আবার ইঁদূর হ’

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত

জাহাজের খোলে জল ঢুকেছে, ইঁদুরেরা টের পেল কি। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ বললেন, না ঠিক তা নয়। এবার ঘরে ফিরবার পালা।

সেই কবে মালদা থেকে কংগ্রেসের নেতা, আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরি আওয়াজ ছুঁড়েছিলেন, সিপিএম-কে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দেবেন বলে। পারেন নি। যাবারকালে ব্যাটন দিয়ে গেলেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাতে। না। তিনিও পারলেন না। তবে আশা নিয়ে ভবিষ্যৎ নির্দেশ করে বলে গেলেন, মমতা পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারি মস্তানদের দিয়ে সিদ্ধার্থের চেষ্টা সাফল্য পেয়েছিলনা তেমন। তবে জমি তয়ের করে গেলেন। ওপর থেকে নীচে না নেমে নীচকে ওপরে তুলে দিয়ে গেলেন। ভুল শুধরে নিয়ে ফল মিলে গেল। বিশ্বের সেরা শক্তিধরের গিন্নী, নিজে এলেন।  সই পাতিয়ে গেলেন, টালির ঘরে ঢুকে দুধ ফেরি করে বেচা কন্যার সঙ্গে।

সুধীজনেরা বললেন, এ কী কাণ্ড। এ কী রুচি। পদের আর কোনো মান মর্যাদা রইল না। ইতরজনেরা বুঝলেন, এবার তাদের দিকে দিন ঘুরেছে। দুর্গা এবার দিদিরূপ ধরে ধরায় এসেছেন। বণেদি বাড়ির খোরপোষের ব্যবস্থা ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে জুটলেন ইতরের আখড়ায়। সেখানের রীতি হল মান্যজনকে অমান্য কর। শিক্ষিত ভদ্রজনকে ইতরভাষায় সম্বোধন কর। বণেদি বাড়ির দাক্ষিণ্য নিয়ে আর বেঁচে থাকা নয়। নিজের হিস্যা বুঝে নাও, জবরদস্তি। ভয় পাইয়ে দাও আর দখল নাও এলাকার। নিজে করে খাও, যেখানে যা পাও, যেভাবে পার। আমি আছি। দেখছ না, আমার পাশে আমার সই আছে। আছে তার পরিবার। অতএব “খাও খাও খাও”। যত পার খাও। মনপ্রাণে চাহিদা পূর্ণ করে শুধু খেয়ে যাও।

ভদ্রলোকেরা, সুধীজনেরা সরে যেতে থাকলেন। নিজেদের গুটিয়ে নিলেন, স্বভাবসুলভ সংস্কৃতির অভ্যাসের বশে। তাঁরা গুণ্ডামি করেন না নিজেরা। গুণ্ডারা নতুন নেতা পেয়ে গেছেন। তাঁদের নেতার সদম্ভ উক্তি, “আমি গুণ্ডা কন্ট্রোল করি”। ভদ্রজনেরা বললেন, ছি ছি। মান্যপদে থেকে এ কী কথার ছিরি।

সে যাক। তিনি ক্ষমতায় এলেন। বিশ্বমানের নেতার স্বীকৃতি পেলেন। অঙ্গরাজ্য  বহিরঙ্গরাজ্য বিশ্বরাজ্য তাঁকে সম্মান জানাল। রেয়াত করল। ফুলে মালায় নানা উপঢৌকনে বিবিধ পুরস্কারে বিভূষিত করল। আসলে যেমন যেমন তাদের কাজ সমাধা হচ্ছে তেমন তেমন স্বীকৃতি। কিন্তু কোন কর্মের দায় নিয়ে তাঁর আবির্ভাব সেকথা ভুলে গেলাম আমরা, চেলাদের পাকানো নানান হুজ্জত আর উৎপাতের ঝামেলায়।

মুখে স্লোগান, “বদলা নয় বদল চাই”। “সিপিএম হটাও”। “সিপিএম-এর লাল ঝাণ্ডা হটাও”। বুঝলাম না, লালের মালিকানা শুধু সিপিএম-এর নয়। লাল, দুনিয়ার তাবত মজুরের সংগ্রামের রং। বুঝলাম না, সেই রং মুছে দেবার ডাক দেওয়া হয়েছে। বদলে নীল সাদা রং লাগানো শুরু হল। সে রং মায়াবী রাক্ষসীর রং। তাই দিয়ে বাড়ির রং গাড়ির রং ।জামা জুতো পোশাকের রং। সব নীল সাদা হয়ে গেল। আলোর রং, তা-ও নীল সাদা। শুধু পারা গেল না যা, তা হল মাতৃজঠরে শুয়ে থাকা ভ্রূণ আর শ্রমজীবীর শিরা উপশিরায় বইতে থাকা রক্ত। যা নিজের রং নিয়েই টিকে রইল, শুধু সময়ের অপেক্ষায়। বাইরে নীল-সাদা অথবা ব্লু-ব্লাড-এর দাপাদাপি চলতেই থাকল।

কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। এবার গুটানোর পালা। ইঁদুরেরা কেমনে যেন জানতে পেরেছে সেকথা। মালিক এবার নিজেই হাল ধরবেন। সামনে আসবেন। আড়ালে থাকবার দিন তার শেষ হয়ে এসেছে। অতএব “মন চল নিজ নিকেতনে”। ওরা বলেন, ঘর ওয়াপসি। আমরা দেখলাম, ঘর বদলাচ্ছে। হিড়িক লেগেছে রাজনৈতিক দলের ঘরে ঘরে। ব্যাপার দেখে কথামালার ইঁদুর বেড়াল বাঘ আর মুনির কাহিনি মনে পড়ল। ক্ষমতা পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ক্ষমতাদাতার কাঁধে চড়ে বসতে চায়। এর অনেক গল্প পুরাণে আছে। এখন বাকি শুধু পরিণামটা। সে ওই কাহিনীর সঙ্গে মেলে কি না তার অপেক্ষা।

(লেখকের মতামত তাঁর একান্ত নিজস্ব)

ছবিঃ ইউটিউব

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views