ইকুয়াডরের নির্বাচন থেকে বাংলা কি শিক্ষা নেবে?

অনন্যা দেব

দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে সাধারণ নির্বাচন চলছে। দু'পর্যায়ের নির্বাচনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন সমাপ্ত। দ্বিতীয় পর্যায় ১১ই এপ্রিল এবং ফল ঘোষণা ২৪শে মে। বামপন্থী নেতা আন্দ্রে আরাউস-এর বিরুদ্ধে তথাকথিত বামপন্থী প্রার্থী ইয়াকু পেরেস বিরোধিতা শুরু করেছে। অশান্তির সূত্রপাত এখান থেকেই। 


দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলির মতন ইকুয়েডর প্রদেশটিরও বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে যে কারণে বামপন্থী নেতা রাফায়েল কোরিয়া প্রেসিডেন্ট পদে দীর্ঘদিন ক্ষমতাধীন ছিলেন। রাফায়েল কোরিয়ার মতাদর্শ অনেকটা ভেনেজুয়েলার হুগো সাভেজ, বলিভিয়ার ইভো মরালেস এবং নিকারাগুয়ার স্যান্ডিনিষ্টা আন্দোলনের মতাদর্শের কাছাকাছি। একই সাথে কিউবার বিপ্লবী সরকারের সাথে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ সংযোগ রাখতেন। ২০১৪ সাল নাগাদ যখন তেলের দাম পড়ছিল, তখন তিনি উচ্চবিত্তদের উপর ট্যাক্সবৃদ্ধি সহ বংশানুক্রমিক সম্পত্তি বৃদ্ধি করা অংশের উপরও ট্যাক্স বৃদ্ধি করেন এবং গরিবদের উপর ট্যাক্স কমিয়ে দেন। তাঁর সময়কালে জনগণের জন্য সরকারি বরাদ্দ অর্থ বৃদ্ধি পায়, দূর্নীতি অনেকখানি কমে আসে। ওদে ব্রেকথ নামক ব্রাজিলীয় কোম্পানি ইকুয়েডরে এসে টাকা ঘুষ দিয়ে ব্যবসা করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান রাফায়েল কোরিয়া। উইকিলিকস সংস্থার কর্ণধার জুলিয়ান অস্যাঞ্জ-এর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খানা তল্লাশি শুরু করলে রাফায়েল কোরিয়া  জুলিয়ানকে লন্ডনের ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় প্রদান করেন। একইসাথে এডোয়ার্ড স্নোডেন কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ-র সমস্ত গোপন নথি ফাঁস করে দেওয়ার পর রাফায়েল তাকেও রক্ষা করেন। স্পষ্টতই,  রাফায়েল কোরিয়ার বাম মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাঁর সরকারকে পূর্ণরূপে বিপ্লবী সরকার বলা না গেলেও লেফট সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বলা চলে। রাফায়েল কোরিয়ার পার্টির নাম ছিল পাইস (প্রাউড অ্যান্ড সভারিন হোমল্যান্ড) বা প্যারেন্টস অ্যালায়েন্স। পার্টির ভেতরেই লেনিন মরেনো নামক একজন নেতা রাফায়েল কোরিয়ার বিরোধিতা শুরু করেন এবং তাকে মডারেট লেফট বা মধ্য বাম বলতে শুরু করেন। এর ফলে নিজের দলেই রাফায়েল কোরিয়া কোণঠাসা হতে থাকেন এবং লেনিন মরেনো নেতা হয়ে উঠতে শুরু করেন। পরবর্তী নির্বাচনে লেনিন মরেনো পার্টির তরফ থেকে দাঁড়ান এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন। মোরেনো নিজেকে বামপন্থী হিসেবে তুলে ধরলেও  ক্ষমতায় এসেই তিনি দক্ষিনপন্থায় পাল্টি খান। নয়াউদারবাদী অর্থনীতির প্রণয়ন করতে শুরু করেন, সরকারি বরাদ্দ কমাতে শুরু করেন, উচ্চবিত্ত এবং বড় কোম্পানির উপর থেকে ট্যাক্স কমিয়ে দেন, সাধারণ জনগনের উপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়ে দেন। ইকুয়েডরভুক্ত অ্যামাজন জঙ্গলের অংশটিতে নির্বিচারে তৈল নিষ্কাশন পদ্ধতি চালু করতে শুরু করেন। পাশাপাশি শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী আইনগুলিকে শিথিল করে দেন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের বড় বড় পদে আসীন হন। ইন্টারন্যাশানাল মনিটারি ফান্ডের থেকে অর্থসাহায্য লাভ করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে আলোচনা করে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে মার্কিন পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেন। ভেনেজুয়েলাতে বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাঠপুতলি জুয়েইন গুয়াইডোকে সমর্থন করতে শুরু করেন। এই লেনিন মরেনোর সরকার প্রচন্ড দুর্নীতিগ্রস্থ এবং ডানপন্থী। তিনি ন্যাশনাল ইলেক্টোরাল কাউন্সিলে নিজের দলের লোকজনকে বসিয়ে দেন। এর ফলে পাইস আন্দোলন থেকে রাফায়েল কোরিয়ার অনুগামীরা বেরিয়ে যান এবং নিজেদের আলাদা দল স্থাপন করেন যা সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট নামে পরিচিত। সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট পার্টির তরফ থেকে আন্দ্রে আরাউসকে ভোটে দাঁড় করানো হয় এবং বিপুল পরিমাণে ভোট পেয়ে তিনি প্রথম রাউন্ডে জেতেন।

ঠিক যেমন লেনিন মরেনো বামপন্থী সেজে পরবর্তীতে ডানপন্থী হয়ে ওঠেন, তেমনি আরেকজন বাম ভেকধারী ডানপন্থী ইয়াকু পেরেস তার পার্টি প্যাচাকুটিক-এর পক্ষ থেকে নিজেকে বামপন্থী বলে ঘোষণা করতে শুরু করে।কিন্তু যখনই সে বুঝতে পারে যে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইলেকশনে সে হেরে যেতে চলেছে, তখন লেনিন মরেনো সরকারকে সমর্থন করতে শুরু করে এবং সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে সওয়াল করে। এটাকে ঢাল করেই সে চলমান নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে বানচাল করে দিতে উদ্ধত হয়েছে। তার অভিযোগ, ব্যাপক পরিমাণ রিগিং-এর ফলে আন্দ্রে আরাউস জিতছেন। তার মতে আন্দ্রে আরাউস জনবিরোধী নেতা কারণ তিনি কলম্বিয়ার বামপন্থী গেরিলা পার্টি ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েছেন। এখান থেকেই ইয়াকু পেরেসের ডানপন্থী মতাদর্শগুলি প্রকট হতে শুরু করে। দক্ষিণ আমেরিকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক অভ্যুত্থানগুলি ঘটায় বামপন্থী সরকারগুলিকে ফেলে দেবার উদ্দেশ্যে, যা ভেনেজুয়েলাতে, কিউবাতে, ব্রাজিলে বিভিন্ন সময় চেষ্টা করা হয়েছিল, সেগুলিকে ইয়াকু পেরেস সমর্থন করে। কিছুদিন আগেই কলম্বিয়াতে ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম ক্ষমতায় ফিরেছে, সেখানকার অভ্যুত্থানমুখী দক্ষিণপন্থী সরকারকে নির্বাচনে পরাস্ত করে। তাঁরা নিজেদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন উপজাতির নেতাদের ডেকে পাঠান। ইয়াকু পেরেস  একজন উপজাতি নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে ডাকা হয়নি তার ডান ভাবাদর্শের জন্য এবং পক্ষান্তরে বলিভিয়াতে মার্কিন মদতে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে সওয়াল করার জন্য। লেনিন মরেনো যখন  গ্যালাপাগোস দ্বীপপুনঞ্জে ইউএস-এর একটি সামরিক ঘাঁটির পক্ষে কথা বলেছেন, তখনও ইয়াকু পেরেস তাকে সমর্থন করেছে। জল জঙ্গল জমি সাফ করার বিপক্ষে গিয়ে রাফায়েল কোরিয়া যে গরীবদের হয়ে অর্থ ব্যয় করতেন তাকে সে ব্যঙ্গ করে বলেছে, "গরীবদের বেশি অর্থ প্রদান করা হলে তারা আট ঘন্টা মদ খেয়ে ব্যয় করবে"। এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ জাতি বিদ্বেষমূলক কথা সে বলেছিল। সে বামপন্থীদেরও জাত্যভিমানী বলে উল্লেখ করে এবং বলে বামপন্থীরা উপজাতি নেতৃত্বভুক্ত নন এবং বামপন্থীরা উপজাতি নেতাদের জায়গা প্রদান করে না। এর মাধ্যমে উপজাতি নেতাদের মধ্যে বামপন্থী ঐক্যকে সে চির ধরানোর চেষ্টা করে।

আমাদের দেশে বহু বামপন্থী শব্দ ব্যবহারকারী বা কমিউনিস্ট নামধারী পার্টি রয়েছে, তারা বারংবার বামপন্থাকে সামনে রেখেই ইলেকশন বৈতরণী পার করার চেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে। যখন তারা জিতেছে, তখন অনেক সময়েই ডানপন্থী অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে হেঁটেছে। এখনকার ফ্যাসিবাদী উত্থানের পরিস্থিতিতে তারা ভোটে সুবিধা করে উঠতে পারছে না, কিন্তু তারা ক্ষমতায় এলে নয়াউদারবাদী অর্থনীতিই যে প্রণয়ন করবে তা তাদের স্লোগান এবং ইস্তেহার থেকেই স্পষ্ট। যারা ক্ষমতায় এখনো আসেনি এবং নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে, তাদের অনেকেই এখনো কল-কারখানা তৈরীর নামে দক্ষিণপন্থী অ্যাজেন্ডাকে তুলে ধরতে চাইছে; দক্ষিণপন্থীদের সাহায্য করার মতন রণকৌশল নিচ্ছে। ইকুয়েডরের কাহিনী অর্থাৎ লেনিন মরেনো বা ইয়াকু পেরেস-এর মতন মুখোশ পড়া নেতৃত্বদের থেকে শেখা উচিৎ, এরা আদৌ বামপন্থী নয় কিন্তু বামপন্থার কথা বলেই তারা ক্ষমতা দখল করে। আমাদের নিজেদের দেশের কিছু এইরকম বাম ভেকধারী ডানপন্থী চাটুকারদেরকে ভালো করে চিনে নেওয়া দরকার এবং আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাসীবাদকে রুখতে ঘোষিত ইস্তেহারের ভিত্তিতে বাম প্রার্থীদের অ্যাজেন্ডা বুঝে নেওয়া উচিৎ।


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!