অধ্যাপক ডি এন ঝাঁ স্মরণে

সুমিত গাঙ্গুলি 

স্বাধীনতা উত্তর ভারতের মার্কসীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যে সমস্ত ইতিহাসবিদেরা ফ্যাসিবাদী ইতিহাস বিকৃতি ও ইতিহাসের গেরুয়াকরণের বিরুদ্ধে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝাঁ। মূলতঃ ডঃ ঝাঁ ও সহযোগী ইতিহাসবিদদের লড়াই; শত প্রচেষ্টার পরেও ইতিহাস নির্মাণে ততটা বিকৃতি ঘটাতে দেয়নি যতটা ভারতের শাসক শ্রেণি ঘটাতে বদ্ধ-পরিকর ছিল।



ফ্যাসিবাদ আসলে একটি দক্ষিনপন্থী গণ-আন্দোলন ও গণ-উন্মাদনা; যার ভিত্তিভূমি সৃষ্টির জন্য সর্বাগ্রে দরকার পরে ইতিহাসের বিকৃতি; যা ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা ও সাধারণ শত্রু সৃষ্টি করে সমাজের সর্বহারা শ্রেণির একাংশ ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির একাংশকে সবসময় একটি জ্বলন্ত সাধারণ ইস্যু হাতে ধরিয়ে দিয়ে সবসময় উত্তেজিত রাখে। এরই বিরুদ্ধে মূলতঃ লড়াই চালিয়েছিলেন ভারতের তাবৎ বামপন্থী ইতিহাসবিদেরা। ডি এন ঝাঁ ছিলেন তাদের পুরোধা। 

বহুত্ববাদ ও যুক্তিবাদের নির্ভীক প্রবক্তা প্রফেসর ঝাঁ জন্মেছিলেন ১৯৪০ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি এ পাস করে তিনি এম এ পড়তে ভর্তি হন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তখন অধ্যাপক ছিলেন ভারতের মার্কসীয় ইতিহাসচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ রামশরণ শর্মা। তাঁর দ্বারাই প্রভাবিত হন অধ্যাপক ঝাঁ।

মূলতঃ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাসচর্চায় বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ঝাঁ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে সর্বদাই খড়গহস্ত অধ্যাপক ঝাঁ-এর মূল কাজ ছিল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের আলোচনা; প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ক তৈরী করে কিভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে তা তুলে ধরা। প্রাচীন ভারতের অর্থনীতি ও সমাজের ক্ষেত্রে কর ব্যবস্থা কি ছাপ ফেলেছিল তাও তিনি দেখাতে চান। একদিকে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ইতিহাস রচনা অপর দিকে যুদ্ধ, রাজবংশ ও লোককথা দ্বারা ইতিহাস নির্মাণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঝাঁ হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তিনি এও মনে করতেন যে ভারতের জাতি গঠনের সঙ্গে পেশাদার ইতিহাসের রচনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

১৯৯১ সালে রামশরণ শর্মা, সূরজ ভান ও আতাহার আলীর সঙ্গে মিলে বাবরি মসজিদ ভাঙার তীব্র প্রতিবাদ করে কলম ধরেন ও দাবী করেন সেখানে কোনও মন্দির ছিল না যেটি 'Ramjamabhoomi -Babri Masjid: A Historians Report to the Nation (1991)'  নামে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এটিকে সুপ্রিম কোর্ট 'মতামত মাত্র' বলে আখ্যা দিয়ে খারিজ করেছে।

