'স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, নামাও তাকে মাটির 'পর': কল্যাণী সলভেক্স শ্রমিক ইউনিয়নের আন্দোলন চলছে
সায়ন নন্দী
দক্ষিণ দিনাজপুরের কল্যাণী সলভেক্স রাইস ব্র্যান মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক আমজাদ মিঞা নামক এক শ্রমিককে কারখানা বহির্ভূত কারণে ছাঁটাই করে দেওয়া, মজুরি চুক্তির রিনিউয়ালে মাসের পর মাস দেরী করা এবং লেবার কমিশনারের কাছে এ সংক্রান্ত ডিসপিউট উত্থাপন করার পরও তা সমাধান না করার বিরুদ্ধে গত ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২০ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার অফ ইন্ডিয়া (টিইউসিআই) অনুমোদিত কল্যাণী সলভেক্স শ্রমিক ইউনিয়নের সভা হয়। টিইউসিআই-এর পক্ষে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি এবং ভাঙড় আন্দোলনের নেতা কমঃ অলীক চক্রবর্তী। ২৪শে ডিসেম্বর বেলা ৩টের সময়ে ত্রিপাক্ষিক মিটিং-এ কোনো ফয়সালা না হওয়ায় মিলের ভেতরের কোনও মাল বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না। সেদিন রাত থেকেই শ্রমিকরা মিলের গেট অবরোধ করে রাখেন। ২৬শে ডিসেম্বর তৃণমূলের ২৫০জন গুন্ডা আগ্নেয়াস্ত্র সহ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর হামলে পড়ে। এই হামলাতে প্রচুর শ্রমিক গুরুতরভাবে আহত হন। ইউনিয়ন অফিসে অগ্নি সংযোগ করা হয়। পুলিশ প্রথমে নীরব দর্শক থাকে ও পরে শ্রমিক ধর্না মঞ্চে ব্যাপক লাঠিচার্জের মাধ্যমে কার্যত আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
দক্ষিন দিনাজপুরের এই কারখানা থেকেই ইমামি, পতঞ্জলী সহ বিভিন্ন কোম্পানীর তেল উৎপাদন হয়ে থাকে। ভেড়ির মাছের খাবারও তৈরি হয় এখানে। প্রতিনিয়ত বাজারে যেখানে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে, সেখানে শ্রমিকদের কপালে শিঁকেটি ছিড়ছে না। ২০১৯ সালে কারখানার এই একমাত্র শ্রমিক ইউনিয়নটির সাথে আলোচনা করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ১০% বেতন বৃদ্ধির দাবিতে রাজি হয়, কিন্তু পরর্বতীকালে দেখা যায় বেতন বৃদ্ধি তো অনেক পরের কথা, লকডাউন চলাকালীন শ্রমিকদের জীবনকে বিপন্ন করে কারখানা চালু রাখা হয়। লক্ষনীয়, অন্যান্য কোম্পানীর শ্রমিকদের বেতনের তুলনায় সলভেক্স-এর বেতন সূচক বেশ নিম্নমুখী ।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের আবেদন করা হয়। মালিকপক্ষের কিছু প্রতিনিধি, শ্রমিকদের প্রতিনিধি এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনারের তদারকিতে একটি ত্রিপাক্ষিক মিটিং-এর ব্যবস্হা করা হলেও সে মিটিং-এ মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দেয় যে ২০২১-এর এপ্রিল মাসের আগে (অর্থাৎ বিধানসভা নির্বাচনের আগে!) তাদের পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব।
শ্রমিকরা উৎপাদন বন্ধ না রেখেই আন্দোলনরত ছিলেন, কিন্তু মালিকপক্ষ উৎপাদন বন্ধ করে শ্রমিকদের উপর দোষ চাপাতে শুরু করে। শ্রমিকরা ধর্না মঞ্চের পাশেই গণরান্নাঘরের আয়োজন করেন এবং তৃণমূলের হামলার পরে এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটো ছোটো মিটিং-এর মাধ্যমে আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছেন। ফুলবাড়ির সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম-এল)-রেড স্টারের রাজ্য নেত্রী কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরী। নারইয়ের সভার সভাপতিত্ব করেন কমঃ মানস চক্রবর্তী এবং বক্তব্য রাখেন কমঃ রাজু সিং, কমঃ শুক্লা ভুঁইমালী সহ ইউনিয়নের শ্রমিক প্রতিনিধিরা।
গত ৪ঠা জানুয়ারী, ২০২১ শ্রমিক ইউনিয়নের অফিস পুনর্দখল করেন শ্রমিকরা। কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরী সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন যে কারখানার মালিকপক্ষ বর্তমান রাজ্যের শাসক দলের ধামাধারী হলেও আগামী ১৭ই জানুয়ারী বিজেপিতে যোগ দিতে পারে এবং বিধানসভায় লড়ার টিকিটও পেতে পারে। কমঃ অলীক চক্রবর্তী জানান যে মালিকপক্ষ পার্মানেন্ট শ্রমিকদের কাজে বহালের ক্ষেত্রে তৃণমূলের শ্রমিক ইউনিয়নে যোগদানের শর্ত রেখে 'আনফেয়ার লেবার প্র্যাক্টিস'-এ লিপ্ত হয়েছে। ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক সাথী আইজুল মিঞা বলেছেন যে রাজ্য সরকার এবং কোম্পানির এহেন গুপ্ত আঁতাতে খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। অন্যদিকে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরসি, সিএএ, অত্যাবশকীয় পণ্য আইন বাতিলেরও ডাক দিয়েছেন। এলাকার মানুষকে সাথে নিয়ে তাঁরা নিজেদের আন্দোলনকে আরো জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
Comments
Post a Comment