প্রসঙ্গ কিটেক্সঃ কেরলে কর্পোরেটদের সরাসরি পঞ্চায়েত দখলের কিসসা
সায়ন নন্দী
টোয়েন্টি টোয়েন্টি !!!
কি অবাক হচ্ছেন? না একদম হবেন না, কেরালার পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটি কর্পোরেট কোম্পানী করে দেখালো এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সাল ২০১৫। ২০২০টা দ্বিতীয় ইনিংস মাত্র।
২০২০-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেরালার কোচি থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরে অবস্থিত একটা ছোট্ট পঞ্চায়েত কিজাখামবালাম'কে দখল করল কর্পোরেট কোম্পানী দ্বারা চালিত একটি দল(!), নাম টোয়েন্টি - টোয়েন্টি। একটি সমগ্র পঞ্চায়েত চলে গেল সরাসরি কর্পোরেট শক্তির হাতে এবং কর্পোরেটদের দালাল পার্টিগুলো রয়ে গেল ব্যাকসিটে। একটাই শুধুমাত্র নয়, তার সাথে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে মুজহুভাননুরে (১৯টা সিটের মধ্যে ১৫টা), ঐকারাননাডুতে (১৪-র মধ্যে ১৪টা), কুনাথুনাদে (১৬-র মধ্যে ১১টা) এবং ভেঙ্গোলায় (১১টার মধ্যে ৮টা)। কিজাখামবালামে ২০১৫-তে জয়ের ব্যবধান ছিল ১৯টার মধ্যে ১৭টায় (অন্য দুটি সিটে জয়ী হয় কংগ্রেস এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া পরিচালিত কিটেক্সে'জাত দূষণ বিরোধী আন্দোলনের মঞ্চ 'অ্যাকশান কাউন্সিল এগেইনস্ট কিটেক্স পলিউশান') এবং ২০২০তে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯টার মধ্যে ১৮তে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, কিটেক্স এবং তার সহযোগী আন্না গ্রুপ মূলত বস্ত্র কারবারী বলেই পরিচিত ছিল। বর্তমানে তারা সারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিশুদের জামাকাপড় বিক্রীর সংস্থা। ২০০০ সালে এই কোম্পানী লাগাতার শ্রমিক ধর্মঘটের সম্মুখীন হয় কিন্তু বেতন বৃদ্ধির পথে না হেঁটে তারা স্থায়ী শ্রমিক ছাঁটাই করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজে নিতে শুরু করে। শ্রমিক ইউনিয়নের কাজকর্মকে এভাবেই তারা ঘুরপথে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়। কিটেক্স ডাই এবং ব্লিচিং-এর অপব্যবহার করে অতিরিক্ত পরিবেশ দূষণ করে পরিবেশ আন্দোলনের সম্মুখীন হয়। কংগ্রেস কিটেক্সের বিরুদ্ধে থাকলেও তারা সিপিআই(এম)-এর পরোক্ষ সমর্থন পেতে থাকে। ২০১২ সালে কেরালার হাইকোর্টে কিটেক্স মামলা হেরে যায় কিন্তু রায়ের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে তারা পুরো বিষয়টা ঝুলিয়ে রাখে। এরপর ২০১৩ সালে 'কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি' স্কিমের অধীনে কিটেক্সের মালিক সাবু জেকব এই 'টোয়েন্টি টোয়েন্টি' পার্টির প্রতিষ্ঠা করে ২০১৫ সালে। তারা প্রথম সে বছর পুরভোটে জয়লাভ করে কিজাখামবালামে। বর্তমানে খ্রিষ্টান ও পিছিয়ে পড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করেছে তারা।
কিটেক্সের ২০১৫ সালের জয়লাভকে প্রথমে অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি এবং শেষের দিকে তাদের প্রয়োগগত ভুলভ্রান্তির জন্য বাম এবং ডান পার্টিগুলির এক বদ্ধমূল ধারনা হয়ে যায় যে এরা আর ফিরবে না রাজনীতির মূলস্রোতে। কিন্তু 'টি টোয়েন্টি' ঘোর অনিশ্চিয়তার খেলা যে। সেরকমভাবেই টোয়েন্টি টোয়েন্টি পার্টির পর্যদুস্ত হওয়া তো দূরস্থান, রাজনীতির ময়দানে তারা কামব্যাক করল আরো ৪টে পঞ্চায়েত দখল করে। এছাড়া আরও একাধিক পঞ্চায়েতে তাদের বিরোধী দলের তকমা সুনিশ্চিত হয়েছে এবার। ইউএস-এর পূর্ব ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে কর্পোরেটরা সরাসরি নিজেদের রাজনৈতিক মঞ্চ প্রস্তুত করে নির্বাচনী লড়াইতে নেমেছে। কিন্তু ভারতে এহেন ব্যবস্থার স্পষ্টতর ইঙ্গিত এই প্রথম।কিটেক্সের মালিক টাটা বিড়লার মত অন্যান্য ভারতের পুঁজিবাদী শক্তিগুলিকে ইন্ধন জোগাচ্ছে তাদের মতো কর্মকান্ডে শামিল হতে।
টোয়েন্টি টোয়েন্টি পার্টি তাদের শাসনে থাকা অঞ্চলগুলিতে কোনোরকম প্রতিবাদ সভা এবং কোনোরকম বিদ্রোহকে দমন করে। এখন আবার ডান এবং বাম দুদিকেই কিটেক্সের সাথে সেটিং-এর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তারা কিজাখামবালামে শপিং মল তৈরি করে প্রথমদিকে বাজার দরের থেকে কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বেচতে শুরু করলেও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কোম্পানির পছন্দের পার্টির কাছে অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট না পড়ায় সেগুলি তারা বন্ধ রাখে ৬মাস ধরে। ১০ লাখের বিনিময়ে ফ্ল্যাট বিতরণের ব্যবসা খুলে বসে তারা। ভূগর্ভস্থ জলের উপর অধিকার বিস্তার করে ট্যাক্স বসাতে থাকা তারা। প্রতিবাদ থামাতে ফ্রি গিফট বিতরণ এবং সরকারী আমলাদের ঘুষ দেওয়ার পন্থা অবলম্বন করে তারা। ২০১৫ থেকে ২০২০-তে সাবু জেকবের ব্যবসা বার্ষিক ১.৫ কোটি থেকে ১০০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে জনগণের ট্যাক্সের টাকা তছনছ করে।
সাব্য জেকবের লুন্ঠনের এই অভিনব মার্কিন পন্থার বিস্তার খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের ভবিষ্যৎ-কে বিপন্ন করবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, ধ্রুপদী পার্টিগুলির লাগামহীন দুর্নীতি এবং বাম বিকল্পের নয়াউদারবাদের বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচীর অভাবেই মানুষ কিটেক্সকে ভোট দিতে বাধ্য হচ্ছে।
Comments
Post a Comment