অসমে বন্যাঃ সমস্যাটা আসলে কোথায়?

রিপোর্টঃ প্রিয়াংশু দে 

অসম ভারতের সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ রাজ্য। প্রত্যেক বছর অসমবাসীদের ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। অসমে অত্যাধিক পরিমাণে বন্যা হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হল ব্রহ্মপুত্র নদীর বিক্ষিপ্ত প্রবাহ।একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে ১৯৫০ সালে ঘটিত একটি ভূমিকম্পের পর থেকে ব্রহ্মপুত্র আরও বিক্ষিপ্তভাবে বইতে শুরু করেছে। ১৯৫০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অসমে মোট ১২ বার বড়ো  বন্যা হয়েছে। কিন্তু ২০১২ থেকে প্রায় প্রত্যেক বছরই বন্যা হচ্ছে।  বন্যার সংখ্যা এক লাফে এতটা বাড়ার পেছনে কারণ গুলি হল অরণ্যবিনাশ, জলবায়ু পরিবর্তন,অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অদক্ষতার সহিত এমব্যাঙ্কমেন্ট ব্যবহার। 

এবার প্রথমেই যেই প্রশ্নটা মাথায় আসার কথা তা হল এমব্যাঙ্কমেন্ট কী? এমব্যাঙ্কমেন্ট হল নদীর দুই ধারে নির্মিত দেওয়াল বিশেষ যা নদীকে নির্দিষ্ট দিকে বইতে সাহায্য করে, নদীকে প্রবাহমান  রাখে এবং অত্যাধিক বৃষ্টি হলে নদীর জলকে বাইরে বেরোতে দেয়না। এমব্যাঙ্কমেন্ট কংক্রিট ও মাটি দুইয়ের দাড়াই তৈরী হতে পারে।  এমব্যাঙ্কমেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিপুণতা প্রয়োজন। সামান্য একটা ভুল হলেও এমব্যাঙ্কমেন্ট ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইজন্য এমব্যাঙ্কমেন্টের ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত কথা হল, "An embankment is as strong as it's weakest point"। নদীর দুই ধারে এমব্যাঙ্কমেন্ট তৈরি করলে নদীর প্রবাহের ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় নদীর গতি ও নদীর মধ্যে জলের ঘনত্ব বাড়ার ফলে এমব্যাঙ্কমেন্ট ভাঙার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অধঃক্ষেপণ পদ্ধতিতে নদীতলে পলি থিতিয়ে সঞ্চিত হয়ে নদীর জলতল বৃদ্ধি পেয়ে এমব্যাঙ্কমেন্টের উপর দিয়ে জল উপচে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে। এমব্যাঙ্কমেন্টের গায়ে একটা ছোট ছিদ্র হলেও এমব্যাঙ্কমেন্ট সহজেই জল ধরে রাখতে ব্যার্থ হয়ে যায়। তাই এমব্যাঙ্কমেন্টের প্রচুর যত্ন নিতে হয় এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। 

অসমে নদীর ধারে প্রায় ৪৫০ টি এমব্যাঙ্কমেন্ট আছে। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি অযত্নের ফলে খুব খারাপ অবস্থায় আছে এবং যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। অসমে বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য এমব্যাঙ্কমেন্ট ব্যাবহারের পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। উল্টে এমব্যাঙ্কমেন্ট প্রয়োগ বন্যাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। অযত্নের ফলে দুর্বল এমব্যাঙ্কমেন্ট জল ধরে রাখতে না পেরে ভেঙে গিয়ে আশেপাশের এলাকা প্লাবিত করছে আবার নদীতলে ড্রেসিং এর অভাবে অধিক পরিমাণে পলি সঞ্চিত হয়ে জল উপচে পড়ছে। এই বছরের বন্যায় অসমের ১৯৭ এর বেশি এমব্যাঙ্কমেন্ট ধ্বংস হয়েছে। 

তাহলে অসমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় কী?  উপায় লুকিয়ে আছে নেদারল্যান্ডসের বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়ের মধ্যে। নেদারল্যান্ডস  বন্যা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর সবচেয়ে  সফল দেশ। তাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সফল প্রকল্প হল "Room for River" প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টে তারা কৃত্রিমভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে নদীর নিজস্ব গতিবিধি ও প্রাকৃতিক প্রবাহের দিক, ধরন ও গতির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে তারা খুব সস্তায় ও সহজ উপায়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়। উন্নত প্রযুক্তিকে তারা এমনভাবে ব্যবহার করেছে যাতে নদীর স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট না হয়। উন্নত সেন্সার ব্যবহার করে তারা নদীর গতিবিধির ওপর নজর রেখেছে। প্রথমত তারা এমব্যাঙ্কমেন্টগুলোকে নদী থেকে একটু দূরে প্লাবনভূমির মধ্যে তৈরি করে ফলে নদীর প্রবাহের ক্ষেত্র কমে যায়না এবং নদী স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয়। দ্বিতীয়ত তারা প্লাবনভূমির মধ্যে গাছ লাগিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি প্রাকৃতিক দেওয়াল তৈরি করে। তৃতীয়ত তারা নিয়মিত নদীতলে ড্রেসিং করে নদীতে পলির পরিমাণ কমিয়ে নদীজলতল কমায়। চতুর্থত প্লাবনভূমিতে খনন করে প্লাবনভূমির উচ্চতা নদীতলের উচ্চতা থেকে কমিয়ে দেয় যাতে নদী প্রবাহের জন্য বেশি জায়গা পায়। এছাড়া নদীতলে খনন করে নদীর জল ধারণের জন্য বেশি জায়গা তৈরি করা এবং  নদীতীরবর্তী অঞ্চলে রিসার্ভার তৈরি করে বন্যার জল ধারণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। উক্ত পদ্ধতিগুলি সহজেই অসমের বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যায়। এতে যেমন কম খরচে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তেমনি নদী ও তার আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা যাবে।

অসমে বন্যানিয়ন্ত্রনে সমস্যার মূল কারণ হল এমব্যাঙ্কমেন্টের প্রতি অত্যাধিক নির্ভরতা। তার উপর বেশিরভাগ এমব্যাঙ্কমেন্টগুলিই ভগ্ন দশায় রয়েছে। এইবছর Assam State Disaster Management Authority এমব্যাঙ্কমেন্ট  রিপেয়ার করার জন্য State Disaster Relief Fund এর থেকে টাকা বরাদ্দ করলেও বর্ষা শুরু হওয়ার পরও রিপেয়ারের কাজ শুরু হয়নি। 

এইবছর অসমে ভারী বৃষ্টির ফলে মে মাস থেকে বন্যা শুরু হয়। সেইসময় প্রায় ৩০,০০০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ৫ টি জেলাজুড়ে প্রচুর পরিমাণে ফসল নষ্ট হয়। জুন মাস পর্যন্ত ২৭ জেলার  ২-৩ মিলিয়ন মানুষের ভারীমাত্রায় ক্ষতি হয়েছে এবং ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৩০০০ গ্রাম জলের তলায় আছে, ১.২৮ লাখ হেক্টর কৃষিক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৪৪ হাজার মানুষ ত্রাণ শিবিরে রয়েছে। বারপেতা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল।

বন্যার ফলে কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের মোট ১২৯টি প্রাণীকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ১৪টা গন্ডার, ৫ টা বণ্য মহিশ, ৮ টি বণ্য শূকর, ২ টি জলাভূমির হরিণ, ৯৫ টা হগ ডিয়ার, ১ টা সামবার, ৩ টি পর্কিউপাইন ও ১ টি পাইথনকে উদ্ধার করা গেছে।

অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল বলেছেন কেন্দ্রীয় সরকার এই বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য North-East Water Management Authority তৈরি করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। সেই অনুযায়ী পরবর্তী পার্লামেন্টারি সেশনে একটি অর্ডিন্যান্স পাস করা হবে। কিন্তু আদতে যেই প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে তা মূলত জলসম্পদ বন্টন কেন্দ্রীক। ফলে এমব্যাঙ্কমেন্ট গুলোকে সশক্ত করা বা বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণের আদেও কোনো প্রচেষ্টা হচ্ছে না।

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!