কমরেডস্‌, শুধু ‘বিজেপিকে একটাও ভোট নয়’ বলে ফ্যাসীবাদকে রোখা যাবে তো?


সুমিত ঘোষ

এ বছরই বিধানসভা নির্বাচন। দিল্লীর চলমান কৃষক আন্দোলনে উজ্জীবিত বামপন্থী মহলে সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনে তেজস্বী দীপঙ্করদের জোটের আসন বৃদ্ধি নতুন একটা তর্জার জন্ম দিয়েছে- ‘বাংলার রাজনীতিতে প্রধান শত্রু কে?’। রাজ্যের ধ্রুপদী ডান-বাম সব দলের একটাই উত্তরঃ বিজেপি। এই সিদ্ধান্তেরই রাজনৈতিক প্রতিফলন ‘বিজেপিকে একটাও ভোট নয়’ হ্যাশট্যাগ বা স্লোগানে। কিন্তু প্রশ্ন হল এতে বিজেপি হারবে তো?

বিজেপি হারবে তো?! এই প্রশ্নের ভিত্তিতে উক্ত স্লোগানের অনিবার্য পরিণতিঃ নিজেদের ‘কর্মফল’-এর জন্যই আজ ডান-বাম জোটকে মেনে নিতে হবে… এই উপসংহার বাম অ্যাক্টিভিস্টদের ফ্রাস্ট্রেশান তুলে ধরলেও সাধারণ মানুষ সেগুলো শুনবে কেন?

বিশ্লেষণ শুরু করি বিজেপি বিরোধী মহান তৃণমূল নেত্রীকে দিয়ে… বাসে ট্রামে চড়লেই বোঝা যাবে যে পথ চলতি মানুষ মমতার বিরুদ্ধে গালাগাল দিচ্ছে। সততার প্রতীকের ফানুশ চুপসে গিয়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটিয়েছে তৃণমূলের। শোভন, শুভেন্দু, সুজাতার গেরুয়া-সবুজ টিকিট কাটাকাটি সমগ্র পার্টিটাকেই সার্কাসে পরিণত করে ফেলেছে। তৃণমূলে থাকাকালীন মুকুলের নেতৃত্বে আঞ্চলিক দাঙ্গাগুলির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, ২০০৫ সালে বাংলাদেশি ঘুসপেটিয়াদের(!) বিরুদ্ধে সরব হয়ে লোকসভার স্পিকারের মুখে কাগজ ছুঁড়ে মমতার এনআরসি বিরোধী অবস্থান, সকল প্রকার ধর্মঘটের কট্টর বিরোধিতা, হকার ও বস্তি উচ্ছেদ করে শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, ছাত্র ইউনিয়নগুলিকে ফেস্ট ও সরস্বতী পুজোতে সীমাবদ্ধ করে উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশের সময় পড়ুয়াদের ‘ছোট ছোট ছেলেদের’ হাতে মোটা অঙ্কের ‘এডুকেশন ট্যাক্স’ দেওয়ানোর মাধ্যমে আদর্শ সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করে শিক্ষার বেসরকারিকরণ রোখা এবং এই দশ বছরে নামমাত্র চাকরীর পরীক্ষা কন্ডাক্ট করে ৯৯.৯৯% দুর্নীতির মাধ্যমে হাইকোর্টে সম্বর্ধিত হয়ে বেকারদের কল্যাণ করেও কেন বিজেপিকে রোখা গেল না? জয়ললিতাকে নকল করে অগণিত প্রকল্প চালু করে, পুরনো প্রকল্প নতুন মোড়কে এনে প্রকল্প পিছু বরাদ্দ কমিয়ে (হ্যাঁ, কন্যাশ্রীর কথাই বলছি) কেন বিজেপিকে রোখা গেল না? ‘আচ্ছা, অন্য রাজ্যের বিজেপিও তো একই রকম দুর্নীতি করে’ মার্কা প্রশ্নকারকদেরকে আগবাড়িয়ে  বুঝিয়ে রাখি, এ রাজ্যে যে শক্তি আগে কখনও আসেনি, যার নিজস্ব ফ্যাসিস্ট ডেমাগগিক অ্যাপিল আছে, যে কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বসে রাজ্যগুলোকে সমৃদ্ধির প্রলোভন দেখাতে সক্ষম, তার বিপরীতে একটা লুম্পেন, দুর্নীতিগ্রস্থ, ভাইপোতান্ত্রিক আঞ্চলিক দল যে ধোপে টিকবে না তা বলাই বাহুল্য। যে লক্ষ লক্ষ বেকারগুলো রাস্তায় ফ্যাল ফ্যাল করে ঘুরছে, তাদের হাতে কাঁচা টাকা তুলে দিলে নিজের পরিবারের পেট চালানোর তাগিদে যে সে পদ্ম পতাকা তুলে নিতে বাধ্য (এটা পুরোপুরি তার চয়েস নয় বরং অর্থনীতির সর্তেই মাথা নত করতে বাধ্য হওয়া) তা না বুঝতে পারলে এটা ধরে নিতেই হবে নিজেদের স্বচ্ছল জীবনের স্থূলতা বাম অ্যাক্টিভিস্টদের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে…

এতক্ষণ আমার কথাগুলো শুনে নিশ্চয়ই তৃণমূলপন্থী বামেরা আমায় কংগ্রেসপন্থী বামেদের দালাল বলতে শুরু করেছে তাই কংগ্রেসের সাথে সাথে দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির বিজেপি বিরোধিতা(!) মহাসাগরের দু’একটা কণা একটু তুলে ধরি। ২০১৬-র ডিমনেটাইজেশান তাড়াহুড়ো করে করা, এরকম একটা মিনমিনে বক্তব্য বাম-কংগ্রেস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলের ফ্যাসীবাদ বিরোধী মহলে উঠে এসেছে। পাকা চুল পলিট-বুড়োগুলো অঙ্ক-ফঙ্ক করে, নাকি করেও চুপ করে থাকে, তা একটা বড় প্রশ্ন হলেও এটা সবার জানা যে কালো টাকার উদ্ধার হবে জেনেই ভয় পেয়ে মেহুল চোক্সি, বিজয় মাল্যরা নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে (রাজনাথ সিং-এর বক্তব্য)। আর ডিজিটাল উন্মাদনার নামে মানুষের পকেট থেকে টাকা তোলা যে আসন্ন মন্দার মাঝে শেয়ার বাজারকে ও একচেটিয়া বিজনেস ডনদের রক্ষা করতেই করা তা বলাই বাহুল্য। জিএসটি-র মত একচেটিয়া বান্ধব কর ব্যবস্থাতেও সব বিরোধীদের পদ্ধতিগত অর্থাৎ ইমপ্লিমেন্টেশানের ক্ষেত্রে মত পার্থক্য ছিল, এর বেশি কিছু নয়। যখন খোদ গুজরাটের ছোট ব্যবসায়ীরা জিএসটি-র বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল তখনও এই মেনি-বিড়ালপোনার উৎস হল ইউপিএ আমলে প্রথমে অসীম‘বাবু’ এবং পরে অমিত‘বাবু’ (অর্থাৎ বাংলার দুই পরপর হওয়া অর্থমন্ত্রী)-র জিএসটি কাউন্সিলে চেয়ারম্যান পদ! সিপিআই(এম) নেতা কারাটের ২০১২ সালে ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব প্রদানের দাবী এবং ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ইউপিএ আমলে ‘অ-ফ্যাসীবাদী’ দলগুলির নীরবতা বর্তমান সিএএ আইন বিরোধী লড়াইকেই দুর্বল করে দিয়েছে। বিজেপির উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জন্য সংরক্ষণ প্রস্তাব লোকসভায় ৩২৩:৩ অনুপাতে পাশ হওয়া এবং মমতার সবার আগে তা বাংলায় ইমপ্লিমেন্ট করা শাসক-বিরোধী উভয় মহলেরই বর্ণগত অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। রাম মন্দির রায় নিয়ে তৃণমূলসহ অনেক বিরোধী দলই নীরব থেকেছে, বাকিরা স্বাগত জানিয়েছে। কাশ্মীরকে অবদমিত করার প্রশ্নে তৃণমূল রাজ্যসভায় পক্ষে বক্তব্য রেখেছে আর কংগ্রেস তো নিজের দলকে একজোট করতেই পারেনি, আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তাছাড়া, বিরোধীদের মদত না থাকলে রাজ্যসভায় পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপি তথা এনডিএ-র না থাকলেও সব বিলগুলি পাশ হয় কি করে? শ্রম কোড বিল বা কৃষি বিলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আর পাকিস্তান বা চীনের সাথে যুদ্ধ নিয়ে অ-বিজেপিদের অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলছি না, শুধু একটা কথা ছাড়াঃ আমাদের দেশের পলিট-বুড়োগুলো যুদ্ধ যুদ্ধ করে নাচলেও পাকিস্তানের বামপন্থীরা অতীব প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যুদ্ধদামামার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং চীনের সাথে খুনসুটির সময়েই এদেশে চীনা বড় কোম্পানিগুলির বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। সারা দেশের ভয়াবহ প্রেক্ষাপট বিচার করে চিরতার জলের মত যারা সব জায়গাতেই ‘মহাগাটবন্ধন’-এর প্রচার করে বেড়াচ্ছে তাদের জন্য এই প্যারাগ্রাফটা উৎসর্গ করলাম। আর ইয়েচুরির আবদারে কংগ্রেসকে কিছু বাড়তি পয়েন্টস দেওয়া দরকারঃ শাহ-বানু মামলায় রাজীব গান্ধীর গৌরবোজ্জ্বল অবদান, শিখ গণহত্যা, খাদ্য আন্দোলনের মহিলা অ্যাক্টিভিস্টদের উপর বিধান রায়ের পুলিশের গুলি চালানোর ইতিহাস তাকে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম অংশীদার করে তুলেছে।

এ তো গেল সব বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে প্যানপ্যানানী। বিরোধিতার ইস্যু ভাইপোতন্ত্র, দুর্নীতি, মুখোশের আড়ালে সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি… এ বিষয়ে অনেকেই আগে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছে - সিপিআই(এম) তৃণমূলের বিরুদ্ধে, নকশালরা সিপিআই(এম)-কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, কেউ তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আবার ভোট বিরোধিতায় মজে থাকারা প্রায় সকলেরই বিরুদ্ধে… কিন্তু বিজেপিকে আটকানোর উপায় কি?

দিমিত্রভ থিসিসকে কাজে লাগিয়ে সিপিআই(এম) কংগ্রেস আর নকশালরা তৃণমূলের পক্ষে সওয়াল করে চলেছে। প্রশ্ন করলেই রুজভেল্ট চার্চিলদের সাথে স্তালিনের হাত মেলানোর প্রসঙ্গ উঠবে। তাই দিমিত্রভ থিসিসের নির্যাসটা একটু দেখে নেওয়া যাক। দিমিত্রিভ ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেনঃ ফিন্যান্স পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে স্বজাতিমত্ত এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী উপাদানের প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র। অর্থাৎ নির্যাসগতভাবে দেখলে পুঁজিবাদী মহলের যে অংশ ফ্যাসিস্টদের দ্বারা লাভবান হচ্ছে না সেই অংশকে লড়াইতে শামিল করা। এর জন্য বুর্জোয়া মহলে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী বিভক্তিকরণ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান নয়াউদারবাদী যুগে, যখন বিশ্বায়িত বাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি জাতি রাষ্ট্রের কাঁটাতার অতিক্রম করে ফেলেছে, তখন অর্থনৈতিক সংকটকালে ফ্যাসীবাদের উত্থানও জাতি আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে কিছু প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশে সীমাবদ্ধ থাকছে না বরং সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বায়িত অর্থনীতির পৃথিবী জোড়া মায়াজাল আন্তর্জাতিক স্তরে সাম্রাজ্যবাদী বাজার দখলের যুদ্ধকে তাই নিয়ে এসেছে নিজ নিজ দেশের সীমানা ক্ষেত্রের পরিবর্তে তৃতীয় স্থানে অর্থাৎ মধ্য প্রাচ্যে। নিজেরই গর্ভজাত ইসলামিক মৌলবাদ আজকের আন্তর্জাতিক ফ্যাসীবাদের বিদ্বেষ ভিত্তি (শত্রু চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে কিছু দেশ বিশেষে পার্থক্য অবশ্যই আছে)। মজার বিষয় হল, বিশ্বায়িত অর্থনীতির প্রভাবে বর্তমানে বুর্জোয়াদের মধ্যে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী বিভক্তিকরণ নজরে পড়ছে না। ফলে বিজেপি, কংগ্রেস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দল নির্বিশেষে রাজ্য সরকারগুলির অর্থমন্ত্রীদের অবস্থান প্রায় একই রকম। মোদ্দা কথা, এরা সকলেই প্রাইভেটাইজেশানের দালাল, বলা ভালো, উদারপন্থী। বরং আরএসএস-এর মধ্যে ধ্রুপদী রক্ষণশীল প্রবণতার কারণে অনেক সময়েই বামেরা বিজেপির অর্থনৈতিক পলিসির বিরুদ্ধে অবস্থানে তাদের পরোক্ষ সাপোর্ট পেয়েছে যদিও এতে উৎফুল্ল না হয়ে এটা বোঝা দরকারে যে আরএসএস বর্তমান ব্যবস্থাকে ডান দিক থেকে পরিবর্তন করতে চাইছে, বাম দিক থেকে নয়। বুর্জোয়া মহলে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী বিভক্তিকরণের অভাবের ফলেই শাসক-বিরোধী সকল দলেরই একই ধাঁচের রাজনীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে উপরের অনুচ্ছেদগুলোর উদাহরণগুলোতে। ফলে এই পরিস্থিতিতে বামেদের বাম-ডান মহাজোটের প্রস্তাব সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বিচার না করে কেবল স্থূল নির্বাচনী সুবিধাবাদ ছাড়া কিছুই নই।

অর্থনৈতিক দিশার অভাব, রাস্তায় নেমে আন্দোলনে অনীহা এবং নির্বাচনী হতাশার প্রেক্ষাপটে সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্ব পার্টি কংগ্রেসের নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের সাথে জোটের প্রসঙ্গ টেনে আনে। ২০১৬-র পরাজয়ের পরেও জাতীয় স্তরে দিমিত্রভ থিসিসের ভিত্তিতে তা সিপিআই(এম) গ্রহণ করে। ২০১৯-এর নির্বাচনেও তাদের পরাজয় বারংবার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সাধারণ জনগণের আকাঙ্ক্ষা একটা অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সরকার অর্থাৎ কোয়ালিশন যুগের ডান-বাম জগাখিচুড়ীর প্রতিক্রিয়া পর্বে প্রবেশ করে ফেলেছি আমরা। এর বাইরে সিপিআই(এম)-এর শিল্পায়নের প্রশ্নও তার ডান উপাদানের কারণে বিজেপি দ্বারা হাইজ্যাক হয়েছে। বুদ্ধ-র আবদার তাই পদ্মের ‘আর নয় অন্যায়’ স্লোগানে পরিণত হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে তারা যে নিজেদের অবস্থান থেকে সরেনি তা অশোকনগরে ওএনজিসির বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলনকে সাবোট্যাজ করার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, শ্রম নিবিড় শিল্পের বদলে পুঁজি নিবিড় শিল্পের নামে কর্মসংস্থানের ফানুশের সুতো সুজনবাবুদের হাত থেকে অনায়াসেই লকেট চ্যাটার্জীরা হাইজ্যাক করতে পেরেছে। 

কংগ্রেসের সাথে হাত ধরে বামেরা নিজেদের আসন সংখ্যা খুইয়েছে আর বিরোধী দলনেতা উঠে এসেছে কংগ্রেসের থেকে। যাদের এ রাজ্যে কোনও শক্তিশালী সংগঠন নেই কিছু আঞ্চলিক গুণ্ডাদের দাপট ছাড়া, যাদের বিগত দুই দশকে কোনও বড় আন্দোলনের ইতিহাস নেই, সেই কংগ্রেস বামফ্রন্টের প্রসাদেই একটু বহরে নিজেদের বাড়িয়ে নিয়েছে যদিও এ রাজ্যে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে উভয়েরই সংখ্যা লজ্জাজনক। অন্যান্য রাজ্যে কংগ্রেস কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারে এসেছে সেখানে, যেখানে বিজেপি দীর্ঘদিন সরকারে থাকার ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাজ করেছে, যদিও তারই মধ্যে নিজেদের অন্তর্কোন্দলের ফলে মধ্য প্রদেশে সে সরকার খুইয়েছে। অন্যত্র জোট সরকারগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে - প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সত্ত্বেও গুজরাটে এতকান্ড করেও ম্যাজিক নম্বর ছুঁতে না পারা, কর্ণাটকে সরকারের পতন, বিহারেও জোটের হার… ২০১৯-এও দুর্নীতির ইতিহাসের সামনে কংগ্রেসের আসন ৪৪ থেকে মাত্র ৫২তে উন্নীত হয়েছে! বিহারে গা জোয়াড়ি করে বেশি আসনে দাঁড়িয়ে, বেশিরভাগে হেরে সে নিজেকে আদর্শ টাইটানিক জাহাজ হিসেবে তুলে ধরছে। ও নিজে তো ডুববেই, যে ওর হাত ধরবে তাকে নিয়েই ডুববে।    

সিপিআই(এম) শহুরে বাগাড়ম্বর নেতৃত্বে নির্ভরশীল হয়ে তৃণমূলের আক্রমণের সামনে নিজের ক্যাডার বাহিনীকে রক্ষা করতে না পারলে, তাদের মনোবল ও শেল্টার দেওয়ার কাজ শুরু করে বিজেপি। বাম থেকে রামে পরিবর্তনের পথ এভাবেই প্রশস্ত হতে শুরু করে। এর সাথে যোগ হয়েছে সাধারণ মানুষেরও তৃণমূলের প্রতি বিতৃষ্ণা। ফলে এই প্রেক্ষাপটে তৃণমূলকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোটে শামিল করা ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বই কিছুই নয়। সদ্য বিহার নির্বাচনে আরজেডি-র প্রসাদ পেয়ে লিবারেশন নিজের এমএলএ সংখ্যা বাড়াতে পেরে বাংলার মমতা ঘেঁষা নকশাল মহলের তৃণমূলকে নির্বাচনে জেতানোর প্রত্যাশার স্পোক্সপার্সেন হয়ে উঠেছে এবং প্রধান ও অ-প্রধান শত্রু নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার, সিপিআই(এম)-এর প্রতি সাব্জেক্টিভ বিতৃষ্ণা এবং বামফ্রন্টে বিশেষ সুবিধা না করতে পারা একদিকে যেমন কাজ করছে, তেমনই তৃণমূলের ছত্রছায়ায় ও আর্থিক মদতে নিজেদের সংগঠন বৃদ্ধি করতে পারার সুবাদেই নকশাল মহলের একাংশের তৃণমূল প্রীতির উৎস। কলেজে কলেজে মূলত দুটি বাম ছাত্র সংগঠন ছাড়া বাকি কাউকে টিএমসিপি-র কাজ না করতে দেওয়া থেকে শুরু করে নন-পার্টিজান হকার ইউনিয়নের প্রোগ্রামে ফিরহাদ হাকিমের সভাপতিত্ব এই গোপন বোঝাপড়া ফুটিয়ে তোলে। বর্তমানে মমতার স্বাস্থ্যসাথীর ভাঁওতা বামেদের একাংশ তুলে ধরলে আরেকাংশ মোদীর আয়ুষ্মান ভারতের কথা বলা হচ্ছে না কেন, এই নিয়ে চেঁচামিচি করছে। প্রশ্নটা একটা ইস্যু বাদ দিয়ে আরেকটা বলার নয়, বরং দুটো ইস্যুই যে সমগুরুত্বে তুলে ধরা দরকার তা মহাজোটের দুরন্ত আশার চক্কোরে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। লিবারেশনের দীপঙ্করবাবুর শিক্ষাগত ডিগ্রীকে ঢাল করে তাকে সামনে রেখে প্রতিটা প্রবন্ধে কতটা তৃণমূল আর কতটা বিজেপিকে নিয়ে লেখা হল তা ফিতে দিয়ে মাপা চলছে। তৃণমূলকে নিয়ে বেশি লিখলেই বিপ্লবীদের একাংশ চেঁচামিচি করতে ব্যস্ত। তৃণমূলের সাথে বিজেপি বিরোধিতার কম্পিটিশানের নামে একদিকে সমগ্র বাম মহলের ঐতিহাসিক ফ্যাসীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানকে খাটো করে একদা এনডিএ জোটের মন্ত্রীর সাথে মোদী বিরোধিতার প্রতিযোগিতামূলক ভন্ডামিতে নামতে বলা হচ্ছে, অন্যদিকে এই বক্তব্যের দ্বারা তৃণমূলকে ভোট ট্রান্সফারের পরাজয়বাদীতাকে প্রমোট করা হচ্ছে। তাছাড়া বামফ্রন্টের পত্রিকাগুলোতে যেমন কংগ্রেসের দুর্নীতি নিয়ে লেখালিখি বন্ধ, তেমনই নকশাল মহলের পত্রিকাগুলোতেও কার্যত মমতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত একবছরে একটাও প্রবন্ধ ছাপা হয়নি। কংগ্রেস-তৃণমূলের প্রতি জনগণের অনাস্থার সুযোগ নেওয়া বিজেপি আসলে ফাঁকা ময়দানে গোল দিয়ে চলেছে।

ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসীবাদের কেবল বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে তার আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে ট্রটস্কিপন্থীরা ফ্যাসীবাদের উত্থান পর্বে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সাথে মাখো মাখো সম্পর্ক এবং উত্থান হয়ে গেলে বাম জোট (কমিন্টার্নের বক্তব্যের ঠিক উল্টো)-এর কথা বললেও বাংলার ট্রটস্কিপন্থীরা দৈনন্দিন তৃণমূলের সংগঠনের মধ্যে কাজ করে নির্বাচনের সময়ে বামফ্রন্টের হয়ে গলাবাজি করে (অর্থাৎ নিজ ঘরানার দুটি পরিস্থিতির ট্যাক্টিক্সকেই জুড়ে ফেলা হয়েছে)। আদতে এই অবস্থান মেকি এবং কার্যক্ষেত্রে তৃণমূলকে সহায়তা করারই পরিচায়ক। ট্রটস্কি স্বয়ং এদের কাণ্ডকারখানা দেখলে আত্মহত্যা করতেন।

বাংলায় গ্রামশীপন্থীদেরও উপস্থিতি রয়েছে। তারাও ফ্যাসীবাদের কেবল বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালানোর পক্ষপাতী। সমগ্র বাম মহলে বর্তমান বিজেপি বিরোধী আন্দোলনই আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে কিন্তু তাতেই কেবল সীমাবদ্ধ হওয়া আদতে ফ্যাসীবাদের পিচেই ক্রিকেট খেলার সমান। প্রয়োজন গণআন্দোলনের মাধ্যমে বিজেপির অর্থনৈতিক পলিসির বিরোধিতা। বর্তমানে গ্রামশীপন্থীরাও তৃণমূলের ছত্রছায়ায় যেতে উদগ্রীব। এনআরসি আন্দোলন চার ভাগে বিভক্ত। তার মধ্যে একটির মুখে সকলের কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে কেবল মুসলমান ও মতুয়াদের একত্র করার নামে কার্যত আগুন নিয়ে খেলা হচ্ছে। তাদের মধ্যে তৃণ-মাও মাণিক ফকিরের উপস্থিতি এই বিপজ্জনক আন্দোলনের ধারাকে তৃণমূলের লাভের গুড়েই পরিণত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার বিজেপির দোসর আইমিম-ও নেপোই মারে দই-য়ের মত একত্রিত ফোর্সটিকে হাইজ্যাক করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

আরেক মনীষীর দল আবার নিজেদের বাম বললেও তৃণমূল ও কংগ্রেসকে তাদের আদর্শগত মিলের কারণে জোট করে ফ্যাসীবাদকে রুখে দেওয়ার আহ্বান করছে। উগ্র ফ্যাসিস্ট শক্তিকে হারাতে যে বামেদের অগ্রণী ভূমিকা প্রয়োজন তা সামগ্রিক ভারতীয় বাম মহলেই উবে যেতে বসার সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধারা হল এই দল। এদের দিবাস্বপ্নের উৎস নিজেদের এলিট বা অর্থনৈতিকভাবে অ-বাম সাংগঠনিক ভিত্তি, যারা নিজেদের বুর্জোয়া স্বাধীনতার সংকোচনের ভীতিতে ফ্যাসিস্ট বিরোধিতায় নামে। আর ডানপন্থী পার্টিগুলির ফ্যাসিস্ট পার্টির সাথে বুর্জোয়া অনুদানের প্রতিযোগিতা দরুণ তার বিরোধিতা করার বাধ্যবাধকতাতেই তাকে বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মাথা গলিয়ে ঢুকতে হয়। উল্লেখ্য, সোশ্যাল ডেমোক্রাসি যে ফ্যাসীবাদের যমজ বোন, স্তালিনের এই বক্তব্যের ঐতিহাসিক প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় উপরের আলোচনার মধ্যে দিয়ে।

বলে রাখি, মমতা বা রাহুলদের ফ্যাসিস্ট উৎসেচক হিসেবে না ধরা মানে কার্যত ইতিহাসকেই খারিজ করা। বাল্টিক দেশ এস্টোনিয়াতে নাৎসি ঘেঁষা ভ্যাপ্স আন্দোলনের বাড়বাড়ন্তের নামে সেখানকার উদারপন্থী পার্টির নেতা কন্সট্যান্টিন প্যাটস আমাদের দেশের ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার মতন, প্রায় ৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম করেছিল, যাকে বলা হয় ‘এরা অফ সাইলেন্স’। এই সময়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ধ্বংস করে ইতালীর কর্পোরেটবাদী অর্থনীতির ধাঁচে অর্থাৎ কার্যত ফ্যাসিস্ট অর্থনীতির ধাঁচেই প্যাটসের সরকার চলেছিল।    

তাহলে উপায় কি? মনে রাখা দরকার, ফ্যাসীবাদের উত্থানের আগে অবধি বামপন্থীদের মধ্যেকার জোটকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অবস্থান ছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলের। ফ্যাসীবাদের উত্থান হলে এবং তার প্রসাদ পাওয়া/না পাওয়ার নিরিখে বুর্জোয়াদের মধ্যে বিভক্তিকরণের ভিত্তিতেই কেবল ‘ডান-বাম জোট’-এর কার্যকারিতা সম্ভব। ফ্যাসীবাদের পূর্ণ উত্থান হয়েছে কিনা এ দেশে তা নিয়ে খাতায় কলমে কিছু না লিখলেও ‘উত্থান এখনও হয়নি, উত্থানের প্রক্রিয়াতে রয়েছে’ বললেই বিপ্লবী মহল তেড়ে আসবে কারণ তা মেনে নিলে ডান-বাম-এর পরিবর্তে বামে বামে জোট করতে হয়। এক্ষেত্রে একটা কথাই আমার বলার, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির হার-জিত, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখনও পূর্ণ উদারবাদী ঝোঁক এবং সাধারণ জনগণের অতীব প্রতিক্রিয়াশীল গণমনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এখনও পূর্ণরূপে না হওয়ায় ফ্যাসীবাদ বর্তমানে উত্থানের প্রক্রিয়াতেই রয়েছে…

শুধু ‘বিজেপিকে একটাও ভোট নয়’ মানে কার্যত বিজেপিরই উত্থানে সাহায্য করা

শুধু ‘বিজেপিকে একটাও ভোট নয়’ স্লোগানে ২০১৯-এর লোকসভা লড়া হয়েছিল। পরিণতি সকলের জানা। কোয়ালিশন যুগের প্রতিক্রিয়ার অধ্যায়ে, একটি শিবিরে অর্থনৈতিক কর্মসূচীগত স্থিতিশীলতা না দেখতে পেলে (কারণ কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে জিনিষপত্রের বণ্টন ও দাম নিয়ন্ত্রণ, সবকিছুই এই প্যারামিটারের উপর নির্ভরশীল), জনগণ উল্টোদিকের শক্তিকেই যে স্থায়িত্ব প্রদান করার প্রবণতা দেখায় তা বুঝিয়ে ছিল এই নির্বাচনের ফলাফল। কিন্তু সেই ফলাফল থেকে শিক্ষা না নিয়ে আবারও বিজেপির বিরুদ্ধে দিশাহীন কর্মসূচী নেওয়া হচ্ছে শুধু ‘বিজেপিকে একটাও ভোট নয়’ স্লোগান গ্রহণের মাধ্যমে। এই স্লোগান পক্ষান্তরে তৃণমূলকেই ইনকামবেন্ট শক্তি হিসেবে ভোট দেওয়ার কথা বলছে ঠিক যেভাবে তৃণমূলপন্থী বামেরা নিজ নিজ সভা সমিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দু’একটা তৃণমূলের দুর্নীতির গাল পেড়ে আখেরে নিজেদের সাংগঠনিক মেশিনারিকে তার পক্ষেই ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে, এই স্লোগানকে ডান-বাম মহাগাটবন্ধনের পক্ষেও চালানো হচ্ছে। এই মহাগাটবন্ধন কর্ণাটকে ও গুজরাটে কার্যকারী কিছুই করে উঠতে পারেনি। বিহারে ইনকামবেন্ট জেডিইউ-এর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার লাভ ওঠাতে পেড়েছে আরজেডি, যদিও ম্যাজিক নম্বরে পৌঁছানো যায়নি। কোনও বৃহৎ গণআন্দোলন না করেই সেই লাভের গুড় পেয়ে গিয়ে লিবারেশন এবং সমপন্থীরা বাংলাতে আরজেডি-র প্রতিশব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে। মনে রাখা দরকার, এ রাজ্যে তৃণমূলের অবস্থা জেডিইউ-এর মতই অর্থাৎ ব্যাপক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাজ করছে আর কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট দলের শিবিরেও সে বর্তমানে নেই (নইলে তৃণ-বামেদের সাথে তৃণমূলের সাংগঠনিক বোঝাপড়া ঘেঁটে ঘ হয়ে যেতে পারে আর ২০০৪-এর নির্বাচনের ঘাও এখনও দগদগে), ফলে সাঁড়াশি প্রতিকূলতার দরুণ তার পতন অবশ্যম্ভাবী। তাই বামেদের নিজেদেরই ইন্ডিপেন্ডেন্টলি অ্যাসোর্ট করা দরকার   

তৃণমূল বিরোধী পালসের মাঝে জনগণ তার বিকল্প খুঁজছে। বামেরা নিজেদের সংহতি বজায় রেখে বিকল্প দাঁড় করাতে পারছেনা বলেই কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপির দিকে ঝুঁকছে এ রাজ্যের মানুষ। একটি নির্বাচনকে মাথায় রেখে একটি পার্টিকে শত্রু চিহ্নিত করলে তার প্রতিযোগিতামূলক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় কিন্তু সেই গ্রহণযোগ্যতা বিনষ্ট করতে বিরোধী শিবিরের স্থায়িত্ব প্রদর্শনকারী বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচী তুলে ধরা জরুরী। বর্তমান স্লোগান বিজেপির বদলে যে ডান-বাম জগাখিচুড়ীর পক্ষে সওয়াল করছে তার বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচী বলে কিছুই যে নেই তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচীর স্থায়িত্ব শুধু ডান বা শুধু বাম জোটের দ্বারাই প্রদর্শন করা সম্ভব, তাদের উভয়েরই নিজস্ব পরিসরে আদর্শগত মিলের কারণে। আগেই বলেছি, ফ্যাসীবাদ বিরোধিতায় শুধু ডান জোটের অন্তঃসারশূন্যতার কথা। তাই দরকার বিকল্প বাম জোট।   

দরকার বাম বিকল্প…

বামেদের পথ তো চিরকালই স্রোতের বিরুদ্ধে। কবে সব ঠিক ঠিক অবস্থায় অনুকূল পরিবেশে বিপ্লব হয়েছে? প্রতিকূলতাই বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার জন্ম দেয়।

উপরের আলোচনার পুরোটাই বর্তমান পরিস্থিতির ডিমান্ড অনুযায়ী সংসদীয় রাজনীতির কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সবসময়েই গুরুত্বের দিক থেকে প্রধান। গণআন্দোলন নির্বাচনী ফলাফলকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে আবার নির্বাচনী পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করা যায়। বিজেপির অর্থনৈতিক পলিসিগুলির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের গণআন্দোলনই গেরুয়া শিবিরের সাংস্কৃতিক ছ্যাঁচড়ামির কাউন্টার। আর বামেদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন সেই গণআন্দোলনে উজ্জীবিত জনগণ ও কর্মীদের লড়াইয়ের রসদ। তাই লকডাউনের সময় থেকে জাঁকিয়ে বসা আলস্য ঝেড়ে ফেলে, নিষ্ফল নির্বাচনী গাণিতিক অঙ্ক না কোষে এ রাজ্যের নিজস্ব সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলনের প্রস্তুতি নিন বাম দলগুলি।

বামেদের পক্ষে বাধা দুটি দিক থেকে। ধ্রুপদী বড় দলগুলি দলিলগত ডগমায় গেঁড়ে বসে আছে আর নবগঠিত দলগুলির অনেকে কর্মীগত সংখ্যাল্পতার কারণে আন্দোলনগত সংকীর্ণতায় এবং সাংগঠনিক দিক থেকে এক-ব্যাক্তি-কেন্দ্রিকতা কিংবা স্বজনপোষণগত সংকীর্ণতায় চলছে। কমরেডস্‌, এই বাধা কাটিয়ে উঠতেই হবে। সাব্জেক্টিভ মনোমালিন্য আন্দোলনের মঞ্চে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এই বাধাগুলির এবং আন্দোলনগত আলস্যের বিকল্প কংগ্রেস-তৃণমূল হতে পারে না। তাই সমস্ত বাম শক্তি কংগ্রেস-তৃণমূলকে লাথি মেরে নিজেদের মধ্যে জোট করুক।        

সমস্ত বাম শক্তিকে এক হতে বললেই তা ভন্ডুল করতে প্রশ্ন উঠবে যে সিপিআই(এম)-এর মত পার্টিগুলি আদেও বাম শিবিরভুক্ত কিনা। মনে রাখা দরকার, এই পার্টিগুলির দীর্ঘ বাম ইতিহাস এবং ক্যাডারবাহিনীর মধ্যে একাংশের সেই ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ততার কারণে সিপিআই(এম) ১৯৭০-এর দশকে স্তালিন নির্দেশিত বিপ্লবী লাইন আনুষ্ঠানিকভাবে খারিজ করে পূর্ণরূপে শোধনবাদের দিকে যাত্রা করলেও তার অন্তর্দলীয় মতাদর্শগত বিরোধগুলি বজায় থেকেছে এবং সমগ্র বাম শিবিরে সর্ববৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন এখনও বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলিরই। আর বামফ্রন্ট-ভুক্ত পার্টিগুলোর প্রতি সাব্জেক্টিভ অনীহা সমস্ত রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাকে অতিক্রম করলে তাদের বাদ দিয়েই পাল্টা বামপন্থী ফ্রন্ট গড়ে লড়াই করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া উচিৎ। বাম আন্দোলনের অ্যারিস্টোক্র্যাট অংশের নেতৃত্বে পদার্পণই বামফ্রন্টের বিচ্যুত রাজনীতির একটি উৎস। সেই বিচ্যুতির দোষে অনেক বামফ্রন্ট বহির্ভূত বাম পার্টিও দোষী। নয়াউদারবাদী যুগে বিপ্লবের অক্ষ যে অরগানাইজড সেক্টরের থেকে ফিকে হয়ে ৯৪% আন-অরগানাইজড সেক্টরের দিকে সরে গিয়েছে তা অনুধাবন প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, সমস্ত বাম দলের বিকল্প জোট তখনই ফ্যাসীবাদকে উখাতে কার্যকর যখন কংগ্রেস-তৃণমূল উভয়কেই বর্জন করা হয়েছে, নতুবা নয়।

কংগ্রেসপন্থী বামেদের কংগ্রেস প্রীতি বর্তমানে অনেকটা ম্যাচিউর করে যাওয়ার দরুণ সেখান থেকে তাদের বর্তমানে সরে আসা প্রায় অসম্ভব। একই ভাবে সাংগঠনিক নির্ভরশীলতার দরুণ তৃণমূলপন্থী বামেরাও কতটা সরে আসবে তাদের অবস্থান থেকে তা সন্দেহের অবকাশ রেখেই দেয়। তাই উভয় শিবিরকে বাদ দিয়ে বাকি বাম দলগুলির আন্দোলনগত জোটবদ্ধতা সময়ের দাবী। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হল, এই বাকি বাম দলগুলির ক্ষুদ্র সাংগঠনিক বহরের সীমাবদ্ধতা (এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় আবারও সেই আন্দোলন-ই) এবং গণআন্দোলনের মঞ্চগুলির নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনীহা। এই সমস্যাগুলি সত্ত্বেও জোট সম্ভব হলে তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করবে। একমাত্র আন্দোলনের পথেই ফ্যাসীবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব।  

বাম জোট নিম্নলিখিত ডিসেন্ডিং প্রেফারেন্সের ভিত্তিতে তৈরি হোকঃ

১. যে কেন্দ্রে আন্দোলন হয়েছে সেখানে আন্দোলনের নেতৃত্বকে প্রার্থীগত প্রেফারেন্স

২. কোনও কেন্দ্রে যে বাম দলের শ্রমিক বা কৃষক ফ্রন্টের কার্যকলাপ সবচেয়ে বেশি, তাদেরকে প্রার্থীগত প্রেফারেন্স

৩. একটি কেন্দ্রে যে বাম দলের সাংগঠনিক বিস্তার সবচেয়ে বেশি, তাদেরকে প্রার্থীগত প্রেফারেন্স

বিজেপি-কংগ্রেস-তৃণমূল কাউকেই নয়, বামপন্থীদের ভোট দিন !!!

  

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার