শরৎচন্দ্র

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত 

কালিদাসী, সন্তান হারা এক মা। বারো-চোদ্দ বছরের ছেলে মারা গেলে তার আর কোনো সঙ্গী রইল না। পুরনো এক বাড়ির তিন তলায় এক খানা ঘরে তার সংসার। স্বামী তার সাধারণ উপার্জনের আশায় সারাদিন নানা কাজ করে থাকে। ঘরখানাতে স্বামী-স্ত্রী অন্য এক বৃদ্ধার মেয়ে জামাই পরিচয় নিয়ে বিনা ভাড়ায় থাকে।

কালিদাসীর স্বামী তাকে নিয়ে নিজের বাড়িঘর পরিবার স্বজন ছেড়ে এই জীবন বেছে নিয়েছে। তার নিজের পিতৃকুল মাতৃকুল কোনো কুলেরই কিনারা করা দুঃসাধ্য। লাভও নেই। 

শৈশব তার যেখানেই কাটুক, পাঠশালায় তার যাওয়া হয়েছিল বোঝা যায়। কারণ বাংলা পড়তে পারে কালিদাসী। অনেক অভ্যাসের ফলে তার পাঠের গতিও মন্দ নয়। দিনে এক দেড়শ পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করবার ক্ষমতা অর্জন করেছে সে; আমি যখন দেখেছি তাকে। 

কালিদাসী ঘরের বাইরে বের হত না। রাস্তায় তাকে দেখা যেত যখন সে সিনেমা দেখতে যেতো। তা-ও হেঁটে নয়। রিক্সায়, পর্দা ফেলে। এবং রাতের শো-তে। 

এক সময় কালিদাসীর বইয়ের যোগানদার ছিলাম আমি। আমার সঙ্গে একটা স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে ছিল তার। কী বই আনবো জানতে চাইলে একটাই কথা প্রায়ই শুনতে হোতো, ওনার লেখা যে-কোনো বই। এই ‘ওনার লেখা’ কথার রহস্য আমার জানা হয়ে গেছে তত দিনে। কালিদাসী চাইছেন, শরৎচন্দ্রের কোনো রচনা। লেখকের নাম বলায় বাধা দিত হিন্দু নারীর সংস্কার। শরৎচন্দ্র ছিল কালিদাসীর স্বামীর নাম। 

এই ছোট্ট ভূমিকা থেকে পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন, শরৎচন্দ্র কী লিখেছেন। কাদের নিয়ে লিখেছেন। কাদের জন্য লিখেছেন। আর এ-ও নিশ্চয় বুঝে থাকবেন, তাঁর বইয়ের পাঠক কারা ছিলেন। 

আজ শ্রৎচন্দ্রের জন্মদিন। ১২৮৩ সনের ৩১ শে ভাদ্র তারিখে তিনি জন্মে ছিলেন, হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। আজ তাঁকে প্রণাম জানাবার কালে বাংলার সেই কালের কালিদাসীদেরও স্মরণ করি। তাঁদের পক্ষ থেকে ফুল নিবেদন করছি বাংলার অমর কথাশিল্পীর চরণে। 

শরৎচন্দ্রকে বাঙালি কথাশিল্পীর শিরোপা দিয়েছে। চোখের সম্মুখে ধরে থাকা কিছু শব্দমালা হৃদয় নিংড়ে চোখে জলের ধারা বইয়ে দিতে পারে, এমন করে তাঁর আগে কে পেরেছেন। কাহিনির উপাদান সংগ্রহ করতে বাংলার গ্রামের বাইরে যান নি তিনি। ছিলেন সংস্কারমুক্ত মানুষ। যথার্থই। তাঁর মননে বিচারে জীবনে এ কথাসত্য। তাঁর জীবনের প্রতিটি ব্যতিক্রমী ঘটনা এর প্রমাণ। রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছেন, দেশের প্রতি আবেগে। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠায়। দলের নির্দেশে নয়। গান্ধীজির নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে রচনা করেছেন ‘পথের দাবী’র মতো রচনা। সরকারের রোষে পড়েছেন তার জন্য। বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। লোকদেখানো আনুগত্য পছন্দ করতেন না। কংগ্রেস করেছেন, কিন্তু খদ্দর পরেন না । জিজ্ঞাসা করলে হেসে বলতেন, বাড়িতে চাকর থাকে না। কেন, না ভিজে কাপড় তুলতে কষ্ট হয়। চরকা কাটতেন না। জিজ্ঞাসা করলে তাঁর সহাস্য জবাব, সুতো কেটে যদি বিপ্লব হয়, তবে মাকড়সা সবার আগে বিপ্লবী। 

তাঁর রচনার লক্ষ্যমুখ বাংলার হিন্দু সমাজে পরিবারে নারীদের অবস্থান। এখানে তিনি জাত ধর্ম নির্বিশেষে মহিলাদের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। ধনী দরিদ্র, বামুন কায়েত বৈষ্ণবী, বিধবা অকালবিধবা, কুলীন ব্রাত্য, অনূঢ়া, বিবাহবিচ্ছিন্না স্বামী পরিত্যক্তা, পতিতা, হাড়ি মুচি ডোম নাপিত প্রতিটি চরিত্র কী মমতায় গড়েছেন ভাবা যায় না। সময়টা ছিল যুগ বদলের। সমাজ বদলের। মোট কথা একটা ভেঙে গড়ার কাল। পুরাতন খাঁচার ভিতর থেকে নতুন সমাজ ব্যবস্থার আবির্ভাবকাল। তারই প্রতীক গফুর জোলা। শ্রমজীবীর আবির্ভাব। বাংলার সাহিত্যে  সর্বহারার প্রথম প্রতিনিধি। 

তিনি এই সকল নির্যাতিতের স্বঘোষিত প্রতিনিধি। তাঁরই উক্তি, ‘সংসারে যারা শুধু দিলে, কিন্তু পেলে না কিছুই যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনোদিন ভেবেই পেলেন না, সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই, তাদের বেদনাই দিলো, আমার মুখ খুলে, তারাই পাঠালো মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।’ তিনি তাদের হয়ে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানিয়ে গেলেন। নির্যাতক নির্যাতিত কোনো তরফেই আপত্তি আসে নি। বাঙালি তাঁকে বরণ করে নিয়েছে মরমী কথাশিল্পী হিসেবে। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার