এক খেলোয়াড় অ্যাক্টিভিস্টের কাহিনী

সায়ন নন্দী

মাঠের বাঁ প্রান্ত থেকে ছুটে আসা বলকে ডান পায়ে ধরে কোমরের দোলাতে ডিফেন্ডারকে ডজ করে বাম পায়ের শট, কিন্তু লক্ষভ্রষ্ট হয়ে বল লাগলো গোলপোস্টে, অবিস্মরনীয় খেলার অন্তিম লগ্নে মারাদোনার গোল মিস্...



সত্যি ফুটবলের রাজপুত্র জীবনের শেষ বাম পায়ের শটটি জালে জড়াতে পারলেন না। হেরে গেলেন হৃদরোগ নামক একটি প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে.... সত্যিই দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ফ্রাঙ্কো চলে গেলেন তাঁর বিখ্যাত নীল সাদা ১০ নম্বর জার্সিটিকে রেখে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০। আশির দশক যখন হলুদ ফুটবল দৈত্যের একাধিপত্যে বিস্মিত, ঠিক সে সময়তেই ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির এক যুবক শুরু করলো মাঠ কাঁপানো। তাঁর কোমরের হালকা বাঁকে বিশ্বের তাবড় তাবড় ডিফেন্ডাররা তখন মাটি ধরে একপ্রকার হামাগুড়ি খাচ্ছে। আর্জেন্তিনার মতো একটি ছোট্ট দেশকে সমগ্র বিশ্বের কাছে উপস্হাপিত করলো বুয়েনেস আইরেসের লানুস্-এ ৩০-এ অক্টোবর, ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করা এই যুবকটি ।  
কেরিয়ারের শুরুর দিকে খাটো চেহারার জন্য এই যুবকের বিরুদ্ধে ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলিতে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। সে যুবক তার কেরিয়ার শুরু করে ১৯৭৬ সালে আর্জেন্তিনোস জুনিয়রস-এ, মাত্র ১৬ বছর বয়সে। সেখানে তিনি ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। পাঁচ বছরের কেরিয়ারেই করে ফেলেন ১১৬টি গোল, মাত্র ১৬৭টি ম্যাচে। বয়সভিত্তিক অনুর্দ্ধ ২০ জাতীয় দলে এবং সে বছরেই মূল জাতীয় দলে তাঁর ডাক চলে আসে। বয়সভিত্তিক দলে মাত্র দু বছরেই তিনি ৮টি গোল করেন ১৫টি ম্যাচে। ১৯৭৯ সালে বয়সভিত্তিক অনুর্দ্ধ ২০ বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে আর্জেন্তিনাকে প্রথম বিশ্বসেরা হওয়ার আনন্দ প্রদান করেন। ১৯৮১ সালে প্রথম ক্লাব আর্জেন্তিনোস জুনিয়রসকে বিদায় জানিয়ে আর্জেন্তিনার প্রথম সারির ক্লাব বোকা জুনিয়ার্সে যোগদান করেন তিনি। সেখানে মাত্র ১ বছরের কেরিয়ারে খেলেন ৪০টির বেশী ম্যাচ এবং গোল করেন ২৮টি। 
তারপরের বছরেই তিনি স্পেনের বিখ্যাত কাতালুনিয়া ক্লাব বার্সালোনেতে যোগদান করেন এবং দু'বছরের নাতিদীর্ঘ সময়তেই ৩৬টি ম্যাচে তিনি ২২টি গোল করেন। মারাদোনা কোনোদিনই একটি ক্লাবে খুব বেশী দীর্ঘ কেরিয়ার গঠন করেননি, একমাত্র ইতালির ক্লাব নাপোলিতে ছাড়া । শুধুমাত্র তাঁর নাপোলিতে খেলা সর্বোচ্চ দীর্ঘ ক্লাব কেরিয়ারের অন্যতম কারণ সে সময়টাই তাঁর স্বর্ণযুগ। তিনি আর্জেন্তিনাকে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় উপহার দেন নাপোলিতে খেলাকালীন। দেশের হয়ে তিনি জেতেন ১৯৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপ। তৃতীয় স্হানাধিকারী হন ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে এবং ১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপে রানার্স আপ। কিন্তু ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ফুটবলের রাজপুত্র একাধিপত্য দেখিয়ে গেছেন তাঁর ফুটবল যুদ্ধের পরিসরে। ১৯৯৪ সালে ডোপ টেস্টে নির্বাসিত হন। তাঁর জাতীয় স্তরে খেলার ইতি ঘটলেও ক্লাবস্তরে তিনি তখনও স্বমহিমায় বিরাজমান ছিলেন। কিংবদন্তী মারাদোনা মোট ৯১টি ম্যাচ খেলেন আর্জেন্তিনার হয়ে এবং গোল করেন ৩৪টি। ১৯৯১ সালের পর তিনি আবারো স্পেনে ফিরে আসেন এবং সেভিয়াতে নিজের কেরিয়ারের অগ্রগতি ঘটান। যদিও সে সময় মারাদোনার যুগ প্রায় অন্তিম লগ্নে এসে পৌঁছেছে। বির্তক এবং মারাদোনা প্রায় সেসময় ফুটবল ও মাঠের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাদকাসক্তি, অবাধ যৌনাচারের ফলে নিন্দিত হতে থাকেন কিন্তু কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর প্রভাবে তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। 
মারাদোনা সেভিয়া ক্লাবে ২৬টির ওপর ম্যাচ খেললেও গোল করেন মাত্র ৫ টি। তারপর তিনি নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে এবং সর্বশেষে তাঁর পুরোনো ক্লাব বোকা জুনিয়র্স-এ এসে তাঁর ফুটবলের বর্ণময় এক যুগের পরিসমাপ্তি ঘটান। কেরিয়ারের শেষ লগ্নে ৩০টি ম্যাচে বোকা জুনিয়র্সকে ৭টি গোল উপহার দেন। তাঁর ক্লাবভিত্তিক সুদীর্ঘ কেরিয়ারে মোট ৪৯১টি ম্যাচ খেলেন এবং ২৫৯টি গোল করেন। 
খেলোয়ার জীবনের পরর্বতী সময়তে বিভিন্ন ক্লাবে তিনি কোচিং করেন। কিন্ত ফুটবলার মারাদোনার মতন নক্ষত্রের ন্যায় এত উজ্জ্বল ছিল না তাঁর কোচিং কেরিয়ার। ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি আর্জেন্তিনার জাতীয় দলের কোচ ছিলেন এবং এ সময়তেই লিওনেল মেসি, সের্জিও আগুয়েরো, অ্যাঞ্জেলো দি মারিয়া, গঞ্জালো হিগুয়েন-এর মত বিশ্বের তাবড় তাবড় নক্ষত্রদের নিয়ে ২০১০ বিশ্বকাপে লড়াই করেন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় লিওনেল মেসি তাঁর প্রশিক্ষণে দু’বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। তাছাড়াও রেসিং ক্লাব, আল-ওয়াসল ও সর্বশেষ গিমনাসিয়া ডে লা প্লাটা-তে কোচিং করান। তবে খেলোয়াড় মারাদোনা এবং প্রশিক্ষক মারাদোনার মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। ২০০০ সালে তিনি ফিফা নির্বাচিত বিংশ শতাব্দির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন যুগ্মভাবে পেলের সাথে। 
আর্জেন্তাইন সর্মথকরা তাঁকে আদর করে ‘এল পিবে দে ওরো’ বলে সম্বোধন করতেন। মারাদোনা তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল সময়তে আর্জেন্তিনাকে দুবার বিশ্বসেরা করেন। মারাদোনার ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল এবং পাঁচজন খেলোয়াড়কে ডজ করে করা গোল এখনো বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল উপস্হিতিতে বিরাজমান। ফুটবলের রাজপুত্র তাঁর বাম পায়ের বিস্মিত ছোঁয়াতে সমগ্র বিশ্বকে মোহিত করে তুলেছিলেন। সারা বিশ্বে আর্জেন্তিনার অগনিত সর্মথকদের প্রধান কারন ছিলেন এই ছোট খাটো চেহারাটি। শরীরের দোলায়, পায়ের জাদুতে তাবড় এবং বিশ্ববিখ্যাত ডিফেন্ডারদের বেকায়দায় ফেলে জালে বহুবার বল জড়িয়ে দিলেও হার মানলেন হৃদরোগের কাছে। গ্যালারি কিন্তু তারস্বরে এখনো চিৎকার করছে মা-রা-দো-না, মা-রা-দো-না ....
মারাদোনা শুধু একমাত্র ফুটবল জগতের নক্ষত্রই ছিলেন না, চির বিদ্রোহী এবং বামপন্থাতে বিশ্বাসী একজন খেলোয়াড় অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে ফিদেল ও চে-এর যে বন্ধু, সে তাঁরও বন্ধু। ফিদেল কাস্ত্রোকে তিনি নিজের পিতা হিসেবে দেখতেন এবং বলেছিলেন যে তাঁর নিজের দেশ তাঁকে বর্জন করলেও কিউবা তাঁর জন্য সমস্ত দরজা খুলে দিয়েছিল। হাতে চে এবং পায়ে কাস্ত্রোর উল্কিই দুই বিপ্লবীকে তাঁর সম্মান প্রদর্শন। ভেনেজুয়েলাতে বামপন্থী নেতা হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ক্যারাকাসের রাস্তায় দেখা যায় আর্জেন্টিনার এই আদরের ফুটবলারকে। লাল পতাকা এবং বামপন্থাই যে সকল প্রকার শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে  একমাত্র বিকল্প, তা মারাদোনা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর তিনি ভেনেজুয়েলাকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা পরিস্থিতিতেও ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকার তাঁর সমর্থন পেয়ে এসেছে। সমগ্র লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তিনি ফুটবল খেলার আয়োজন করে লাতিন ঐক্যের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে চূড়ান্ত প্রভাবশালী এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল মার্কিনী প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে “হিউম্যান গারবেজ” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তিনি। কিংবদন্তীর জীবনে সেজন্য হয়তো বির্তক কখনোই পিছু ছাড়েনি। ১৯৮৭ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে সম্পদ বৈষম্য বিষয়ে দ্বিতীয় জন পলের সাথে মৌখিক বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি ভ্যাটিকানে ছিলেন এবং সোনার সিলিং দেখেছিলেন কিন্তু তারপর পোপকে বলতে শুনলেন যে তিনি নাকি দরিদ্র বাচ্চাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন! মারাদোনা বলেছিলেন পোপ শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হলে তাঁর নিজের সিলিংটি বিক্রি করে দিন। চিরবিদ্রোহী এই ফুটবলারের প্রতিবাদের হাত থেকে আর্জেন্তাইন সমরশাসক গলতিয়েরি কিংবা ফুটবল নিয়ামক সর্বোচ্চ সংস্হা ফিফা কেউই রেয়াত পায়নি কখনো। ফকল্যান্ডের সাথে যুদ্ধবিড়ম্বনার কারণে তিনি কখনো ইংরেজি ভাষার পাঠ নেননি এবং কোনও ইংরেজ ক্লাবে কখনো খেলেননি। আসলে মারাদোনাকে কোনো স্কেল বা পরিমাপ দিয়ে মাপা যায় না। তিনি ছিলেন এক অবিসংবাদী স্বঘোষিত প্রতিবাদী চরিত্র যিনি কখনো অর্থ লোভ লালসার সাথে আপোষ করেননি। তাঁর ব্যাক্তি জীবনের উচ্ছৃঙ্খল অধ্যায়কে দূরে ঠেলে নিজের খেলাকে হাতিয়ার করে মার্কিন চোখরাঙানীর বিরুদ্ধে সমগ্র লাতিন আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয়েছিলেন। খেলার মাঠের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাম আন্দোলনের এহেন প্রচার বিরল এবং আজকের জ্যোতিষীদের কিংবা কবচ তাবিচের অ্যাড করা প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের ভ্রূকুঞ্চনের কারণ হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন। এখানেই তিনি আলাদা, সবার সেরা, খেটে খাওয়া জনগণের খেলার মাঠের আইকন…  

Photo Courtesy: BBC News

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার