ভারতের কৃষি অর্থনীতির বর্তমান চরিত্র ঠিক কি?
সুমিত ঘোষ
ভারতবর্ষের কৃষি যে মূলত আধা-সামন্ততান্ত্রিক এ বিষয়ে এ
দেশের সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি একমত। তাদের কেউ কেউ এর সাথে কৃষি অর্থনীতির
চরিত্রকে আধা-পুঁজিবাদী বলে, আবার কেউ কেউ (মূলত নকশালপন্থীরা) একে আধা-ঔপনিবেশিক
হিসেবে চিহ্নিত করে। লক্ষণীয়, কৃষি প্রশ্ন এবং জাতীয় কংগ্রেসকে মূলত কেন্দ্র করেই
কমিউনিস্টদের এত ভাঙন। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ভারতের কৃষি অর্থনীতির বর্তমান চরিত্র আসলে
ঠিক কিরকম?
পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রাক্-সর্তটাই হল সমাজের দুটি
শ্রেণীতে বিভক্তিকরণ-এক, যাদের হাতে উৎপাদনের সকল উপায়-উপকরণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে
এবং দুই, যারা নিঃস্ব, নিজেদের শ্রম ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই। এই উৎপাদনের উপায়-উপকরণের
কেন্দ্রীভবনের জন্য প্রয়োজন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লুণ্ঠন, যাকে মার্ক্স ‘আদিম সঞ্চয়ন’
হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ দেশের সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টিই যেহেতু মনে করে যে কৃষি
ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক বা প্রাক্-পুঁজিবাদী অবস্থায় রয়েছে, ফলে কর্পোরেটদের
জমি লুণ্ঠন তাদের সামনে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ হিসেবেই প্রতিভাত হয়। যেহেতু সামন্ততন্ত্র
থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ ব্যতীত সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে আগুয়ান হওয়া সম্ভব নয়, তাই
সিপিআই(এম) এই সঞ্চয়ন প্রবণতাকে সমর্থন করে সিঙ্গুরে টাটার কারখানা প্রতিষ্ঠাকে ‘আদিম
সঞ্চয়ন’ হিসেবেই চিহ্নিত করতে শুরু করে। অন্যদিকে নকশালরা কর্পোরেটদের এই জমি
লুঠকে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ হিসেবেই চিহ্নিত করলেও, তারা এই প্রবণতার বিরোধিতা করে কমিউনিস্ট
ম্যানিফেস্টো-র রাশিয়ান সংস্করণের ভূমিকায় মার্ক্সের একটি অবস্থানকে পাথেয় করে
পুঁজিবাদকে টপকে সামন্ততন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর লাইনকে গ্রহণ করে টাটার
কারখানার বিরোধিতা শুরু করে।
কৃষিতে পুঁজির আগমনকে ধরেই নেওয়া হয় মার্কিন
ব্যবস্থাপনার মত অর্থাৎ বিরাটকায় ফার্মে বিপুল উৎপাদন, যন্ত্রপাতি ট্র্যাক্টরের
ব্যাপক ব্যবহার, মেকানিক্যাল শেড, বিপুল সংখ্যক মজুরের আনাগোনা ইত্যাদি। এই চিত্র
ভারতবর্ষে দেখতে পাওয়া না যাওয়ায় এ দেশের কৃষিকে প্রাক্-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা
হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আমাদের দেশের কৃষির প্রধান দুটি উপপাদ্য হলঃ (১) বিপুল
পরিমাণে জমি অধিগ্রহণ (২) কৃষি ‘অলাভজনক’ অর্থাৎ বস্তুগত উৎপাদনশীলতার (হেক্টর
প্রতি কত টন ফসল উৎপন্ন হল; অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাঃ বিনিয়োগ প্রতি কত প্রফিট হল)
দিক থেকে ঘাটতির ফলে শোধ না করতে পারা কৃষি ঋণের বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু ২০১৮ সালে
তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সংসদে ঘোষণা করেছিলেন যে সে বছর দেশে রেকর্ড
পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হয়েছে! এবং সেই বছরই সারা দেশজুড়ে সবচেয়ে বেশী কৃষক আন্দোলন,
দাম না পাওয়া ফসল পুড়িয়ে ফেলা এবং কৃষক আত্মহত্যার ছবি ফুটে ওঠে। ফলে, সত্যিই কি
উৎপাদনের দীনতাই বর্তমান সংকটের উৎস?
এর উত্তর খুঁজতে মার্ক্স ‘কিভাবে কৃষিতে পুঁজি কাজ করে’
বর্ণনা করেছিলেন, তা দেখতে হবে। অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশে পুঁজিবাদ জন্ম নিয়েছিল
কৃষির ভীতের উপর দাঁড়িয়ে। তাই অনেকে মনে করে মার্ক্স সেই কারণেই এই বর্ণনা
করেছিলেন কিন্তু তাই যদি হত, তাহলে এই আলোচনা কেন্দ্রীভূত হত পুঁজিবাদের শুরুর
দিকের ব্যাখ্যার অংশে। অথচ মার্ক্স এই বর্ণনা করেছেন ‘ক্যাপিটাল’-এর তৃতীয় খন্ডে। ‘ক্যাপিটাল’
রচিত হয়েছিল ঐতিহাসিক অগ্রগতি, বিবর্তন ও বিপ্লবকে ট্রেস করেই, ফলে মার্ক্সের কৃষিতে
পুঁজির কাজ করার বর্ণনা শুরু হয়েছিল পুঁজিবাদের উন্নত দশাকে কেন্দ্র করেই অর্থাৎ
যখন ‘গড় মুনাফার’ হার পুঁজিবাদী সমাজে মূল্য থেকে দামে রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছে। এই
সময়ে গড় মুনাফার হারের ভিত্তিতেই ফসলের দাম নির্ধারিত হতে শুরু করেছে।
ধরে নেওয়া যাক (কাল্পনিক), গড় মুনাফার হারের ভিত্তিতে এটা সামাজিকভাবে
নির্ধারিত যে ১ বিঘা জমিতে ১০০ টাকা বিনিয়োগে (শ্রমিকের মজুরী, অনাপেক্ষিক খাজনা
এবং আনুষঙ্গিক উপায়-উপকরণে ব্যয়িত) ২০ টাকা প্রফিট, ফলে ১ বিঘা জমি থেকে ১ কুই (কুইন্টাল)
চালের দাম ১২০ টাকা।
ফলে, উর্বরতার পার্থক্য জনিত বিভিন্ন ১ বিঘা জমির উপর ১০০
টাকা বিনিয়োগ প্রতি প্রফিট ও জমির মালিকের অতিরিক্ত পাওনা (আপেক্ষিক খাজনা):
জমির উপর ব্যাক্তি মালিকানার ভিত্তিতে জমির মালিক যে
খাজনা পেয়ে থাকে তা হল অনাপেক্ষিক খাজনা (সামন্ততন্ত্রের যুগে বিদ্যমান)। উপরের
উদাহরণে দেখা যাচ্ছে যে জমির উর্বরতার তারতম্যের ভিত্তিতে ক্ষেত মজুরের শ্রমশক্তি
নিয়োগে উদ্ভূত উদ্বৃত্তের একাংশ (গড় মুনাফার হার অনুযায়ী সামাজিকভাবে নির্ধারিত) যায়
বিনিয়োগকারীর কাছে তার প্রফিট হিসেবে এবং বাকিটা জমির মালিকের কাছে যায় আপেক্ষিক
খাজনা (উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার খাজনা কারণ মূল্য থেকে দামে রূপান্তরের জন্য তা
উদ্ভূত) হিসেবে। ফলে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক কৃষিতে থাকেনা। পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় কৃষিতে 'জমির মালিক-বিনিয়োগকারী-মজুর' সম্পর্ক কাজ করে, যাকে বলা হয় ট্রিনিটি
ফর্মুলা বা ত্রিযোজী সূত্র। উক্ত সূত্রে সবসময়ে যে ন্যূনতম তিনজন থাকবে এমন
নয়। কখনও জমির মালিক নিজেই ক্ষেত মজুর, কেবল বিনিয়োগকারী আলাদা; কখনও বিনিয়োগকারী
নিজেই ক্ষেত মজুরী করছে... অর্থাৎ ন্যূনতম দুইজনের ভিত্তিতেও এই ত্রিযোজী সূত্র
বিদ্যমান। জমির থেকে জমির মালিকের আয়ের খুব কম অংশই ফিরে আসে জমিতে বা কিছুই আসে
না।
এই ত্রিযোজী সূত্রর প্রাথমিক আবিষ্কারক রিকার্ডো। জমির
এই উর্বরতার পার্থক্য আলাদা আলাদা জমিতে যেমন দেখা যায়, তেমনই একই জমিতেও বিভিন্ন
সময়ে দেখা যায়। ফলে, রিকার্ডো এই আপেক্ষিক খাজনা জমির উর্বরতার তারতম্যের জন্যই
তৈরি হয়েছে বলে ধরে নিয়েছিলেন। জমির উর্বরতা নিজে থেকেই হ্রাস পাওয়ার ভিত্তিতে
অর্থাৎ প্রকৃতির উপরেই আপেক্ষিক খাজনার বিলোপের দায়ভার চাপিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু
মার্ক্সই প্রথম আপেক্ষিক খাজনার অর্থনৈতিক উৎস ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান যে উন্নত
পুঁজিতন্ত্রে গড় মুনাফার হারের ভিত্তিতে অর্থাৎ মূল্য থেকে দামে রূপান্তরের জন্যই
এই খাজনার উৎপত্তি।
আপেক্ষিক খাজনা কেবল জমির উর্বরতাই নয়, তার এলাকাগত
অবস্থান, যানবাহনের সুবিধা ইত্যাদির উপরেও নির্ভর করে এবং এই প্রত্যেক পরিমাপ
শেয়ার বাজারের ফাটকা কারবারেও পরিগণিত হয়।
এই উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যাঙ্কের দাপট অর্থাৎ
ফিনান্স পুঁজির কর্তৃত্ব জমির দাম নির্ধারণকে প্রভাবিত করছে। ধরে নেওয়া যাক,
একজন জমির মালিক ১০ হাজার টাকা আপেক্ষিক খাজনা পায়। কত টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে সে ওই ১০
হাজার টাকা ৫% সুদ হিসেবে পাবে, তা যদি হয় ২ লক্ষ টাকা, তাহলে সেই জমির দাম হবে ২
লক্ষ টাকা। অর্থাৎ জমির দাম উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গড় মুনাফার হার, অনাপেক্ষিক
খাজনা এবং ফিনান্স পুঁজি মারফৎ জমির মূল্যায়ণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শেয়ার মার্কেটের ফাটকা কারবার
প্রভাবিত করে ফসলের দামকে। কৃষকরা সেটা উপলব্ধি করেন একই সপ্তাহের দুটো আলাদা দিনে
ফোঁড়েদের বাজারে আলাদা দামে ফসল বিক্রী হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
কেন্দ্র সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট পুঁজির
বিনিয়োগের ১০ ভাগের ১ ভাগ কৃষিতে ঢুকেছে কিন্তু সেই বিনিয়োগ বেড়েছে গুণিতক হারে
অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা থেকে বিনিয়োগ বেড়ে পৌঁছেছে ১ লক্ষ
কোটি টাকায়। ২০১০-২০১১র আদমসুমারি অনুযায়ী ৬৭% ১ হেক্টরের কম জমির মালিকদের হাতে
রয়েছে ২২% জমি আর ৫% ৪ হেক্টরের বেশী জমির মালিকদের হাতে রয়েছে ৩২% জমি। ফলে জমির
সিলিং ৪ হেক্টর বা ৩০ বিঘায় নামিয়ে নতুন করে ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা
দিয়েছে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার কৃষি জমির পরিমাণের ৮১% ১০ হেক্টরের
বেশী হলেও, মোট প্রতিষ্ঠান সংখ্যার ৫৮% ১ হেক্টরের কম জমিতে চাষ করাচ্ছে। ১০
হেক্টরের বেশী আয়তনের জমিতে প্রাতিষ্ঠানিক মালিকনার সংখ্যা ২০ হাজার কিন্তু ১
হেক্টরের থেকে ছোট আয়তনের জমিতে প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সংখ্যা ১ লক্ষ ৪০ হাজার।
অর্থাৎ ছোট জমি বেশী প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানা আকর্ষণ করছে। পেপসি-কোকাকোলার মত
কোম্পানি ছোট জমিতে সবজি চাষ করাচ্ছে। ফলে, বড় জমি মানেই সামন্ত-প্রভু আর ছোট জমি
মানেই ছোট পুঁজি, এই ধারণা ভুল।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ‘কৃষি অলাভজনক’-এর আসল অর্থ হল
বিনিয়োগের অভাবে ফসলের দাম হ্রাস। ২০২০-র বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ কৃষিতে ব্যাপক কর্পোরেট বিনিয়োগের কথা বলেছে। এই কর্পোরেট বিনিয়োগের স্বরূপ
ঠিক কিরকম? কর্পোরেটরা জমির দাম বা অ্যাসেট প্রাইসকে শেয়ার বাজারের ফাটকায় লাগাতে
উদ্যত। সেই কারণেই টাটারা সিঙ্গুরের দুই কিংবা তিন ফসলী জমিতেই কারখানা করার
পরিকল্পনা করে। ১০০০ একরের ৬০০ একরে কারখানা করলেও বাকি ৪০০ একরে তারা রিয়াল
এস্টেট-এর পরিকল্পনা করে। নিজেদের জমির আপেক্ষিক খাজনা বাড়ানোর জন্য তারা সরকারী
উদ্যোগে হাইওয়ে বানিয়ে দেওয়ার দাবী রাখে। সিঙ্গুরে কারখানা বাস্তবায়িত না হলে
টাটারা চলে যায় গুজরাটের সানন্দের তিন ফসলী জমিতে। ন্যানো কারখানা বাজারে বিশেষ
গুরুত্ব না পেলেও টাটারা জমির মালিকানা থেকেই শেয়ার বাজারে কোটি কোটি কামিয়ে নেয়।
উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছিল
সামন্ততন্ত্রের ভীতের উপর কিন্তু ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে পুঁজিবাদের জন্ম
হয় সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বে। ফলে, উন্নত পুঁজিবাদী দেশে সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে
উত্তরণের জন্য বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু এই দেশে সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্বেই
পুঁজিবাদ জন্ম নেওয়ায় সেই বিপ্লব সরাসরি চোখে পড়েনি। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির পুঁজির
রপ্তানি অর্থাৎ এই দেশে বিনিয়োগ করে এখান থেকেই উদ্বৃত্ত শুষে নেওয়ার ফলে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামন্ততন্ত্রের ভীতের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্বের ফলেই
বৈপ্লবিক পথ উপেক্ষা করে এখানে পুঁজিবাদ জন্ম নিয়েছে।
আমাদের দেশের বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা পূর্ণ পুঁজিবাদী
কর্তৃত্বে চলছে। দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ লক্ষণীয়। অর্থনীতি পুঁজির কর্তৃত্বে চললেও
সামন্ততান্ত্রিক সাংস্কৃতিক অবশেষ নতুন কিছু নয়, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্রিটেনে
পুঁজিবাদের বিকাশের পরেও রাজপরিবারের আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব।
পাঠকদের বিষদে পড়তে হলেঃ
১। মার্ক্সের অর্থনৈতিক মতবাদের ক্রুশবিদ্ধ অংশঃ
আজকের শোষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি প্রস্তাবনা বাসুদেব নাগ চৌধুরী, জবরদখল
পত্রিকা, ৫ই মে ২০২০
২। ভারতের কৃষি উৎপাদনের চরিত্র –সামন্ততান্ত্রিক না
পুঁজিবাদী? জবরদখল পত্রিকা, সংখ্যা ৮, ১৭ই নভেম্বর ২০১৪
Comments
Post a Comment