২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত গ্রন্থ 'The Myth of the Holy Cow', যেখানে তিনি ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রাচীন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি তুলে দেখান যে প্রাচীন ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে 'গরু' ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান-  'আমার বই The Myth of the Holy Cow-তে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি, গো-মাংস ভক্ষণ ইসলামের "দূর্ভাগ্যজনক অবদান" নয়, বরং বৈদিক যুগে এটা সাধারণ আচার ছিল। দেবতার কাছে বলিদান থেকে শুরু করে এর বহু প্রমাণ রয়েছে। এগুলো বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগের লেখা থেকে পাওয়া যায়। ঋক বেদের এক জায়গায় (X.86.14), বৈদিক দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্র এমন বলছেন বলে বর্ণনা আছ, "তারা আমার জন্য পনেরো এবং কুড়িটি ষাঁড় রান্না করেছে"। অন্য জায়গায় উল্লেখ আছে তিনি ষাঁড়ের মাংস খাচ্ছেন (X.28.3), একটি (X27.2), একশটি মহিষ (VI.17.11), তিনশটি মহিষ (V.29.7), বা সহস্রটি মহিষ (VIII.12.8)। অগ্নির জন্যও গবাদি পশু বলি দেওয়া হতো, ঋক বেদে যার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে "ষাঁড় আর বন্ধ্যা গাভী যার খাদ্য" (VIII.43.11)। বেদের পরবর্তী যুগের লেখাতেও এমন বহু উদাহরণ আছে আর তার একটি হল, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ (III.9.8), তাতে সংশয়হীন ভাবে দেখানো আছে উৎসর্গ করা গাভী মূলত খাদ্য। বিভিন্ন লেখায়, বিশেষ করে গোপথ ব্রাহ্মণে (I.3.18) দেখানো হয়েছে উৎসর্গীকৃত জীবটি মূলত মানুষের খাদ্য। মৃত পশুর মাংসকে ছত্রিশ ভাগ করার কথা বলা হয়েছে'। 

সাধারণ ঘরোয়া প্রয়োজনেও গবাদি পশু হত্যা করা হত। একটা ঋক বৈদিক স্তোত্রে (X.85.13) পাওয়া যায় বিবাহের অনুষ্ঠানে গো-হত্যা করা হত। পরবর্তীতে ঐতিরীয় ব্রাহ্মণে (III.4) বলা হয়েছে রাজা বা সম্মানীয় কোন অতিথি বাড়িতে এলে মানুষ গো হত্যা করে।

গুরুত্বপূর্ণ অতিথীকে আপ্যায়ন করার অনুষ্ঠানে (মধুপর্ক) গো-হত্যা করা হত। এটা বৈদিক এবং পরবর্তী যুগের লেখায় বারবার এসেছে। আক্ষরিক অর্থে "মধুপর্ক"-এর উল্লেখ প্রাচীন ভারতের অনেক উত্তরকাল অবধি পাওয়া যায়। গবাদি হত্যা মৃতদের অর্চনার সাথেও গভীর ভাবে যুক্ত ছিল। শ্রদ্ধার সন্তুষ্টির মাত্রা নির্ভর করত কি পশু উৎসর্গ করা হয়েছে তার উপর। অপাষ্ঠম্ভ ধর্ম-সূত্র বলে কিভাবে গোমাংস পিতৃ পুরুষদের (মৃত পূর্ব পুরুষদের) এক বছরের জন্য সন্তুষ্টি বিধান করে। ফলে, সন্দেহাতীতভাবেই বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগে গোহত্যা আর গো-মাংস ভক্ষণ অতি সাধারণ বিষয় ছিল (http://anaryamonon.blogspot.com/2017/)।

তিনি গুপ্ত যুগকে 'স্বর্ণ-যুগ' বলার বিরোধিতা করেন, প্রাচীন যুগকে সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ব্যাখ্যা করেন, কারণ মনে রাখতে হবে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক কাঠামোর সূত্রপাত আসলে গুপ্ত যুগ থেকে হয়েছিল। 

সম্প্রতি গত বছর প্রাচীন ভারতের মদ্যপান বিষয়ে সর্বশেষ গ্রন্থে তিনি দেখান যে বেদ, উপনিষদ, পুরান, রামায়ণ, মহাভারতের মধ্যে থেকেই প্রায় ৫০ রকমের মদের সন্ধান পাওয়া যায়, যা পুরুষ ও মহিলা উভয়ই পান করতেন। গ্রন্থটির নাম হলো ‘Drink of the Immortality’. 

৯টি স্বরচিত ও ৩টি সম্পাদিত গ্রন্থের ও, অজস্র প্রবন্ধের লেখক, ভারতীয় মার্কসীয় ইতিহাসচর্চার অগ্রগ্রামী ও আপোষহীন ইতিহাসবিদ ২০২১ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, রেখে গেছেন অজস্র রচনা, যা ইতিহাসের ফ্যাসিবাদী বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রসদ।

Picture Courtesy: Madhyamam

 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার