আন-অর্গানাইজড সেক্টরগুলোতে রয়েছে আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ - সেই ইঙ্গিতই কী দিয়ে গেল গিগ ওয়ার্কার্সদের আন্দোলন


রিপোর্টঃ নিমো 
দেশের বিভিন্ন অংশে ফুড ডেলিভারি কর্মীদের বিক্ষোভ ইতিমধ্যেই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। মূলত প্যান্ডেমিকের দরুণ ব্যবসায়িক ক্ষতির দোহাই দিয়ে,  ডেলিভারি রেট ও অন্যন্য ইন্সেন্টিভ অতিমাত্রায় কমিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় হরতাল । 

সুইগি কতৃপক্ষের তরফ থেকে ঘোষণা মারফত, ১০ই অগস্ট-এর পর থেকে কর্মীদের ডেলিভারি প্রতি পেমেন্ট ৩৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকায় নামিয়ে আনা হয় এবং একইসাথে সাপ্তাহিক ও মাসিক ইনসেন্টিভ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার পর পরই গত ১৪ই অগস্ট চেন্নাইতে প্রতিবাদে নামেন কর্মীরা যার প্রভাব খুব তাড়াতাড়িই   দিল্লী,  কোলকাতা,  হায়দ্রাবাদ সহ বিভিন্ন শহরের  কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ২০শে অগস্ট সাউথ দিল্লির কর্মীরা এই জুলুমবাজির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে বাইকর‍্যালি বা প্রতিবাদ অবস্থান করে বিক্ষোভ প্রকাশ করার পরে প্রতিবাদের রেশ আরো বাড়তে থাকে। গত ২২শে অগস্ট কোলকাতার ফুড ডেলিভারি কর্মীরাও একত্রিত হয়ে মিলিতভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

১০ই অগস্ট-এর আগে প্রদেয় পেমেন্ট রেট ফিরিয়ে আনতে হবে; অবিলম্বে মাসিক ইনসেন্টিভ চালু করতে হবে;কাস্টোমার এর দেওয়া রেটিং এর ওপর অডিট এর কারসাজি বন্ধ করতে হবে, মূলত এই তিনদফা দাবী নিয়ে এই আন্দোলন শুরু হলেও বিভিন্ন অংশের আন্দোলন এগনোর সাথে সাথে কেন্দ্র সরকারকে পেট্রলের দাম নিয়ন্ত্রণ, কোভিড পরিস্থিতিতে বাইকের ই.এম.আই. নিয়ে ব্যাঙ্কের তাগাদা বন্ধ করা, কর্মীদের কোভিড বিমার ব্যবস্থা করা এই সমস্ত দাবীও উঠে এসেছে। তাদের দাবীদাওয়া শোনার বা আলোচনা করার পরিবর্তে ফুড ডেলিভারি সংস্থাগুলোর চিরাচরিত আইডি ব্লকের পথকেই বেছে নিয়েছে সুইগি! 

বিক্ষুব্ধ কর্মীরা জানাচ্ছেন  উপভোক্তা এবং কর্মচারী উভয়কেই ঠকাচ্ছে সুইগি। একদিকে যেমন কাস্টোমারের জন্য ডেলিভারি চার্জ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ডেলিভারি প্রতি পেমেন্ট। কাস্টোমার রিসিট ৪৫ টাকা দেখিয়ে কর্মীদের দেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। গোটা লকডাউন পিরিয়ড জুড়েই করোনা ভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও পরিষেবা দেওয়ার পরিবর্তে অতিরিক্ত তো কিছু আসেইনি উলটে ক্রমাগত কমতে থেকেছে এদের পেমেন্ট। লকডাউন চলাকালীন মার্চ মাস থেকেই কিলোমিটার প্রতি রেট কমতে কমতে আজ এসে দাঁড়িয়েছে ৫ টাকায়। কিলোমিটারকে প্যারামিটার রাখার পরিবর্তে মিনিট প্রতি ১ টাকা ধার্য্য করে দেওয়ার মাধ্যমে পূর্বে যে অর্থ ১ কিমি দূরত্বে ডেলিভারি পৌঁছলেই পাওয়া যেত সেই অর্থ উপার্জন করতে ডেলিভারি কর্মীদের ৩ কিমি যেতে বাধ্য করছেন সুইগি কর্তৃপক্ষ। এমনকী রেস্টুরেন্ট খাবারের জন্য গড় ওয়েট টাইম কমিয়ে এবং একইসাথে সফল ডেলিভারির শেষে দেওয়া ৫ টাকা বোনাস ও বন্ধ করে দেওয়ার ফলে পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়ে ফুড ডেলিভারি কর্মীদের। এর সাথে প্রত্যহ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডেলিভারির বরাত না পাওয়া, পরপর দুটো অর্ডারের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্ব, বাইকের ই.এম.আই-এর চাপ এর মতো বরাবরই চলতে থাকা সমস্যাগুলি যুক্ত হয়ে কর্মীদের অবস্থা এমনই দুর্বিষহ করে তোলে যে কিছু কর্মীর কাছে সংসার চালানো তো দূর উলটে সপ্তাহ শেষে পেট্রল এর দাম তোলাটাই প্রশ্নচিহ্ন তুলেছে। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাতকারে এক কর্মী তো জানান যে ২ কিমি দূরত্ব গিয়ে ডেলিভারি দেওয়ার পরও তার জুটেছে মাত্র ১২ টাকা! এছাড়াও রাত ১২ টার পর করা ডেলিভারিতে বা ঝড়-বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেওয়া ডেলিভারিতে পূর্বে দেওয়া অতিরিক্ত প্রদেয়ও সময়ের সাথে বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্তভাবে তুলে নেওয়া হয়। ক্রমাগত এই নিষ্পেষণ এর চাকায় পিষতে পিষতে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবীতে প্রতিবাদের পথকেই বেছে নেন ফুড ডেলিভারি কর্মীরা।

অল ইন্ডিয়া গিগ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ( AIGWU ) নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সারা দেশব্যাপী নির্দিষ্ট দাবীতেই সংগঠনের ব্যানারেই বিক্ষোভে সামিল হন আন্দোলনকারীরা। সুইগী কর্মীরা এই আন্দোলন শুরু করলেও AIGWU-এর দাবী কিন্তু সুইগির ভেতরকার সমস্যাকে উত্তীর্ণ করে জোম্যাটো, সুইগী, ফুডপান্ডা, ওলা, ঊবের, ফ্লিপকার্ট প্রভৃতি অনলাইন পরিষেবা সংস্থাগুলির নিজেদের কর্মীদের ওপর শোষণের নগ্নরূপকে প্রকাশ্যে এনেছে এবং এই প্রতিটি সংস্থার কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছে। পূর্বে বিক্ষিপ্তভাবে মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর এর মতো শহরে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বিক্ষোভ প্রদর্শিত হলেও অনলাইন ডেলিভারি কর্মী বা গিগ ওয়ার্কার্সদের পক্ষ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনের  ডাক কিন্তু আগে দেখা যায় নি, ঠিক যেটাই গিগ ওয়ার্কার্সদের এই আন্দোলনের অভিনবত্ব, যেটাই এই প্রতিবাদী কর্মীদের বিক্ষোভ আন্দোলনের স্তরে উন্নীত করেছে।

তবে এই আন্দোলনের বীজ বপণ হয়েছে বহু আগে। অনলাইন কোম্পানীগুলি "ডেলিভারি পার্টনার" বাহারি নামে অভিহিত করার কারসাজি দিয়ে আসলেই ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল গুলোর সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে এসেছে, ফলে "জব সিকিউরিটি", "ফিক্সড স্যালারী", "স্বাস্থ্য-বীমা"  ইত্যাদি - কোম্পানীভিত্তিক তারতম্যের পরেও যা মেলে এই ডেলিভারী কর্মীদের তা না পাওয়ারই সমান! এই কোম্পানীগুলি বিপুল রিক্রুটমেন্ট করে একদিকে যেমন নিজেদের পরিষেবাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে অন্যদিকে এই বিপুল রিক্রুটমেন্ট-এর হিসাব দিয়ে শেয়ার মার্কেটে অ্যাসেট দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার ফাটকা খেলছে এবং পুলিশের দাদাগিরি ঘুষখোরি, কেয়ার সেন্টারের দাদাগিরি, উপভোক্তাদের দুর্ব্যবহার নিয়ে ধুঁকতে থাকা তথাকথিত এই পার্টনারদের কপালে জোটে কিলোমিটার, সার্ভে অডিট জাতীয় কারচুপি দিয়ে পকেট কাটার সবরকম বন্দোবস্ত! কর্মীদের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে রোষ যাকে প্রবল করেছে লকডাউনের মধ্যে কর্মীদের মনে বাড়তে থাকা ছাঁটাই হওয়ার সম্ভাবনা। লকডাউনে হওয়া ৪১ লক্ষ ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের দলে  গিগ ওয়ার্কার্সদেরও নাম রয়েছে। গত মে মাসেই জ্যোমাটোর ১৩% কর্মীছাঁটাই এর দেখাদেখি সুইগীও তাদের ১১০০ কর্মী ছাঁটাই করে। এইসমস্ত   ঘটনায় কর্মীদেরকে আন্দোলনের পথে নিয়ে আসে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে পাথেয় কী? এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং অনলাইন ডেলিভারি কর্মীদের আন্দোলনকে বৃহৎ প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যেতে, কর্মীদের ন্যায্য অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে কী প্রয়োজন একটি বিপ্লবী পার্টির?! বাজারী মিডিয়ার ক্রমাগত উপেক্ষা এবং সরকারের উদাসীনতাকে ভেঙে কালা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর কানে দামামা বাজিয়ে তোলার মত উপযুক্ত আন্দোলনের রূপরেখা নির্মাণে প্রয়োজন কী একটি বিপ্লবী লাইন?
গিগ ওয়ার্কার্সদের এই আন্দোলন কিন্তু আবারও মনে করিয়ে দিল আন-অর্গানাইজড সেক্টরের কর্মীদের মধ্যেও তৈরী হচ্ছে আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ! দেশব্যাপী বৃহৎ  কর্মসংস্থান আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার ইঙ্গিতই কী দিয়ে গেলেন গিগ ওয়ার্কার্সরা!

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার