লেবাননের বিস্ফোরণ ও অর্থনৈতিক সংকট

রিপোর্টঃ প্রিয়াংশু দে
বর্তমানে লেবানন জুড়ে চলতে থাকা অস্থির পরিস্থিতির জন্য নিঃসন্দেহে পূর্বতন সাদ হারিরি সরকারের নয়াউদারবাদী পদক্ষেপ দায়ী। হারিরির ফিউচার মুভমেন্ট পার্টির সরকারের মিতব্যয়ী অর্থনীতি ও দেশজুড়ে চলতে থাকা চরম বেকারত্বের ফলে লেবাননবাসী অতিষ্ট হয়ে আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছিল। বর্তমান হাসান ডিয়াবের সরকারও একই পথের পথিক। এছাড়াও অত্যাবশকীয় ইন্টারনেট, ফোন কল, গ্যাসোলিন এবং তামাকজাতীয় পণ্যের ওপর সরকারের অত্যাধিক কর চাপানো আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। বর্তমানে লেবানন রিসেশনে প্রবেশ করেছে এবং তার ফলেই এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। গ্রীসের মতোই লেবাননের ব্যাঙ্কগুলি দেউলিয়া হওয়ার পথে এগিয়েছে । যেখানে লেবাননের রেভেনিউ ১২ বিলিয়ন ইউ.এস ডলার সেখানে দেশের ওপর ঋণের পরিমাণ ৮৪ বিলিয়ন ইউ. এস ডলার যা দেশের জিডিপির প্রায় ১৪৯%। এই ঋণের ৮৫% বহন করছে দেশের কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কগুলি। শেয়ার বাজারের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তারের জন্য তারা যে বন্ডগুলি ছেড়েছিল সেই পরিমাণ অর্থ তারা ফিরে পাচ্ছে না। ফলে  পাবলিক সেক্টরের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। রিসেশনের ফলে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে। প্রায় ৩ লক্ষ্য ১০ হাজার কর্মক্ষেত্র কাজ হারিয়ে বন্ধ হওয়ার পথে। প্রায় ১ লক্ষ ৫ হাজার মানুষ পেনশন সহ বিভিন্ন রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট হারাতে বসেছে। এই অর্থনৈতিক সংকটের ফলে যে আন্দোলনের পথে মানুষ পা বাড়িয়েছে তা দমনের জন্য সরকার ২০,০০০ মিলিটারি নিয়োগ করেছে। ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়ানোর ফলে জাতীয় লগ্নি ক্ষমতা লোপ পেয়েছে এবং দেশে চরম মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়েছে। কিছু শর্তের বিনিময়ে আইএমএফ লেবাননে অর্থ ইনভেস্ট করার জন্য প্রস্তুত হয়। সেই শর্তগুলি হল পেনশন বন্ধ করতে হবে, নতুন ভাবে কাউকে কাজে নিয়োগ করা যাবেনা, বিদ্যুৎ পরিষেবায় সরকারের প্রদেয় ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ ১.৫ বিলিয়ন  মার্কিন ডলার বন্ধ করতে হবে। 

মধ্যযুগে লেবাননে মূলত ম্যারোনাইট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করত। পরবর্তীকালে সেখানে ড্রুজ সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমানদের প্রবেশ ঘটে। এই দুই সম্প্রদায় একে অপরের প্রতি পারস্পরিক প্রীতি রেখে সেখানে দীর্ঘকাল বসবাস করে। এরপর লেবানন দীর্ঘকাল প্রথমে মূলত খ্রিস্টান ধর্মালম্বী রোমান সাম্রাজ্য এবং পরে মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর লেবানন সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হয়। এরপর দীর্ঘকাল ফ্রান্সের উপনিবেশ থাকার পর ১৯৪৩ সালের ২২শে নভেম্বর লেবানন স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতাকালে লেবাননে মূলত ম্যারোনাইট খ্রিস্টান, সুন্নি মুসলমান, শিয়া মুসলমান ও ড্রুজ সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমানদের বসবাস ছিল। লেবাননের বেশিরভাগ অংশেই সুন্নি মুসলমান ও ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। এছাড়া দক্ষিণাংশে শিয়া, পাহাড়ি অঞ্চলে ড্রুজ জনজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়। সংবিধান রূপায়নের মাধ্যমে লেবাননে "Confessionalist Parliament"-এর প্রতিষ্ঠা হয়। এই পার্লামেন্টারি গঠনে দেশের প্রেসিডেন্ট একজন ম্যারোনাইট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী একজন সুন্নি মুসলমান আর পার্লামেন্টের স্পিকার একজন শিয়া মুসলমান হবেন বলে ঠিক হয়। ব্রিটেনের মদতে প্যালেস্টাইন ভেঙ্গে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের বাকী অংশ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে বহু প্যালেস্টিনিয়দের নিজদেশ ত্যাগ করে লেবাননে শরণ নিতে হয়। তারা লেবাননের রাজনীতিতে দখল না দিয়ে নিজেদের দেশ ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে ব্রতী হলেও, এই ঘটনাকে ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের অভিজাতরা মেনে নিতে পারে না। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় লেবাননের খ্রিস্টান সম্প্রদায় সর্বদা পশ্চিমী দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির পক্ষপাতিত্ব করেছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ কমিউনিস্ট ব্লকের পাশে থেকেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ঠান্ডা যুদ্ধের মত এক্ষেত্রেও একই ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। এহেন পরিস্থিতিতে ১৯৭৬ সাল নাগাদ লেবাননে এক গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই যুদ্ধে চারটি গোষ্ঠী লক্ষ্য করা যায়। প্রথম গোষ্ঠীর সদস্যরা হল খ্রিস্টান ধর্মালম্বী Lebanese Front এবং Army of Free Lebanon নামে দুটি সংগঠন। ইসরায়েল এদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্যালেস্টিনিয়দের দেশ থেকে বিতাড়িত করা এবং দেশে খ্রিস্টান আধিপত্য লাভ। দ্বিতীয় গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য হল প্যালেস্টাইনের মুক্তির জন্য যুদ্ধরত Palestine Liberation Organization (PLO), যার নেতা হলেন ইয়াসির আরাফাত। এদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিজবুল্লা এবং লেবাননের কমিউনিস্টদের একাংশ যুক্ত হয়। শিয়া মুসলমানদের ওপর  সুন্নি মুসলমানদের অত্যাচার বন্ধ করাই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য। তৃতীয় গোষ্ঠীতে ছিল সিরিয়া, হিজবুল্লার একাংশ। দেশে নিজেদের অবস্থা মজবুত করবার জন্য এরা যুদ্ধে নামে। চতুর্থ গোষ্ঠীতে ছিল লেবাননের শাসকবর্গ। এদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, সৌদি আরব এবং তাদের মিত্র শক্তিরা যোগ দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত লেবাননের রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের আশায় এই যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৯৮ সালে এই গৃহযুদ্ধ তাইফ চুক্তির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে PLOকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়, পার্লামেন্টে খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে আসন বন্টনের অনুপাত ৫৫ঃ৪৫ থেকে ৫০ঃ৫০ করা হয়, সুন্নি মুসলমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পূর্বের থেকে বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আগের মতোই ম্যারোনাইট খ্রিস্টান প্রেসিডেন্ট নিজপদে আসীন থাকেন। ইসরায়েল ও সিরিয়া দীর্ঘসময় ধরে লেবাননের বেশিরভাগ অংশ দখল করে রাখে; বর্তমানে তারা সেনা প্রত্যাহার করেছে। ফলে, ধর্মীয় সমঝোতার মাধ্যমে সর্বদা দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর রাজত্ব কায়েম থাকে এবং তাদের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির ফলে লেবাননে জীবন ধারণের মান আজ তলানিতে। বর্তমানের এই অর্থনৈতিক সংকটের জন্যও এই দক্ষিণপন্থী নীতিগুলিকেই এককথায় দায়ী করা যায়।  গত ৪ঠা আগস্ট বেইরুট বন্দরে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের ফলে বন্দর সংলগ্ন শহরের অংশের  প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি  হয়। প্রায় ১৩৭ জনের মৃত্যু ঘটে এবং প্রায় ৭০০০ জন গভীরভাবে আহত হন। এই বিস্ফোরণের ফলে বেইরুটে প্রায় ১০-১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। প্রায় ৩০০,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। লেবাননে চলতে থাকা আর্থিক দুর্গতিকে এই ঘটনা আরো ত্বরান্বিত করেছে। সরকার ও হিজবুল্লা এই ঘটনার দায়  নেওয়া থেকে বিরত থাকে। ওই বন্দরের একটি গুদামঘরে মজুত ২৭৫০ টন ammonium nitrate বিস্ফোরিত হয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ৬ বছর আগে এক রুশ জাহাজ MV Rhosus জর্জিয়া থেকে মোজাম্বিক যাওয়ার পথে অর্থাভাবে বেইরুট বন্দরে তার জিনিসপত্র নামায়। ওই জাহাজের থেকেই এই বিস্ফোরক নামিয়ে গুদামঘরে রাখা হয়। এই দীর্ঘ ৬ বছর বিস্ফোরক ওই গুদামেই ছিল। এর থেকে লেবানন সরকারের অবহেলা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের নজির পাওয়া যায়। দিনের পর দিন এভাবে লেবাননের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের দলগুলির নিষ্ক্রিয়তার ফলে এই দক্ষিণপন্থী সরকার এবং তাদের সহযোগী শক্তিগুলো সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে মারণ খেলা খেলছে। ভারতে বিজেপি সরকার লেবাননের উদাহরণ দেখিয়ে নাগরিকত্ব আইনে বদল আনতে চাইছে এবং NRC, CAA, NPR ইত্যাদি রূপায়ণের চেষ্টা করছে। তাদের বক্তব্য, লেবাননে যেভাবে মুসলিম শরনার্থীরা প্রবেশ করে সেখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে সেভাবে আমাদের দেশে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি মুসলিম শরনার্থীরা প্রবেশ করে এখানের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। রোহিঙ্গারা আসলে মায়ানমারের নিবাসী এবং সেখানে অত্যাচারিত হয়ে তারা অন্যান্য দেশে শরণ চাইছে আর বাংলাদেশি মুসলিমরা আমাদের দেশে প্রবেশ করে তাদের আর্থিক দুুুরাবস্থার জন্য। কিন্তু শরনার্থী প্রবেশ যদি সত্যিই রোধ করতে হয় তবে বর্ডার সিল করুক। কিন্তু তা না করে এভাবে দেশের নাগরিকত্ব আইনে বদল এনে সরকার আসলে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শরণার্থীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের সস্তা মজুরে পরিণত করতে চাইছে যা মানবতার বিরোধী।

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার