কোভিড, আম্ফান এবং দেশের জুটমিলের শ্রমিকদের পরিস্থিতি

সায়ন নন্দী 


বিশ্ব অর্থনীতি যখন উদারবাদের জাঁতাকলে আটকে, মহামারী এবং আম্ফানের সময়ে খেটে খাওয়া মানুষ যখন খেটে খাওয়ার কূল কিনারা পাচ্ছে না, সে সময় শ্রমিকদের উপর অত্যাচার নতুন মাত্রা নিয়েছিল দেশের জুটমিলগুলিতে। লকডাউন কঠোর ভাবে জারি থাকার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে জুটমিলগুলিতে সীমিত উৎপাদন চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার তা মেনে নিয়ে দ্বিতীয় দফা লকডাউন চলাকালীনই তা শুরু করে দেয়। আম্ফানের পর রাজ্য সরকারের নির্দেশে পূর্ণ উৎপাদন চালু হয়। মন্দার বাজারেও শিল্পক্ষেত্রগুলির মধ্যে জুটশিল্পকে কেন্দ্র করে সিআইআই দ্বারা আয়োজিত একটি অনলাইন সভাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে জুটমিলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। আনলক চলাকালীনই বিপুল পরিমাণে চটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হতে থাকে। সেদিক থেকে দেখলে, প্রচুর মুনাফার আশায় জুটমিলগুলিও উৎপাদন বৃদ্ধি শুরু করে। রিলায়েন্স সহ বহুজাতিক কোম্পানীগুলি বাজারে চটের বস্তার চাহিদার বৃদ্ধি ঘটালে, জুটমিলগুলিতে কাজের সময় এবং চাপ দুই-ই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার সাথে বাড়তে থাকে শ্রমিকদের ওপর শোষণ-পীড়ন। বেশকিছু জুটমিল মালিকরা লকডাউন চলাকালীনই বুঝে গেছিল যে লকডাউন পরর্বতী সময় বিশাল পরিমাণ মুনাফা হতে চলেছে। তখন লকডাউন পরর্বতী সময়ে যাতে শ্রমিকদের হাজিরার অঙ্কটা প্রতিদিনে উন্নীত করা যায়, তারা শ্রমিকদের উপর অ্যাডভ্যান্স কেটে নেওয়ার উৎপীড়ন শুরু করে। অতএব কাজ চালু হলে, পনেরো দিনের অ্যাডভ্যান্স মজুরী থেকে কাটা শুরু হয়। এতে করে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী কমে যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যাডভ্যান্সের টাকা শোধ দেওয়ার তাগিদে শ্রমিকেরা কাজের চাপ বেড়ে গেলেও ছুটি নেওয়ার কথা ভাবতে পারেনা। জুটমিলে দু'ধরনের শ্রমিক কাজ করে থাকে, নিয়মিত এবং অনিয়মিত। নিয়মিত শ্রমিকেরা মালিকের খাতায় রেজিস্টার্ড এবং অনিয়মিত শ্রমিকরা ভাউচার সিস্টেমে মজুরী পেয়ে থাকে। নিয়মিত শ্রমিকরা অ্যাডভ্যান্স কাটানোর তাগিদে প্রত্যহ কাজে আসতে বাধ্য হয়, কিন্তু জুটমালিকরা শ্রমিক ইউনিয়নের দালাল চক্রের মাধ্যমে কোনো নিয়মিত শ্রমিককে ৪ দিনের বেশী কাজ দেয়না। এতে করে শ্রমিকরা অ্যাডভ্যান্সের দায়ও ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনা। ওদিকে সপ্তাহে ৪দিন নিয়মিত শ্রমিক কাজ পেলেও, সপ্তাহে দুদিন কাজ পায় অনিয়মিত বা ভাউচার শ্রমিকরা। তাদের নাম জুটমিলের খাতায় নেই এবং পিএফ, ইএসআইও নেই। তাদের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জুটমালিকদের কোনো দায়ভার নেয় না। এতে করে কম মজুরীতে শ্রমদিবস পালন এবং উৎপাদন করে চলেছে শ্রমিকরা। লকডাউন পরর্বতী সময় অন্যত্র কর্মসংস্থানের জায়গা কমে আসলেও জুটমিলের মালিকেরা এই পরিস্থিতিকে উপর্যুপরি হিসেবে ব্যবহার করছে। নিয়মিত শ্রমিকের মজুরী যেখানে ৫০০ থেকে ৫৪০টাকা, সেখানে ভাউচার শ্রমিক অনেক কম মজুরীতে উৎপাদন নিয়মিত রেখে মুনাফার পাহাড় গড়ে দিচ্ছে মালিককে। উৎপাদনের ঘাটতির কথা বলে নিয়মিত শ্রমিককে বসিয়ে, ভাউচার শ্রমিককে দিয়ে খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একজন নিয়মিত শ্রমিক যেখানে সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারে ২৫ ইউনিট সেখানে তার উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে টিফিন আওয়ারস কমিয়ে দিয়ে, ওয়াশরুমে না যেতে দিয়ে, তাকে দিয়ে সেই ২৫ ইউনিটের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে ২৮ থেকে ৩০ ইউনিট উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আগের চাইতে কম উৎপাদন হলেই তার উপর নেমে আসবে সাসপেন্ড হওয়ার খাঁড়া। তাছাড়াও ইন্টার্নশিপ করতে আসা ইন্টার্নদের দিয়ে ট্রেনিং-এর নামে অল্প কয়েকদিন নির্দিষ্ট বিভাগে কাজ করিয়ে, তারপরেই তাদের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। ৬ মাস বা ১ বছর শেষে সেই ইন্টার্নদের মধ্যে থেকে হয়তো ১ কিংবা ২ জন শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হয়। কিন্তু সমগ্র ইন্টার্নশিপের সময় ইন্টার্নদের দিয়ে সমপরিমাণ কাজ করিয়ে মুনাফা লোটে জুট মালিকেরা। লকডাউন পরর্বতী সময়তে কন্ট্রাকচুয়ালভাবে মিলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে মোটা টাকার বিনিময়ে মিলগুলি তাদের মেশিন সরবরাহ করছে এবং এতে করে একটি সংগঠিত জায়গা থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলির শ্রমিকের সাথে হিসেব সেই সমস্ত অসংগঠিত সংস্থার মালিকরা বুঝে নিচ্ছে, এতে করে শ্রমিকের দায়ও মিল ঝেড়ে ফেলছে কাঁধ থেকে এবং তার সাথে শুরু হচ্ছে ছাঁটাই।

এ সম্পর্কে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার অবগত হলেও চুপ এবং দালাল ইউনিয়নগুলিও মুখে কুলুপ এঁটেছে। শ্রমিকদের নিজেদের সংগঠন তৈরি করে আপোষহীন আন্দোলনের পথে যেতে হবে।  

তথ্যসূত্রঃ আজাদ গণমোর্চার মুখপত্র 'মাতৃভূমি'

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার