দেশপ্রেমী

প্রভাত পট্টনায়ক 

আমরা একটি উদ্ভট পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি। এরকম উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে গ্রাহকরা খাদ্য শষ্যের ফলন চান জনসাধারণের বিতরণ ব্যবস্থায় সরবরাহের জন্য, অন্যদিকে উৎপাদকরা অর্থকরী শস্যে স্থানান্তরিত হওয়ার ফলস্বরূপ আর্থিক লাভের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে তা করতে নারাজ হন। সরকারকে এই বিরুদ্ধ স্বার্থের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে হয়। তবে ভারতে বর্তমানে কৃষকরা খাদ্য শষ্য ফলনের থেকে সরে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা পোষন করছেন না, এমনকি গ্রাহকরাও চান যে জনসাধারণের বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই খাদ্য শষ্য সরবরাহ করা হোক। তাদের মধ্যে কোনও স্বার্থের বিরোধ নেই যে সরকারকে মধ্যস্থতা করতে হবে। তবুও, সরকার কৃষকদের খাদ্য থেকে অর্থকরী শষ্য ফলনের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে যা জনসাধারণের বিতরণ ব্যবস্থাকেই নষ্ট করবে।

এই পরিবর্তন কার্যকর করাই কৃষি আইনগুলির লক্ষ্য। সরকারী অর্থনীতিবিদ, যাঁরা এই আইনগুলির পক্ষে কথা বলছেন,‌ তাঁরা এই পরিবর্তনের সুবিধার উপর জোর দিয়ে চলেছেন। এখানকার সরকার জনগণের মধ্যেকার স্বার্থের বিরোধের মধ্যস্থতা করছে না; স্পষ্টতই সরকারের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে, যা সে উৎপাদক এবং গ্রাহকদের নির্বিশেষে জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, যার বিরুদ্ধে কৃষকরা দিল্লীর তীব্র শীতে আন্দোলন করছেন। এটি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের নয়, জনগণ বনাম সরকারের বিরোধের উদ্ভট একটি উদাহরণ।

তেমনি, কৃষকরা চুক্তি চাষ প্রত্যাখানে সর্বসম্মত; তবুও সরকার কৃষকদের স্বার্থের দোহাই দিয়ে এই বিলগুলির মাধ্যমে চুক্তি চাষ চাপিয়ে দিচ্ছে। আবার, জনগণের কোনও অংশের দাবীতে সরকারের সাড়া দেওয়ার ঘটনা এটা নয়; স্পষ্টতই সরকারের নিজস্ব উদ্দেশ্য রয়েছে যা সে জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু, সরকারের নিজস্ব স্বার্থ কী হতে পারে? যদিও এটি সুস্পষ্ট যে সরকারের নিজস্ব স্বার্থ কর্পোরেটদের এবং আন্তর্জাতিক কৃষিব্যবসার স্বার্থের সাথে মিলে যায়, তবুও সরকারের জবাব হবে যে তারা ‘জাতীয় স্বার্থ’ তুলে ধরছে। কর্পোরেট স্বার্থকে এভাবেই "জাতীয় স্বার্থ" হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি নরেন্দ্র মোদী শাসনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি কর্পোরেট-হিন্দুত্ব জোটের লক্ষণ যার কান্ডারী মোদী এবং যার মাধ্যমেই তিনি ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।


বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভটতা হলঃ এমনকি ডানপন্থী সরকারগুলিও জনগণের কিছু অংশের স্বার্থ রক্ষার দাবী করে তাদের কর্পোরেটপন্থী নীতিগুলি ন্যায়সঙ্গত করে তোলার জন্য। ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে নিজের আক্রমণকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন মার্গারেট থ্যাচার, যার বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়নগুলি অভিযোগ করেছিল এবং এতে জনগণের প্রচুর ক্ষতিও হয়েছিল। তবে ভারতে একতরফা এবং অকৃতজ্ঞ এমন একটি ব্যবস্থার প্রণয়ন করা হচ্ছে যা জনগণের কোনও অংশ কখনও চায়নি, এমন ব্যবস্থা যা জনসাধারণের বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার লক্ষ্য রাখে, যা জনগণের প্রচন্ডভাবে বিরোধী এবং বিপুল সংখ্যক লোক এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করছে; তাও এই সবকিছুর সদর্থক প্রচার চলছে কেবল কর্পোরেট স্বার্থের জন্য। গণতন্ত্রে এটি নজিরবিহীন।

সরকার দাবী করবে যে যেহেতু ২০১২ সালের সংসদ নির্বাচনে তারা জিতেছে, তাই তারা যে ‘সংস্কার’ চায় তা আনার ম্যান্ডেট রয়েছে। তবে এটি বেশ কয়েকটি কারণে ভ্রান্ত। প্রথমত, এটি নীতিগতভাবে ভুলঃ একটি নির্বাচনে বিজয়ী সরকার যা পছন্দ করবে তাই করার আদেশ গণতন্ত্র তাদের দেয় না। দ্বিতীয়ত, ২০১২ সালের নির্বাচন ‘কৃষি সংস্কার’ ইস্যুতে লড়াই করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, এই সংস্কারগুলি কখনই এই ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হতে পারেনি, তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল পুলওয়ামা আক্রমণ এবং বালাকোট বিমান হামলাকে কেন্দ্র করে। তৃতীয়ত, রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে যার ফলে আইনসভায়ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা তার তাৎপর্য হারিয়েছে।

নির্বাচনের লড়াই ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের আগে বিরোধীদের ভাঙিয়ে আনা সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে এবং এটি ব্যয়বহুলও। এবং নির্বাচনে যে-ই জিতুক না কেন, সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের লক্ষ্যে অন্যান্য দলের থেকে লোক ভাঙিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়। এই সমস্ত কারণে, সবচেয়ে বেশি অর্থ সাথে থাকা দলের অন্যদের চেয়ে সুস্পষ্ট আধিপত্য রয়েছে; এবং যেহেতু কর্পোরেটরা এই জাতীয় অর্থের মূল উৎস, তাই ক্ষমতায় আসার জন্য তাদের সাথে জোট করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে যার জন্য তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি তাদের সাম্প্রদায়িক-মেরুকরণের অ্যাজেন্ডা এবং কর্পোরেট আর্থিক সহায়তার বলে এই জাতীয় বাণিজ্যিক রাজনীতিতে আধিপত্য প্রয়োগ করতে পারে। কর্পোরেটদের যে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া রয়েছে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে কৃষক ও কৃষির উপর নিয়ন্ত্রণ। 

কর্পোরেটরা তাদের প্রতি আরোপিত এই গুরুত্বের কারণে বিশেষ লাভবান হয়, তাদের মধ্যে একটি অংশ, একটি আপস্টার্ট অংশ, সাধারণত অন্যান্য, আরও প্রতিষ্ঠিত, অংশগুলির চেয়ে বেশি লাভ করে। ড্যানিয়েল গুরিন (ফ্যাসিজম অ্যান্ড বিগ বিজনেস) দেখিয়েছিলেন যে ১৯৩০-এর দশকে জার্মানিতে একচেটিয়া মূলধনের একটি অংশ, অস্ত্র ও উৎপাদকদের সরঞ্জাম তৈরিতে নিয়োজিত ছিল, যা টেক্সটাইল ও ভোগ্য পণ্যের সাথে জড়িত পুরানো অংশের তুলনায় নাৎসিদের সাথে কর্পোরেট জোটের বিশেষ সুবিধা লাভ করেছিল। জাপানে, নতুন পরিবারগুলি, যেমন শিংকো জাইবাটসু, ১৯৩১ সালে ক্ষমতায় আসা ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থায় মিতসুইয়ের মতো পুরানো পরিবারগুলির চেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল; এদের সাথে কর্পোরেটদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সমকালীন ভারত যদিও ১৯৩০-এর দশকের জার্মানি বা জাপানের থেকে আলাদা, তবুও নতুন কর্পোরেটদের একাংশের বিশেষ সুবিধালাভের নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়। এর ফলেই কৃষকদের বিক্ষোভ ত্বরান্বিত হচ্ছে। 

মোদী কর্পোরেটদের "সম্পদ স্রষ্টা" হিসাবে চিহ্নিত করে জাতীয় স্বার্থের সাথে কর্পোরেট স্বার্থ, বিশেষত এই নব্য অংশের স্বার্থ চিহ্নিত করার ভিত্তি প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি একেই ‘জাতির’ সম্পদ বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই বর্ণনার দ্বারাই তিনি ব্যক্তিগত সম্পদকে জাতীয় সেবায় উত্থাপন করেছিলেন এবং যারা এই ধনসম্পদকে ‘জাতি’-র সুবিধার জন্য দান করেছিলেন তাদের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের যোগ্য হিসেবে গণ্য হয়েছিল। এই বর্ণনা অনুযায়ী সমগ্র জনতাকে এই উর্ধ্বতন কর্পোরেটগুলির দাবী মেনে চলার অনুস্মরণ করতে হবে; এতেই জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়, কারণ এই কর্পোরেটদের দ্বারা সৃষ্ট সম্পদ সকলের উপকারে আসে।

মোদি সরকার এইভাবে ‘জাতি’-র ধারণাটিকে উল্টে জনগণের সাথে চিহ্নিত একটি সত্তা থেকে কর্পোরেটদের, বিশেষত নব্য কর্পোরেটদের সাথে চিহ্নিত সত্তায় রূপান্তরিত করেছে। কৃষি বিলগুলি এই উলটপুরাণকেই প্রকাশ করে।

এটি অবশ্য আমাদের উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওয়েস্টফালিয়ান শান্তি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে যে 'জাতি' ধারণাটি বিকশিত হয়েছিল তা ছিল সাম্রাজ্যবাদী, অসহিষ্ণু (একটি "অভ্যন্তরীণ শত্রু" চিহ্নিত ছিল), এবং এর চরম পরিণতিতে বেশকিছু লোকেরা কেবল এর জন্য যজ্ঞাহুতিতে পরিণত হয়েছিল। এর বিপরীতে, ভারতের মত দেশগুলিতে উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ ছিল একেবারে আলাদা স্বতন্ত্র ঘটনা। এই মতধারা দেশকে সহিষ্ণু হিসাবে দেখেছে, যার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল; এবং এটি জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতিতে দেশের অগ্রগতি দেখেছিল। মোদী সরকারের দেশ সম্পর্কে ধারণা এর একেবারে বিপরীত এবং ইউরোপের ক্রমবর্ধমান ধারণার নিকটবর্তী, যার যৌক্তিক পরিণতি হল ফ্যাসিবাদ।

দিল্লীর আশপাশে জড়ো হওয়া কৃষকরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই মোদী সরকারের বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করছে। তারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করছে, হিন্দু, শিখ ও মুসলিম কৃষকরা যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার থেকেই এই বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। তারা, কৃষিতে কর্পোরেট দখলদারিত্বের বিরোধিতা করে, একগুচ্ছ কর্পোরেট হাউসগুলির সাথে ‘জাতি’ পরিচয় অস্বীকার করে। জনগণকে গণবিতরণ ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড় করানোকে তারা জনগণের উন্নতিকল্পেই দেখছে। কৃষক আন্দোলন মোদী সরকার দেশের যে ধারণা হাইজ্যাক করেছিল তা তার কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। 

(প্রবন্ধটি প্রথম টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ১৩ই জানুয়ারী ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।) 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার