আজকের ট্রাক্টর প্যারেডঃ কোন পথে কৃষক আন্দোলন?

সায়ন নন্দী

এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালটা অন্যান্য প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালের মত ছিল না। ট্রাক্টর প্যারেডের উত্তেজনায় সমগ্র দিল্লী সকাল থেকেই গমগম করছিল। চলমান কৃষক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিশাল ট্রাক্টর প্যারেডের দিক নির্দেশ দিল্লী পুলিশের পক্ষ থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। সে পথ ধরেই ট্রাক্টর মিছিল এগোতে শুরু করে সকালে। একদিকে সেনার কুচকাওয়াচের মাধ্যমে চলছিল মোদী সরকারের পেশী শক্তির আস্ফালন আর অন্যদিকে কৃষকদের ট্রাক্টর প্যারেড ৭২তম প্রজাতন্ত্র দিবসে আম জনতার আন্দোলনের নতুন ইতিহাস গড়ছিল। কিন্তু পুলিশ যখন নির্ধারিত পথেই কৃষক মিছিলকে এগোতে বাধা দেয় মূল গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বেই, বারংবার কৃষকদের ওপর ছোঁড়া হতে থাকে কাঁদানে গ্যাস এবং শুরু হয় লাঠিচার্জ, তখন কৃষকদের জমতে থাকা ক্ষোভের স্ফূলিঙ্গ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। অর্থাৎ পুলিশের প্রোভোকেশানের ফলেই আন্দোলনকারীদের একাংশ নির্ধারিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়। অবশ্য, কবে পুলিশের নির্ধারিত পথে হেঁটে দাবী আদায় করা গেছে? অবাধ্যতাই বিপ্লব আনে। 

মিছিলের মুখ লাল কেল্লাতে পৌঁছোয় এবং সেখানে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে দেশের যুব সমাজ। পুলিশের লাঠিচার্জ চলতে থাকে। পৈশাচিক লাঠিচার্জ ও পুলিশের তৈরি করা অরাজকতার মাঝে শহীদ হন এক আন্দোলনকারী কৃষক। কিন্তু এই পৈশাচিক অত্যাচারকে লোকাতে ব্যস্ত বাজারী মিডিয়াগুলি। কেন্দ্র সরকার এবং তার তাবেদার মিডিয়া মিলে এই অরাজকতার দায় চাপাতে শুরু করে আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর। কিন্তু এই বর্বরতার মূল উৎস আসলে অমিত শাহ নেতৃত্বাধীন গৃহ মন্ত্রক কারণ দিল্লী পুলিশ তারই অধীন।

লাল কেল্লার মূল ফটকের সামনে যে স্ট্যান্ডটি আছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের সকালে পতাকা উত্তোলন করেন, সেই স্ট্যান্ডটির উপর অনেকে উঠে দেশের জাতীয় পতাকা এবং কৃষক দলগুলির পতাকা লাগানোর চেষ্টা করে। জাতীয় পতাকার অসম্মান করা হয়নি। যদিও প্রস্তুতি মিটিং-এ বেশ কিছু যুবকের এই পতাকা উত্তোলনের প্রস্তাবকে খারিজ করে কৃষক নেতৃত্ব, তবুও এই ঘটনার বাস্তবায়ন বোঝায় যে মিছিলের রাশ আন্দোলনের নেতৃত্বের হাতে পুরোপুরি ছিল না। জনতা লড়াইয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখিয়েছে কিন্তু তাকে বিপ্লবী দিশায় চালিত করার দায় নেতৃত্বের। সংগঠিত আন্দোলন ছাড়া ফ্যাসীবাদের মোকাবিলা সম্ভব নয়। যেখানেই তারা দুর্বলতা দেখবে, সেখানেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। আজকের ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সরকার প্রজাতন্ত্র দিবসের সেন্টিমেন্টের উপর ভর করে কৃষকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার ধুঁয়ো তুলতে চাইছে। 

আজকের অরাজকতার দায় কেন্দ্র সরকারের। তারা সুপ্রিম কোর্টকে সাথে নিয়ে দু'মাস ধরে বারংবার কৃষকদের আন্দোলন থেকে বিরত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আন্দোলনকারীরা কৃষক এবং সাধারন মানুষ বিরোধী নয়া কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করার দাবীতে অনড় থাকলেও কেন্দ্র সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট এই আইন দেড় বছরের জন্য স্থগিত রেখে কর্পোরেটদের স্বার্থে এই আন্দোলনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। নয়া কৃষি আইন অবিলম্বে বাতিল করা এই জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে আজ প্রধান দাবী। 

এই দাবীর বাস্তবায়ন খুন করতে কেন্দ্র সরকার পুলিশ লেলিয়ে প্রোভোকেশনের পথে হেঁটেছে। অরাজকতা তারাই তৈরি করেছে। কৃষকদের একজন শহীদ হয়েছে এবং লাল কেল্লার মত ঐতিহাসিক স্থাপত্যের কোনো ক্ষতি তারা করেনি। বরং আজ আম জনতার দখলে ছিল লাল কেল্লা যা ২০১৮ সালে ডালমিয়া গ্রুপকে লিজ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্র সরকার। উল্টোদিকে, দিল্লী পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জকে কাজে লাগিয়ে এবং গোদী মিডিয়া কৃষক বিরোধী বক্তব্য পরিবেশন করে আধা-সেনা নামানোর পথ প্রশস্ত করেছে। বর্তমান ইন্টারনেট ব্লক এবং আধা-সেনার টহল এই আন্দোলনকে ধ্বংস করতে উদ্যত। বর্তমান কৃষক নেতৃত্ব নিজেদের দায় না এড়িয়ে বিপ্লবী দিশায় আন্দোলনকারীদের পরিচালিত না করতে পারলে এই দু'মাসের লড়াই জলে যাবে। 

ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে মধ্য ও ছোট কৃষক এবং ক্ষেত মজুরদের দাবী বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। তার জন্য বড় কৃষকদের আন্দোলনের পিছু পিছু না হেঁটে, বামপন্থীদের নিজ ঘরানার শ্রেণি সচেতন দাবীগুলির ভিত্তিতে আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা উচিৎ।

প্রয়োজন সংগঠিত আন্দোলনের। প্রয়োজন বিপ্লবী নেতৃত্বের। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার