বাম ছাত্র যুবদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর মমতার পুলিশের আক্রমণ এবং আজকের ১২ ঘন্টার বনধ প্রসঙ্গে
অভিজ্ঞান চক্রবর্তী
বেকারত্বের বিরুদ্ধে এবং কাজের দাবীতে নবান্ন অভিযানরত বাম ছাত্র যুব সংগঠনগুলির ওপর তৃণমূলী পুলিশের নিপীড়ন ও বর্বরতায় শতাধিক ছাত্রছাত্রী ও যুবকযুবতী আহত হলেন। এরই প্রতিবাদে বামফ্রন্ট, ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে আজ রাজ্যজুড়ে ১২ ঘন্টার হরতাল ও ধর্মঘট পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে। এই মুহুর্তে যে দুটি প্রশ্ন উঠে আসে, একঃ 'নো ভোট টু বিজেপি' বা বিজেপিকে ভোট নয় বলে তৃণমূলকেই আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির অল্টারনেটিভ হিসাবে খাড়া করা একদল বামপন্থীদের দাবী কতখানি সমর্থনযোগ্য (বা কখনই তা সমর্থনযোগ্য ছিল কিনা) এবং, দুইঃ আজকের এই হরতালই বা কতখানি সমর্থনযোগ্য।
এই প্রশ্নগুলি উঠছে তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শিবিরে একটা মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সাথে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অবস্থানে অনড় থাকায় এটা স্পষ্ট যে আদর্শগতভাবে আজ তারা কংগ্রেসী কর্পোরেট বান্ধব রাজনীতিরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতির ফলস্বরূপ একদা বামপন্থী ছাত্র ও যুব কর্মীদের খুন করে আসা কংগ্রেসী ছাত্র-যুব সংগঠনের সাথেই জোটে চলে যাচ্ছে বাম ছাত্র-যুব সংগঠনগুলির একাংশ। প্রশ্ন উঠবে, বাম ছাত্র-যুব আন্দোলনের সংগঠিত চরিত্রের সাথে সাথে তার স্বতন্ত্রতা আজ কোথায়? নাকি অনেকদিনই তা উবে গেছে? পার্টির ধামাধরা রাজনীতিই কি আজ বাম ছাত্র-যুব আন্দোলনের পাথেয়? বাম পার্টিগুলির ভ্রান্তিগুলো তুলে ধরতে কি আজকের বাম ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি অক্ষম?
কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট করে বামফ্রন্ট নিজেদের শক্তি দিয়ে লড়াই করলেও এরাজ্যে নিজেরাই শক্তিহীন হয়ে পড়ছে এবং দেশজুড়ে রিজেক্টেড কংগ্রেসকেই আসলে আসন পাইয়ে দিচ্ছে। আবার অন্যদিকে, নকশালপন্থীদের একটা বড় অংশ আসন্ন নির্বাচনে তৃণমূলকে সমর্থন করছে এবং শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে কোনো আন্দোলনকেই তারা বর্জন করতে চাইছে। অর্থাৎ, উভয়ই একটা কিংমেকার ট্র্যাপে পড়ে গিয়ে ভাবছে যে এভাবেই তারা বিজেপিকে আটকাবে। একথা সকলের কাছেই পরিষ্কার যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বর্তমান রাজ্য সরকারের ওপর ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ, বেকারত্ব যার একটা বড় কারণ এবং এই ক্ষোভ থেকেই তারা পশ্চিমবঙ্গে একটা নতুন সরকারকে আনতে চাইছে। বিজেপি নিজেদের একটা প্রধান অল্টারনেটিভ হিসাবে দাঁড় করাতে চাইছে। আসন্ন নির্বাচনে বামেদের মূলত নিজেদের শক্তি, ঐক্য বা বহর কিছুই নেই ভেবে নির্বাচনে নির্ণায়ক ভূমিকাতেই নেই আর তাই তারা কিংমেকার গেমে ফেঁসে এই জোটের রাজনীতিতেই এগোচ্ছে। কিন্তু এই পদক্ষেপের ফলে তারা আদতে নিজেদের অস্তিত্ব লোপের দিকেই এগোচ্ছে। একদিকে সিপিআই(এম)-কে ব্যবহার করে কংগ্রেস তার আসন বাড়াতে চাইবে, সিপিএম কোনো আসন পাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট জল্পনা রয়েছে, অন্যদিকে তৃণমূলও তার আসন সংখ্যা বাড়াতে চাইবে, নকশালপন্থীদের একটা বৃহৎ অংশ তৃণমূলকে সমর্থন করে নিজেরা প্রতিনিধিত্ব করবে না এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় যেটুকু যা আন্দোলন করেছে তার সুফল কেড়ে নিয়ে যাবে তৃণমূল। ফলে সমগ্র বাম মহলকে যদি আদতেই এই অস্তিত্ব লোপাটের রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হয় তাহলে নিজেদের মধ্যেকার ঐক্য তৈরী করে নিজেদের মধ্যেকার সংহতিকে বজায় রেখে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট (স্থূল নির্বাচনী ফ্রন্ট নয়) নির্মাণ করা উচিৎ। তবে, তারা হয়তো কিছু কিছু আসন পেতে পারেন এবং বিধানসভায় কিছু হলেও বাম প্রতিনিধি পাঠাতে পারেন যাদের কাজ হবে হল্লা করে, চেঁচামিচি করে তৃণমূল-বিজেপির গ্রেট গেমের স্বরূপ মানুষের সামনে তুলে ধরা। আর যদি এই ঐক্যবদ্ধ বামশিবির একটাও আসন না পায়, সেক্ষেত্রেও তারা নিজেদের মধ্যেকার ঐক্যকে মজবুত করে যৌথভাবে কাজ করে রাস্তার আন্দোলনের পথগুলির সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করবেন এবং ভবিষ্যৎ আন্দোলনের বীজবপণ করে উঠতে পারবেন। একমাত্র আন্দোলনের পথেই ফ্যাসীবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব। কিন্তু বামশিবির করছে ঠিক তার উল্টোটাই!
এবার আসা যাক আজকের নবান্ন অভিযানের প্রসঙ্গে। শিক্ষা ক্ষেত্রে লুম্পেনবৃত্তি ও চাকরির আকালের বিরুদ্ধে বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে, কংগ্রেসী ছাত্র যুব সংগঠনকেও ডেকে এনে, নবান্ন অভিযান করেছিল কাল। বেকারত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে হওয়া এই আন্দোলনে কংগ্রেসী ছাত্র-যুব সংগঠনের এই আন্দোলনে যোগদান আসলে এই আন্দোলনের ফলাফলকে নঞর্থক করে তুলবে কারণ এ দেশে নয়াউদারবাদকে আমন্ত্রণকারী কংগ্রেস ছাত্র রাজনীতি এবং ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রীকরণের বিপক্ষে। অন্যদিকে, তৃণমূলী সরকারের দলদাস পুলিশের বর্বরোচিত আচরণকেও ধিক্কার এবং এর সাথে সাথেই একদিকে বিজেপির আক্রমণ ও অন্যদিকে বামেদের আক্রমণে জর্জরিত তৃণমূলের আসল চরিত্রটা আজ বেড়িয়ে এসেছে।
একদিকে বামেরা যেরকম বারেবারে কোনো না কোনো ডানপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে একইসাথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে আনা মমতা সরকারের ফ্যাসিবাদী বিজেপির যমজ বোন হওয়ার চরিত্রকেই প্রকাশ করছে। এছাড়াও কাশ্মীরেরে অধিকার হরণ, সি.এ.এ, শ্রম কোড এবং কৃষি বিলগুলি সংসদে পাশ হওয়ার সময় তৃণমূল সাংসদদের অনুপস্থিতি কিংবা সমর্থন তৃণমূলী সেটিংবাজী প্রকাশ করে দিয়েছে। ফলে, একদিকে নয়াউদারবাদকে হাত ধরে ডেকে এনে আজকের অর্থনৈতিক সংকটের বীজবপণ করে বিজেপিকে ফ্রন্টসিটে আনা কংগ্রেস যেমন বর্জনীয়, অন্যদিকে একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপিকে জায়গা করে দেওয়া সেটিংবাজ তৃণমূলও একইভাবে বর্জনীয়।
প্রশাসনিকভাবে চাকরী দিতে ব্যর্থ মমতার পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে ডাকা আজকের এই হরতাল উপরের বিষয়গুলির কথা মাথায় রেখেই সমর্থনযোগ্য কিন্তু আগামীদিনে এই চেনা কংগ্রেস ও তৃণমূল তোষণকারী ছকেই বাম মহল এগোলে তাদেরকে বাদ দিয়েই বিকল্প আন্দোলনগত বাম ঐক্য গড়তে অগ্রসর হতে হবে।
Picture Courtesy: New Indian Express
Comments
Post a Comment