ইস্ট ওয়েস্ট করিডোর প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণঃ ক্ষতিপূরণের দাবীতে আন্দোলনরত আলিপুরদুয়ারের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা

রূপক গায়েন 

ইস্ট ওয়েস্ট করিডোর প্রকল্পের অধীন ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রের বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার জমিদাতাদের প্রতি প্রবঞ্চনার পরিকল্পনা রূপায়ণ করেছে। ২০০৪ সালে ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া (এনএইচএআই) এ রাজ্যে ইস্ট ওয়েস্ট করিডোর তৈরীর জন্য দুটি বিকল্প রাস্তার প্রস্তাব দেয়। প্রথমটি হাসিমারা থেকে বীরপাড়া হয়ে করোনেশন সেতুর রাস্তা, যদিও পরিবেশজনিত কিছু সমস্যার কারণে এই রাস্তাটির প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি। সেই কারণে আলিপুরদুয়ারের সলসলাবাড়ি থেকে ফালাকাটা পর্যন্ত প্রায় ৪১.৬৫ কিমি রাস্তা সম্প্রসারণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই রাস্তা দিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছতে ত্রিশ কিমি কম যেতে হবে এবং জনবহুল জায়গার মধ্যে দিয়ে রাস্তা হওয়ায় অনেক বেশি মানুষের  কাছে পরিষেবার সুযোগও তৈরি হবে বলে জানানো হয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফে। ফলে আলিপুরদুয়ারের ১ নং ব্লকের প্রকল্প সংলগ্ন ২৫০জন ব্যবসায়ী এবং ২নং ব্লকের চেনপাড়া, শোভাগঞ্জ, চাপড়ের পাড়, ভেলুক ডাবরি এবং সলসলাবাড়ি, এই পাঁচটি মৌজার (চারপাশে রাস্তা দিয়ে ঘেরা জমির  অংশকে মৌজা বা স্থানীয় ভাষায় ডাবরি বলে) প্রায় ৫০জন কৃষক পরিবারের ক্ষেতি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে। ইতিপূর্বে নদীর উপর ব্রিজ তৈরীর প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণকালে ব্যবসায়ীদের রাজ্য সরকার উচ্ছেদ করলেও ক্ষতিপূরণের বিন্দু বিসর্গ সরকার দেয়নি, তাই নিজেদের জমি হারানোর শঙ্কা থেকেই ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে 'ব্যবসায়ী সংগ্ৰাম সমিতি' গঠন করে আন্দোলনে সামিল হন। ২০১০ সালে স্থানীয় সিপিআই(এম), তৃণমূল এবং বিজেপির নেতারা একই মঞ্চে মিটিং করলেও সেটিং করে একে একে সবাই সরে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা 'কৃষি বাস্তু সংগ্ৰাম কমিটি' নামে একটি সংগঠন তৈরী করে দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন। আন্দোলনকারী রতন রায় জানিয়েছেন যে প্রকল্পের স্বার্থে তাঁরা জমি দিতে ইচ্ছুক তবে জমি অধিগ্রহণ আইন এবং ন্যাশনাল হাইওয়ে অ্যাক্ট, ১৯৫৬ মেনে তাঁদের কৃষিজমির হস্তান্তরের ক্ষতিপূরণ বাবদ জমির বর্তমান বাজারমূল্য দিতে হবে যাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গররাজি। খুবই কম অঙ্কের ক্ষতিপূরণ কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে দেওয়ার অভিযোগও উঠছে এবং সেখান থেকেই জমিজটের সূত্রপাত। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সংগঠন 'ব্যবসায়ী সংগ্ৰাম সমিতি'-র নেতা রানা পাল জানিয়েছেন যে ল্যান্ড অ্যাকুইজিশান অ্যাক্ট, ২০১৩ অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ, পূনর্বাসন এবং পূণর্গঠনের দাবী তাঁরা তুলেছেন। সরকার কর্তৃক সার্বিক মূল্যায়ণের মাধ্যমে জমির দাম নির্ধারণ হচ্ছে না এবং জমির প্যাটার্ন বিভিন্ন রকমের হওয়ায় রাস্তায় এক জায়গায় জমির দাম ডেসিমেল প্রতি ২৫,০০০ টাকা হলেও আরেক জায়গায় সেটির দাম ডেসিমেল প্রতি ১২,৫০০০ টাকা কিন্তু মূল্য নির্ধারণের সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বেশকিছু বছর জমি অধিগ্রহণ পর্ব স্থগিত থাকলেও ২০১৫ সাল থেকে আবার অশান্তির সূচনা। বিনা ক্ষতিপূরণে গায়ের জোড় দেখিয়ে আবার অধিগ্রহণ শুরু হয়েছে। ৯ই নভেম্বর, ২০২০ চাপড়ের পাড় ১নং গ্ৰাম পঞ্চায়েতের চেকো চৌপথি থেকে বিক্ষোভ মিছিলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সামিল হন যা মহাকাল চৌপথিতে গিয়ে শেষ হয় এবং সেখানে তাঁরা একটি সভাও করেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বলপূর্বক তাঁদের দাবী অমান্য করে জমি অধিগ্রহণ করলে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নামার ভাবনাচিন্তাও তাঁরা নিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যেই সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে তাঁদের এই আন্দোলনে বাধা দিয়ে অধিকার আদায়ের পথে অন্তরায় হয়ে উঠছে। 


প্রকল্প বাস্তবায়নে কেন্দ্র এবং রাজ্য যুযুধান দু'পক্ষের সেটিং-এর ভূমিকা নিন্দনীয়। একে অপরের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের দায়ভার সুকৌশলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় সংস্থা 'এনএইচএআই' প্রকল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই মর্মে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিলেও নিজেরা জমির ন্যায্য মূল্য দিতে নারাজ। অপরদিকে রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে এক প্রকার নিজেদের হাত-পা গুটিয়েই বসে আছে। সাধারণ মানুষের দুয়ারে কেন্দ্র সরকার আসে, দুয়ারে বসে গৃহমন্ত্রী খাবারও খায়, দুয়ারে দাঁড়িয়ে মিথ্যে প্রতিশ্রুতিও দেয় এবং জুমলার আড়ালে জনসমর্থন কুড়িয়ে চম্পট দেয়। সাধারণখেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা পড়ে থাকে সেই তিমিরেই। ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহত দীর্ঘমেয়াদী এই আন্দোলনের সাথীরা আগামী দিনে সরকারের তঞ্চকতার বিরুদ্ধে বঞ্চিত মানুষগুলোর অধিকারকে সুদৃঢ় করতে আইনী লড়াইতে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।


নিজেদের আন্দোলন সম্পর্কে জানাচ্ছেন রানা পাল

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার