উত্তরাখণ্ড বিপর্যয়: প্রশ্ন অনেক... উত্তর কি খুঁজব আমরা?
ত্রিদীপ দস্তিদার
ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি গত ৭ই ফেব্রুয়ারীর উত্তরাখণ্ডের চামৌলি জেলায় হিমবাহগলা জলোচ্ছ্বাসের ফলে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের ঘটনা। তার ফলাফল সম্পর্কে নানা হৃদয় বিদারক সংবাদে সরগরম নানা মহল। চলছে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ। সঙ্গত কারনেই নানা দিক থেকে অনেক তথ্যও সামনে আসছে। এ বিষয়ে আরও কিছু দিক বরং আমি সাধ্যমত বলার চেষ্টা করছি। প্রথমত, এই বিপর্যয় একদিকে অনেক প্রশ্ন যেমন আমাদের সামনে হাজির করেছে, তেমনই, এই বিপর্যয় এক ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তাও বটে। আর, বহুদিন আগে থেকেই পরিবেশ আন্দোলনের বহু মানুষ, এমনকি নানা সরকারি বেসরকারি সমীক্ষায় উঠে আসা নানা সতর্কবার্তাকে অগ্রাহ্য করার ফল।
এটা আজ অনেকেরই জানা যে, তুষারাবৃত হিমালয়ের অস্থিত ভূমিরূপ, তার ঢাল(slopes), তার বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ভূমিরূপ উচ্চমাত্রার ভূকম্পপ্রবণ। এমন একটি প্রাকৃতিক অস্থিত অঞ্চলে পাহাড় কেটে রাস্তা, ব্রীজ, টানেল, বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নানা রকম নির্মাণ প্রকল্পে বিস্ফোরক ব্যবহার অতি বিপজ্জনক। তা ছাড়াও উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত যেখানে সেখানে নদীকে বড় বড় বাঁধ দিয়ে বাঁধা, বাঁধ বেঁধে নদীকে শুকিয়ে মারা যে বাস্তুতন্ত্র সহ গোটা সভ্যতাকেই বিপন্ন করে তোলে, এও তো চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। তা সত্ত্বেও ঐ সব অঞ্চলে কেনো বিপজ্জনক নির্মাণ সমানে চলেছে?... নির্মাণ কার্যের আগে ঐ সব অঞ্চলে কি কোনও পরিবেশ সমীক্ষা হয় না? হলেও, সেই সব সমীক্ষার ফল কি ঐ ধরনের নির্মাণকে সমর্থন করে? নাকি পরিবেশ প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাবকে অগ্রাহ্য করেই বিশেষ কোনও তাগিদকে মাথায় রেখেই এ ধরনের নির্মাণ কাজ চালানো হয়? এবং ভবিষ্যতেও হবে?
যে কোনও সচেতন মানুষের অভিজ্ঞতাই বলে, যে কোনও বড়সড় প্রকল্প রূপায়নে প্রচুর পুঁজি নিবেশ করতে হয়। সেই পুঁজির তল্পিবাহকরা মুখিয়ে থাকে প্রকল্পের বরাতের আকাঙ্খ্যায়। সে সরকারের নামে বকলমে বেসরকারি পুঁজিই হোক বা সরাসরি বেসরকারি উদ্যোগই হোক। ফল কী হয়? বিপুল হারে জীব বৈচিত্র বিপন্ন হয়, উদ্বাস্তু তৈরী হয় আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা তো বলা-ই বাহুল্য। ঘটনা হ'ল এই, তা সত্ত্বেও 'উন্নয়ন' চলে। পরিবেশ সমীক্ষার নামে ঘুরিয়ে সেই বড় বড় প্রকল্পগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। হিমালয় অঞ্চলে বড় আকারের প্রায় কয়েকশো বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প সেই তালিকায় আছে।হিমালয়ের কোলে চীন নেপাল ভূটান ভারত ইত্যাদি দেশগুলোতে এই প্রকল্পগুলো 'উন্নয়ন'-এর সাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে!!! চামৌলির বিপর্যয়ে কি সত্যিই এই প্রকল্পের নির্মাতারা শিক্ষা নেবে? সন্দেহ আছে। অন্তত এ দেশের ক্ষেত্রে তো বলা-ই যায়। সাম্প্রতিক অতীতে, ২০১৩ সালেই উত্তরাখণ্ডেই ভয়াবহ প্লাবন, ধ্বস থেকে কি সত্যি কোনও শিক্ষা নেওয়া হয়েছিল, তা না হলে এর পরও কীভাবে ঐ অঞ্চলে বিস্ফোরক ব্যবহার করে বাঁধ, রাস্তা, টানেল ইত্যাদি নির্মাণ চলেছে??... এবারেও এই জলোচ্ছ্বাসে ঋষিগঙ্গার ওপরে নির্মিত তপোবন বাঁধ 'উন্নয়ন'-এর তালিকা থেকে স্রেফ মুছে গেছে!! ধ্বংস হয়েছে সাঁকো, নীরিহ গ্রামবাসী, পশুপাখি সহ শত শত প্রাণ!! এর পরেও এই উন্নয়নের কারিগররা থেমে থাকবে, এটা ভাবা ভূল। হিমালয় ও তৎসংলগ্ন উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশে বেশ কয়েকটি ছোট বড় বাঁধ পরিকল্পনা এখনও স্থগিত হয়েছে বলে তো শোনা যায় না!! শুধু কি তাই? ভাবুন, আমাদেরই সরকারের 'চারধাম রাস্তা প্রকল্প'-এর কথা!! পরিবেশ আন্দোলনকারী তো বটেই, এমন কি খোদ সর্বোচ্চ আদালতকে অগ্রাহ্য করেই প্রায় ৯০০ কিলোমিটা দীর্ঘ এবং ১০ মিটার চওড়া জাতীয় সড়ক নির্মাণ!!.. সেই উত্তরাখণ্ডেই!!.. কার স্বার্থে??.. শুধুই কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষকে পূণ্যের দরজা দেখাতে?? সত্যিই?? মনে রাখা ভালো, এই মেগা প্রকল্পের সাথে কিন্তু ১২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের গল্পও জড়িয়ে আছে!!!... কার পূণ্যে যে কে ভাগ বসায়!!!.. প্রকৃতি নিধন, বিপন্ন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, জীবন-জীবিকা হারানো.. এসবের বিনিময়ে পূণ্য অর্জনের জন্যই কি এমন একটি ভঙ্গুর,অস্থিত অঞ্চলে বেআক্কেলে এরকম ধ্বংসলীলা চলতে পারে??
পরিবেশবিদ থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানী, প্রায় সবাই এক শ্রেণির মানুষের বেপরোয়া প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হ'ল, এই 'এক শ্রেণি'র মানুষ' কারা??.. প্রকৃতিকে ধ্বংস করার ছাড়পত্রই বা এদের কে দেয়, আর কেনই বা দেয়?.. কিসের বিনিময়ে?.. আমরা তো জানি, কোনো ছোট বড় মাঝারি, যে কোনও প্রকল্প রূপায়নের আগে নানা ধরনের খোঁজখবর, সমীক্ষা'র প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে, যে এলাকার সম্ভাব্য 'উন্নয়ন' প্রকল্প, সেই এলাকার জল মাটি বাতাস মানুষ, নামানুষ ও তাদের বাসস্থান জীবন জীবিকা স্বাস্থ্য ইত্যাদির সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। তার জন্য সরকার তো ২০০৬ সালে আইনও করেছে। সেই আইন মোতাবেক পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য প্রকল্পের প্রভাব কী হতে পারে, তাছাড়া, এলাকার মানুষজনের মতামতও নাকি যাচাই করার কথা। কিন্তু বাস্তবে কী দেখেছি? ২০০৬ সালে প্রবর্তিত (EIA বা Environment Impact Assesment) আইন সংশোধন করে পাশ হল (EIA 2020) যেখানে প্রকল্প এলাকার মানুষের প্রশ্ন তোলার সুযোগটাই কেড়ে নেওয়া হোল!!.. এমনকি পরিবেশ সমীক্ষার কাজ শুরুর আগেই প্রকল্পের কাজ চালু করার ছাড়পত্র মঞ্জুর করারও বিধান রয়েছে এই আইনে।ভারতবর্ষের মানুষের, বিশেষ করে প্রান্তিক, গরীব, আদিবাসী, অরণ্য নির্ভর, মূলনিবাসী মানুষের এই বৃহৎ পুঁজিনির্ভর তথাকথিত উন্নয়নের নির্মম অভিজ্ঞতা আছে। এই পরম্পরা কোনও নতুন ঘটনা নয়। বলা যায়, যে দিন থেকে নয়াউদারবাদী অর্থনীতির হাত ধরেছে এ দেশ, সেদিন থেকে এই পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংসকারী নানা প্রকল্পের রথের চাকা দ্রুততর হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষিতে জলসেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি আধুনিক সভ্যতা বিকাশের অন্যতম শর্ত। কিন্তু তার মানে কি এই যে, হাজার হাজার বছর ধরে নদ-নদী ঘিরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতাকে 'আধুনিক সভ্যতা'র শর্ত মেটাতে গিয়ে বলি দিতে হবে?? যে নদীকে ঘিরেই এই সভ্যতার বিকাশ, সেই নদীকে উৎস থেকে মোহনার পথ পেরোতে প্রতি পদে পদে এতো বাঁধ, এতো বাধা পেরোতে হবে কেনো? এই প্রশ্ন কি আজকের? আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে, ভারতের প্রধান নদী গঙ্গার বুকে ফরাক্কা বাঁধ দেওয়া নিয়ে এই প্রশ্নকে ঘিরে তীব্র বিতর্ক হয়। সেদিনও নদী বিশেষজ্ঞ প্রয়াত কপিল কুমার ভট্টাচার্যকেও 'বিদেশী শক্তির চর' অপবাদ সইতে হয়েছিলো!! (আজ হলে হয়তো কপিল বাবুকে 'দেশদ্রোহিতা'র দায়ে জেলে থাকতে হোত!!).. যদিও তাতে সত্যের কোনও নড়চড় হয়নি!! আজ সেই বাঁধই এক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে!!.. 'নদীকে মুক্ত কর' আজও কম প্রাসঙ্গিক কি? বিগত দশ বছরের মধ্যেই নদীবক্ষে খনন, বাঁধ দেওয়ার বিরোধিতায়, গঙ্গাকে বাঁ চানোর দাবি নিয়ে আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন স্বামী নিগমানন্দ, অধ্যাপক জি. ডি. আগরওয়াল প্রমুখ। হিমালয় থেকে নিয়মাগিরি, নর্মদা থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের আপার ড্যাম, লো য়ার ড্যাম আর প্রস্তাবিত টুর্গা ড্যাম প্রজেক্ট.. এর বিরুদ্ধে অতীত থেকে আজ পর্যন্ত ছোট বড় প্রতিবাদ বিক্ষোভও চলমান। এমনকি আইন আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে এই আন্দোলন। সরকারী স্তরে তো বটেই, এমন কি আদালত স্তরেও যথারীতি চলছে নানা টালবহানা!!.. তবে কি ঐ সব তথাকথিত 'উন্নয়নওয়ালা' বড় বড় কর্পোরেট প্রভুদের প্রসাদ 'বিচারব্যবস্থা 'র আঙিনায়ও পৌঁছে গেছে?? এ প্রশ্নগুলো সচেতন মানুষ তো অবশ্যই তুলবেন। আদতে এই সব প্রকল্পগুলি, পুঁজিদাস, ক্ষমতার অলিন্দে পদচারনা করা তথাকথিত মূল ধারার সরকারী ও বিরোধী (আগামী দিনের সরকারী..) নানা রঙ-এর নির্বাচিত (পূর্ব নির্ধারিত বা কর্পোরেট মনোনিত বললে কি অতিরঞ্জিত হবে?) 'নীতি' বা 'দূর্নীতি' নির্ধারকবৃন্দেরই তাদের প্রভূদের চরণে মহা ভেঁট!!! বছরের পর বছর "টুইডেলডি থেকে টুইডেলডাম...টুইডেলডাম থেকে..."... এদের কজন প্রকৃতি পরিবেশের এই বিপর্যয়ের কথা তাদের কর্মসূচীতে ঠাঁই দেয়?
'উন্নয়ন'-এর এই আগ্রাসনের বলি মানুষের জন্য লড়াই তীব্র হোক। এটাই মূল ধারার রাজনীতি হোক।কিন্তু, মানুষ যেই বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম বাসিন্দা, সেটা না বাঁচলে এ লড়াই কেবল পেশী আস্ফালনেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে না কী??.. লড়াই করে কিছুদিনের জন্য হলেও কিছু মানুষের পূনর্বাসন সম্ভব, কিন্তু বাস্তুতন্ত্রের পূনর্বাসন সম্ভব??
এ তো গেল একটা ধারা, কিন্তু অন্যদিকে??.. এতো যে বিজ্ঞান ক্লাব, ইকো ক্লাব, এগুলোর ভূমিকা কী? এখানে একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা হল, এদের একটা অংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করার কাজে নিজেদের যুক্ত রাখতে চায় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরও যে একটা রাজনীতি আছে, তা থেকে বিজ্ঞান আন্দোলনকে দূরে রেখে এক ধরনের বিশুদ্ধতার চর্চা করতে চায়। বিজ্ঞান ও যুক্তিমনস্কতা ছাড়া আজকের এই পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের কারন সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের নামে প্রযুক্তিকে মুষ্টিমেয় কিছু বৃহৎ পুঁজিপতির হাতে কুক্ষিগত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার আন্দোলনও বিজ্ঞান আন্দোলন। নতুন নতুন ঝকমকে প্রযুক্তির উদ্ভাবন সবসময় বিজ্ঞানের অগ্রগতির সূচক নয়। যেকোন নির্মাণই কোন না কোন শ্রেণিস্বার্থ বহন করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাও এর বাইরে কোন বিমুর্ত বিষয় নয়।আজকের এই প্রকৃতি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারন বুঝতে হলে চলতি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমাজকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্লেষণ করা দরকার। দরকার সংকীর্ণ দলীয় ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে গণবিজ্ঞানের প্রকৃত রাজনৈতিক সূচীমুখ সুনির্দিষ্ট করা। হিমালয়, নদ-নদী, অরন্য ধ্বংসের বি রুদ্ধে সচেতন হওয়া ও জনমানসে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ অবশ্যই সমাজ বদলের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক কাজ। প্রকৃত বিজ্ঞান আন্দোলনেরই কাজ।
ত্রিদীপ দস্তিদার 'হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদ'-এর অন্যতম সংগঠক।
Picture Courtesy: Business Today
Comments
Post a Comment