গণতন্ত্র ও মায়ানমার: আজকের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট কি?
অকৈতব জানা
১লা ফেব্রুয়ারী, রবিবার, এক এরোবিক্সের শিক্ষিকা একটা ভিডিও তার ইউটিউব চ্যানেলের জন্য রেকর্ড করা চালু করেছেন, এমন সময়ে দেখা গেল, পিছনেই সারি সারি মিলিটারি গাড়ি ছুটে যাচ্ছে দেশের গণতন্ত্র হরণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেইদিন রাতেই অং স্যান স্যু কি এবং তার অনুগামীদের আটক করল মায়ানমারের মিলিটারি জুন্টা। দেশের ইন্টারনেট পরিষেবা এবং সকল প্রকার গণমাধ্যম নিষ্ক্রিয় করা হয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য। মিলেটারির তরফ থেকে জানানো হয় যে কিছু অবৈধ ওয়াকিটকি দেশে আমদানী করার জন্য স্যু কি-কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এক বছরের জন্য এই জরুরি অবস্থা জারী রেখে দেশের শাসনব্যবস্থা তারা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে কারণ স্যু কি-রা নাকি নির্বাচনী কারচুপি করে সরকার গঠনের চেষ্টা করেছে। জনগণের তরফ থেকে শুরু হয় গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের মত মায়ানমার (বার্মা) ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান মায়ানমার কব্জা করে। পরবর্তীতে স্থানীয় সেনার একাংশ ব্রিটিশ ও মার্কিন মদতে মায়ানমার পুনরুদ্ধার করে। এই স্থানীয় সেনার নেতৃত্ব দেন অং স্যান। মায়ানমারের ১৩৫টি জাতিকে রাজনৈতিকভাবে একত্র করে তিনি একটা ফেডারেল দেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ স্বাধীনতা লাভের আগেই তাঁকে খুন করা হয়। ১৯৪৮-১৯৬২ অব্দি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও ফেডারেল দেশ গঠনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হয়। সেই সময় মায়ানমারের বিভিন্ন জাতির নিজস্ব সেনা সংগঠন থাকায় দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, মায়ানমারের প্রথম সামরিক ক্যু সেই সময় বাস্তবায়িত হয়। ব্যাক্তি সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়, বিদেশীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং অন্য দেশের সঙ্গে সেনা কর্তারা যোগাযোগ ছিন্ন করে। দেশে তিনবার বিমুদ্রাকরণের চেষ্টা চলে; দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ে।
১৯৮৮ সালে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ শুরু হয় যাকে ৮-৮-৮৮ আন্দোলনও বলা হয়ে থাকে। সেই সময় প্রচুর বিরোধী ছাত্রনেতা খুন হন। স্যু কি সেই ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় এবং 'ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রাসি' নামক নতুন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক চাপে সামরিক নেতারা সীমিত গণতন্ত্র পুনর্বহাল করার পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। ২০১৫তে প্রথম বার ভোটে জয়ী হয়ে স্যু কি সরকার গঠন করে। কিন্তু সামরিক কর্তাদের আইনী কারচুপির কারণে সন্তানদের বিদেশী নাগরিকত্ব থাকার দরুণ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রধান পদে স্যু কি ক্ষমতাসীন হতে ব্যর্থ হয়, যদিও সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও সরকার কার্যত স্যু কিই চালাচ্ছিল। এরপর থেকেই গণতন্ত্রের আইকন স্যু কি-র উলটপুরাণ শুরু। সেনা কর্তাদের সাথে দৃষ্টিকটু সমঝোতা, রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা ও দেশ থেকে বিতাড়নের দাঙ্গায় মদত এবং মার্কিন ব্যবসায়ী স্বার্থ রক্ষা করার অভিযোগ উঠতে থাকতে থাকে তার উপর।
এই জনঅসন্তোষের প্রেক্ষাপটেই আজকের সামরিক অভ্যুত্থান। সেনা কর্তারা চীনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর কারণ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী করতে উদ্যত। অন্যদিকে, চীন রাষ্ট্রপুঞ্জে মায়ানমারের সেনার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাশ না হতে দিয়ে এবং সরকারী বিবৃতিতে এই অভ্যুত্থানকে কেবল ক্ষমতার রদবদলের আখ্যা দিয়ে ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের ক্ষমতা বিস্তারের স্বার্থে 'নেপোয় মারে দই'-য়ের ভূমিকা পালন করছে। ভারত সরকারও গণতন্ত্র হত্যা নিয়ে মিউ মিউ করলেও সরকারী বিবৃতিতে মায়ানমারের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন অক্ষুণ্ণ রাখার আর্জি জানিয়ে জনগণের অধিকারের লড়াই থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ৮০-এর দশকের ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের আজকের লড়াইয়ের প্রধান মুখ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই লড়াই সফল হতে গেলে দরকার বিকল্প অর্থনৈতিক দিশা সম্পন্ন বামপন্থী আন্দোলনের উন্মেষ এবং শ্রমিক কৃষকদের সংগ্রামী ঐক্য।
Comments
Post a Comment