সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লীর কৃষক আন্দোলন

অভিজ্ঞান চক্রবর্তী 

গত ১১ই জানুয়ারী সুপ্রিম কোর্টের অতিনাটকীয় শুনানীর পর বর্তমানে দেশের আইনব্যবস্থার অবস্থান ও তার লাটাইটা যে কার বা কাদের হাতে তা জলের মতো স্বচ্ছ। গত সপ্তাহের শুনানীর পর এ কথা খুব স্পষ্ট যে সুপ্রিম কোর্ট আদতেই কেন্দ্র সরকারকে একটু বকে দিয়ে, কৃষকদের যা হচ্ছে ভালোর জন্যই হচ্ছে, এরকম ছেলে ভোলানো আশ্বাস দিয়েই বাজিমাত করতে চাইছে। কোর্টের এই প্রসিডিংস যে আসলেই একটা ভালো বলিউডি স্ক্রীপ্ট এবং সম্পূর্ণ ভাঁওতাবাজি তা কোর্টের নির্দেশগুলি ভালো করে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। প্রথমেই সরকারকে ভর্ৎসনা করে যেমন একদিকে এই কৃষিআইনকে স্থগিতাদেশ দিয়ে কৃষকদের ভরসা জেতার কৌশল ফেঁদেছে কোর্ট তেমনি অন্যদিকে এই তিন কৃষি আইনকে পর্যালোচনা করার জন্য যে কমিটি কোর্ট গঠন করেছে তার সদস্যদের পরিচয় দেখলেই গোটা খেলাটা স্পষ্ট হয়ে যায়। চারজনের এই কমিটির সদস্যরা হলেন ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ভূপিন্দর সিং মান, যার সংগঠনকে আন্দোলনকারী কৃষকেরা প্রথম থেকেই সরকারের দালাল বলে অভিহিত করে এসেছেন (গত ১৪ই জানুয়ারি তিনি কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন)। দ্বিতীয়জন হলেন শ্বেতকারী সংগঠনের সভাপতি অনিল ঘানওয়াত যিনি হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে জানিয়েছেন, "স্বর্গীয় শরদ যোশীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শ্বেতকারী সংগঠনই প্রথমে সরকারের কাছে কৃষিক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করেছিল, পরবর্তীতে যার কিছুটা বাস্তবায়িত করে কেন্দ্রীয় সরকার"। ফলে সেক্ষেত্রে তার পক্ষ যে কোনটা সেটাকে বুঝে নেওয়া কি খুব কঠিন? তৃতীয়জন হলেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ডঃ প্রমোদকুমার যোশী যিনি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের দক্ষিণ এশিয়া শাখার ডিরেক্টর আর চতুর্থজন হলেন কৃষি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অশোক গুলাঠী, যিনি ভারত সরকারের কমিশন ফর অ্যাগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যান্ড প্রাইজেস (সিএসিপি)-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী প্রাপ্ত এবং কৃষিক্ষেত্রে বাণিজ্যিক পুঁজির স্বাধীনভাবে কাজ করার অন্যতম একজন উদ্যোক্তা। উপরিউক্ত চারজন যে কতখানি কৃষকদরদী আর কতখানি বড় কর্পোরেটদের প্রতিনিধি, সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

১১ই জানুয়ারির শুনানীতে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরবিন্দ বোবদে মহিলা ও বৃদ্ধদের এই আন্দোলনে উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, "আমরা বুঝে উঠতে পারছিনা কেন বয়স্ক, শিশু ও মহিলাদের এই আন্দোলনে রাখা হচ্ছে"! তিনি মন্তব্য করেন মহিলাদের এই আন্দোলনে "রাখা হচ্ছে" এবং আরও বলেন যে তাদের "অবিলম্বে ফেরত পাঠানো হোক"। প্রধান বিচারপতির এই ন্যক্কারজনক মন্তব্যের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে দেশের প্রধান বিচারালয়ে নারী শ্রমিকের মূল্যায়ন ঠিক কি! সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি তথা দেশের সুপ্রিম কোর্টকে একথা মনে করিয়ে দিতে হয় সংগ্রাম - আন্দোলনের ইতিহাসে সংগ্রামী নারীর ভূমিকা। মনে করিয়ে দিতে হয় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পণা দত্ত, সুনীতি চৌধুরী, ইলা মিত্র, গুলাব কৌরদের মত সংগ্রামীদের নাম। এই নতুন আইনের প্রকোপে কৃষিক্ষেত্রে মহিলা ক্ষেত মজুরের অধিকার ও অস্তিত্ব আরও বিপন্ন হওয়ার সচেতনতা থেকেই মহিলাদের ব্যাপকভাবে আন্দোলনে যোগদান এই আন্দোলনকে মজবুত করেছে। ফলে মহিলাদেরকে এই আন্দোলন থেকে সরিয়ে আন্দোলনের জমিকে দুর্বল করাই কোর্টের প্রকৃত লক্ষ্য। একইসাথে সুপ্রিম কোর্টের জুডিশিয়াল বেঞ্চ চারজনের (বর্তমানে তিনজনের) এই কমিটিকে আগামী ২৪শে জানুয়ারির মধ্যেই প্রথম মিটিং করার নির্দেশ দিয়েছে। আসলে একদিকে আইনের শাসন দেখিয়ে আন্দোলনকারীদের বিভ্রান্ত করে ঘরে ফেরত পাঠানো, অন্যদিকে এই  কমিটির মাধ্যমে একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করিয়ে ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই আইনকে কৃষকদের পক্ষে মঙ্গলজনক প্রমাণ করার এই নিখুঁত চিত্রনাট্যটি পূর্বনির্মিত। কিন্তু এতকিছু করেও দমানো সম্ভব হয়নি আন্দোলনকারী কৃষকদের। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট "কানুন ওয়াপাস নহি,  তো ঘর ওয়াপাস নহি "।

গোটা লকডাউনের সময় শস্য ও আয়ের যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেটাতে না দেওয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ, না মানা হয়েছে ভূমিহীন, ছোট ও মাঝারী কৃষিজীবি, ভাগচাষী, ক্ষেতমজুরদের পক্ষে সওয়াল করা বামপন্থীদের দাবীগুলিকে। এর পরে এই তিনটি কৃষি আইন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার কাজ করে। রাজ্যসভায় পাশ (?!) হওয়া এই কৃষিআইন একদিকে যেমন দিয়েছে মজুতদারি ও কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটরাজের খুল্লা ছুট্, অন্যদিকে খুন করেছে কৃষকদের ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের অধিকারকে এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীকে বাদ দিয়ে গুদাম মাফিয়াদের হিতার্থে কৃষকদের সাথে সাথে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকেই সঙ্কটের গহ্বরে এনে ফেলেছে। ফলে, দেশের বিভিন্ন অংশে ফেটে পড়েছে কৃষক বিক্ষোভ, দিল্লীতে ধর্ণায় বসেছেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। নেতৃত্বে বিভিন্ন কিষান সংগঠনের যৌথ আন্দোলন মঞ্চ 'অখিল ভারতীয় কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি'। কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে দেশের অন্যান্য পেশার ও রাজনৈতিক সংগঠনের মানুষ সামিল হয়েছেন। ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠা এই কৃষক আন্দোলন শাসক বিজেপিকে বুঝিয়ে দিয়েছে আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোথাও সরবেন না। এমনকি সংগ্রামী কৃষকদের পক্ষ থেকে এও জানানো হয়েছে, তাঁদের দাবী অবিলম্বে না মানা হলে তাঁরা আগামী ২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনই নয়া দিল্লীর রাজপথে ট্রাক্টর র‍্যালি করবেন। দেশের সেনাবাহিনীর সাধারণ জওয়ানদের সমর্থন আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এর পরই সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের দাবী করে ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল এই বিষয়ে কোর্টের অর্ডার চেয়েছেন যাতে তারা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই র‍্যালিকে প্রতিহত করতে পারে। প্রধান বিচারপতি এই বিষয়ে কোর্ট হস্তক্ষেপ করবে না জানালেও পরোক্ষভাবে এও বুঝিয়ে দেন যে কেন্দ্রের কাছে পুরো ক্ষমতা আছে এই র‍্যালিকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার। অ্যাটর্নি জেনারেল কে.কে. বেনুগোপালকে তিনি জানান, "ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়াকে কি মনে করিয়ে দিতে হবে যে তাদের হাতে আইনের শাসন রয়েছে"। কোর্টের এই মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কোর্ট এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলেও কেন্দ্র সরকার প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে সবরকমের নির্যাতন চালিয়েই এই র‍্যালিকে থামাতে পারে। এ যেন পরোক্ষভাবে কতৃপক্ষকে খুল্লা ছুট্ দেওয়া যে তারা এই র‍্যালিকে রুখতে যে কোন পথই অবলম্বন করতে পারে!

অবশ্য কোর্টের এই অবস্থান নতুন কিছু নয়। বিগত কয়েক বছরে গগৈ, বোবদেদের সুবাদে ভারতীয়  বিচারব্যবস্থায় বারংবার নাৎসী শাসনাধীন জার্মানির বিচারব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া গেছে। একটু উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে নাৎসী শাসনাধীন জার্মানিতে সেখানকার বিচারব্যবস্থার নাৎসী সরকারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, একটি বিশেষ জাতির প্রতি বিদ্বেষ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য ভারতীয় বিচারব্যবস্থাতেও বিবর্তিত হয়েছে। এনআরসি, সিএএ, রাম মন্দিরের মতো ইস্যুগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থের কাছে সুপ্রিম কোর্টের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ এবং বাবরি মসজিদের ধ্বংসের মতো নিন্দনীয় ধর্মীয় বিভাজনের ঘটনাকে জমি বিবাদের প্রশ্নে পরিণত করার এই জঘন্য প্রক্রিয়া আসলে জার্মান বিচারালয়ের প্রবণতাকেই প্রকাশ করে। অন্যদিকে রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকান্ডের ষড়যন্ত্র মামলায় অধিকাংশ কমিউনিস্টদের মুক্তি দেওয়ার মতো জার্মান কোর্টের ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে হিটলারের বিকল্প 'জনগণের আদালত' গঠন করে সন্ত্রাস চালানোর মত প্রক্রিয়াও এ দেশে ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে। সম্প্রতি সংসদে পাশ হওয়া বিলগুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকারের আঞ্চলিক আদালতগুলিতেই বিবাদ মেটানোর ধারা যুক্ত করা সেই হিটলারী পলিসিরই পুনরাবৃত্তি। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার এই বিবর্তনই প্রমাণ করে আমরা ফ্যাসিবাদের দোড়গোড়ায় এসে পৌঁছেছি যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানও ফ্যাসিবাদের করায়ত্ত্ব। 

যদিও গত ২০শে জানুয়ারীর শুনানীতে সুপ্রিম কোর্ট এই কমিটির ইনফ্লুয়েন্সিয়াল হওয়ার দাবীকে খারিজ করেছে এবং তারই সাথে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। ৮টি কৃষক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সওয়াল করা দুশ্যান্ত দাভে এবং প্রশান্ত ভূষণ  জানিয়েছেন তাঁদের ইউনিয়ন এই আইনের বাতিলের পক্ষেই দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ এবং তাঁরা কোনও প্রকার সংশোধন প্রক্রিয়ায় আসতেই চান না। যথারীতি সেই কারণের এই ৮টি কৃষক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কেউ এই কমিটিতে পার্টিসিপেট করতে চান না। কিষাণ মহাপঞ্চায়েতের পক্ষের উকিল কমিটির পুনর্গঠনের দাবী করলে তাদের এই আন্দোলনে যোগদানের বিষয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদিও সুপ্রিম কোর্ট কমিটি গঠন ও দুই মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে অনড় থেকেছে। প্রধান বিচারপতি কৃষক ইউনিয়নগুলিকে সমঝোতার পথে যেতে বলেছেন। এ ছাড়াও কৃষকদের পক্ষের একজন উকিল এই কমিটিকে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের কৃষকদের অভিযোগ শোনার দাবী রাখলেও প্রধান বিচারপতি তা খারিজ করেন এবং জানান তা পরে ভাবা যাবে। প্রশান্ত ভূষণ জানান যে এই বিক্ষোভ সরকারের ওপর যে গণতান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুযায়ী যদি তারা ধর্ণা উঠিয়ে নেন এবং পরবর্তীকালে যদি কোর্ট আইনের উপর স্থগিতাদেশ তুলে এই আইনের পক্ষে রায় দেন তবে সরকারের ওপর আর কোনো চাপই রইবে না। প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে আবারও জানান, ২৬শে জানুয়ারীর ট্রাক্টর র‍্যালির বিষয়ে কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলেও পুলিশ-প্রশাসনকে তাদের কাজ করতে হবে। একইসাথে তিনি কৃষক ইউনিউনগুলিকে এই বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা ভাবতে বলেন।

অতএব যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে এই কমিটির রিপোর্ট কোনদিকে যেতে চলেছে সেটা সকলের কাছে পরিষ্কার। এই পরিস্থিতিতে শুধু কৃষক স্বার্থকেও অতিক্রম করে যাওয়া, এমনকি শ্রমিক বিরোধী শ্রম কোডের পক্ষে সওয়াল করা এই কৃষক আন্দোলন কি নিজেদের স্লোগানে সংকল্পবদ্ধ থাকবে নাকি সুপ্রিম কোর্টের ছুঁড়ে দেওয়া এই সমঝোতার প্রশ্নে এগিয়ে আন্দোলনের মঞ্চ দুর্বল করবে তা আগামীদিনই বলবে...

Photo courtesy: news18.com

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার