজন ছোট কৃষকের পক্ষে বাজারের বেশি দাম নেওয়ার সুযোগ বাস্তবায়িত না হয়ে খাতায় কলমেই থেকে যেতে পারে।
সারা দেশের নানা কৃষক সংগঠন এই কারণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর প্রতিবাদ করেছে। তামিলনাড়ুর কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা জানান যে এই নতুন নিয়মে কৃষকরা বাজারের অনিশ্চয়তার দ্বারা প্রভাবিত হবেন, ফলে লাভবান হবে বহুজাতিক কর্পোরেট ক্রেতারাই। এর পরিবর্তে তাঁরা কৃষিঋণ মকুব এবং দরিদ্র কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুতের দাবি জানান।
এর সাথে সাথে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর দীর্ঘকালীন সামাজিক প্রভাব যে পড়বে তা অস্বীকার করা যায় না। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে মজুতের কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না কোনো প্রক্রিয়াকরণকারী, বা অন্য কোনো ক্রেতার জন্যই। এর ফলে কালোবাজারি ও মজুতদারি আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও আছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও আশা-আশঙ্কা দুই-ই আছে। এ রাজ্যে পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্য তেলের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম, ফলে অন্য রাজ্য থেকে তা নিয়ে এলে বাজারে দাম কমতেই পারে। আবার রাজ্যে আলুর উৎপাদন অনেক বেশি, তা যদি রাজ্যের কৃষক বাইরে বিক্রি করে দেন, তবে আলুর দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে পারে। তবে সব থেকে বড় যে প্রশ্নটি উঠে আসছে তা হল গণবন্টন ব্যবস্থা নিয়ে। বিহার নির্বাচনের ঠিক আগে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৮০ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশনের। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর ফলে যেসব খাদ্যশস্যের দাম বাড়বে, তা কি রেশন থেকে বাদ যাবে, নাকি এই ঘোষণা নিছক নির্বাচনী গিমিক- প্রশ্নের জবাব মিলছে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের নোটবন্দীর মত পরিকল্পনা দেশের অর্থনীতির ভীত সম্পূর্ণ দুর্বল করে দিয়েছে। এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর কি প্রভাব দেশের নাগরিক ও অর্থনীতির ওপর পড়বে, তা সময়ের সাথে পরিষ্কার হবে। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যতই এটিকে কৃষককল্যাণকামী পদক্ষেপ রূপে তুলে ধরার চেষ্টা হোক, দীর্ঘমেয়াদে এই আইন সংশোধনী কৃষক ও নাগরিক স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উঠতেই পারে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আগ্রাসন এবং দেশে করোনার লাগামছাড়া সংক্রমণ- এই দ্বৈত আঘাতে যখন সারা দেশে অর্থনীতির ভারসাম্য বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কুপ্রভাব এসে পড়ছে সাধারণ নাগরিকের ওপরেই। এই মুহূর্তে অশোধিত তেলের দাম কমতে থাকলেও পেট্রল-ডিজেলের দাম ক্রমবর্ধমান, রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমিয়ে ঘুরপথে দাম বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে। সারা দেশের সংযোগকারী প্রাণভোমরা রেলপথকে ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পথ নেওয়া হচ্ছে। আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের জনবিরোধী রূপ প্রকাশ্যে এসে পড়েছে, আর তার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ- কিছু দিন আগেই পাশ হয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনী।
১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন অনুযায়ী খাদ্যশস্য, ডাল, খাদ্যবীজ, তৈলবীজ, পেঁয়াজ ও আলুর মত কৃষিপণ্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকাভুক্ত ছিল। মূলতঃ খাদ্যশস্য নিয়ে কালোবাজারি বন্ধ করার জন্য এই আইনটি আনা হয়েছিল। বর্তমানে এই আইনটি সংশোধন করে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে, ফলে কৃষকরা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকারী, বড় পাইকার, রফতানিকারকদের সঙ্গে সরাসরি বন্দোবস্ত করতে পারবেন।
এই সংশোধনীর স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে এর ফলে কৃষকের কাছে বাজারের ব্যাপ্তি বাড়বে, ফলে তাঁদের আয়ের সম্ভাবনাও বাড়বে। এছাড়া এরই সাথে কৃষিপণ্য কেনার জন্য এপিএমসি লাইসেন্সও এই নতুন আইনের দ্বারা আর বাধ্যতামূলক নয়। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে মধ্যবর্তী দালাল বা ফড়িয়াদের দাপটও কমতে পারে, তাই কৃষকদের শোষিত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাওয়ার কথা। সাংবাদিক সম্মেলনে দেশের কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর জানান যে এই অর্ডিন্যান্স পাশ হয়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্যের বাধাহীন বাণিজ্যের সূচনা হবে।
এই সব গালভরা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন শস্য-মান্ডি থেকে অনেক সময়েই কৃষকরা অত্যন্ত স্বল্প-মূল্য পেতেন। খোলা বাজারে কোন সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তাঁরা যেমন বেশি দাম পেতে পারেন, একই সাথে তুলনামূলক অনেক কম দাম পাওয়ার সম্ভাবনাও থেকেই যায়। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে সংশোধনীর ফলে তালিকাভুক্ত সমস্ত শস্য উৎপাদন, মজুত, পরিবহন এবং বিক্রয় সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই সরকারের কোনো দায় থাকবে না। সম্পন্ন কৃষকরা এই নতুন ব্যবস্থায় কিছুটা লাভবান হতে পারলেও, প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকরা ন্যূনতম মূল্য না পেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন।
বর্তমানে ক্ষুদ্র কৃষকরা ঋণ শোধ করার জন্য ফসল ওঠার সময় অথবা তার আগেই ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ফলে অনেক সময়েই আন্তঃরাজ্য ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দাম দিতে ইচ্ছুক ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এই কারণে ছোট কৃষকদের জন্য সুলভ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা করা এবং তাঁদের কাছে সেই ঋণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। তা বাস্তবায়িত না হলে, আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যবস্থা ভাল মনে হলেও একজন ছোট কৃষকের পক্ষে বাজারের বেশি দাম নেওয়ার সুযোগ বাস্তবায়িত না হয়ে খাতায় কলমেই থেকে যেতে পারে।
সারা দেশের নানা কৃষক সংগঠন এই কারণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর প্রতিবাদ করেছে। তামিলনাড়ুর কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা জানান যে এই নতুন নিয়মে কৃষকরা বাজারের অনিশ্চয়তার দ্বারা প্রভাবিত হবেন, ফলে লাভবান হবে বহুজাতিক কর্পোরেট ক্রেতারাই। এর পরিবর্তে তাঁরা কৃষিঋণ মকুব এবং দরিদ্র কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুতের দাবি জানান।
এর সাথে সাথে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর দীর্ঘকালীন সামাজিক প্রভাব যে পড়বে তা অস্বীকার করা যায় না। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে মজুতের কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না কোনো প্রক্রিয়াকরণকারী, বা অন্য কোনো ক্রেতার জন্যই। এর ফলে কালোবাজারি ও মজুতদারি আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও আছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও আশা-আশঙ্কা দুই-ই আছে। এ রাজ্যে পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্য তেলের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম, ফলে অন্য রাজ্য থেকে তা নিয়ে এলে বাজারে দাম কমতেই পারে। আবার রাজ্যে আলুর উৎপাদন অনেক বেশি, তা যদি রাজ্যের কৃষক বাইরে বিক্রি করে দেন, তবে আলুর দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে পারে। তবে সব থেকে বড় যে প্রশ্নটি উঠে আসছে তা হল গণবন্টন ব্যবস্থা নিয়ে। বিহার নির্বাচনের ঠিক আগে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৮০ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশনের। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর ফলে যেসব খাদ্যশস্যের দাম বাড়বে, তা কি রেশন থেকে বাদ যাবে, নাকি এই ঘোষণা নিছক নির্বাচনী গিমিক- প্রশ্নের জবাব মিলছে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের নোটবন্দীর মত পরিকল্পনা দেশের অর্থনীতির ভীত সম্পূর্ণ দুর্বল করে দিয়েছে। এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনীর কি প্রভাব দেশের নাগরিক ও অর্থনীতির ওপর পড়বে, তা সময়ের সাথে পরিষ্কার হবে। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যতই এটিকে কৃষককল্যাণকামী পদক্ষেপ রূপে তুলে ধরার চেষ্টা হোক, দীর্ঘমেয়াদে এই আইন সংশোধনী কৃষক ও নাগরিক স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উঠতেই পারে।
Comments
Post a Comment