খাদ্য পুষ্টি স্বাদ সংস্কার

 বিমলকান্তি দাশগুপ্ত 

খাদ্যগ্রহণ, প্রাণের স্বাভাবিক ক্রিয়া। এর জন্য কারো অনুমতি বা অনুমোদন দরকার হ্য় না। জীবনচক্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খাদ্য গ্রহণ বা খাওয়া ক্রিয়া। আমরা মানুষেরা যেমন খাই, পশুরাও খায়। কীট পতঙ্গ এরাও খায়। এমন কি উদ্ভিদ, যাকে কিছু বছর আগেও জড়বস্তু  বলে ধারণা করা হত, দেখা গেছে তারাও খায়। খাদ্য গ্রহণ করে। আর তাতেইনা মুক্তি ঘটল গাছের জড়জীবনের বন্দীদশা থেকে। বিশ্বভরাপ্রাণের রাজ্যে তার স্থান হল। এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তার আসন আজ প্রতিষ্ঠিত। এখন বুঝেছি আমরা, মানুষেরা, প্রাণের আদি উৎস তো উদ্ভিদই। 


বাঁচার জন্য খাওয়া, না কি খাওয়ার জন্য বাঁচা। কোনটা ঠিক। খাই বলেই বেঁচে আছি। এ তত্ত্ব সকলের জানা। কিন্তু কেমন করে। খাদ্য আর বেঁচে থাকবার মধ্যে সম্পর্কটা কী। খাদ্য আমাদের কী দেয়। যার কারণে আমরা বেঁচে থাকি। দেয় পুষ্টি বা শক্তি। সে জন্য খাই আর খাই বলেই বেঁচে আছি। আর কিছু কি। খাবারে থাকে প্রোটিন ফ্যাট মিনারেল(লবন) ভিটামিন, প্রধাণত। এ ছাড়া আরও অনেক কিছু থাকে। যা না জানলে খাওয়ায় খুব একটা বাধা হয় না। প্রধান উপাদানগুলো শরীর গঠনে সাহায্য করে। শক্তি বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ করে। এটুকু জানলেই যথেষ্ট চলে যায়। ইস্কুলে স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান নাপড়ামানুষের মুখের ছড়া থেকে খাদ্য বিষয়ে তাদের ধারণার উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘মাংসে মাংস বাড়ে। শাকে বাড়ে মল। দুধে রক্ত বাড়ে। ঘি খেলে বাড়ে বল।’ অথবা ছেলেকে খাওয়াতে বসে মায়ের মুখে এ-ও শুনতে পাবেন হয়তো, ‘ঘাসে বলদ, আর ভাতে মরদ’। এর পর খাওয়া নিয়ে আর কী বলবার থাকে। 

প্রাণী হিসাবে দেহখানা তো আপনি পাওয়া। নিজের উপার্জিত নয়। সে-ও একদিন আপনি বিদায় হবে। কোনো চেষ্টাতেই রোখা যাবে না। তা হলে মানুষ হিসেবে এই দেহের কাজ কী। কোনো রকমের ভাবনা ছাড়াই প্রাণীদেহের জন্য দুটো নির্দিষ্ট কাজ আছে। সে কাজ, অন্যের প্রাণের বিনিময়ে নিজে বাঁচো। নিজে মরে অপরকে বাঁচিয়ে রাখো। এক কথায় খাও আবার খাদ্য হও। অনেকটা দান ফিরতি খেলার মতো।

এ তো হল প্রকৃতির নিয়ম। মানুষ এনিয়মের ব্যতিক্রম। কোথায়, -- যেখানে মানুষ নিজে ভাবতে পারে। আবার অপর মানুষকেও ভাবাতে পারে। কোন খাদ্য দেহের কোন অংশকে কী ভাবে প্রভাবিত করে এই তত্ত্ব জানার পর নিজের প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে খাদ্য নির্বাচন করতে শিখেছে। মল্লবীর আর টোলের পন্ডিতের আহার নির্বাচনে বস্তু আর পরিমাণ একই হয় না।

সভ্যতার এপর্যন্ত পৌঁছতে যা সময় লেগেছে, তত দিনে সমাজে শ্রেণিবিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। গুরু আর চেলার আহার নির্বাচনে বস্তু আর পরিমাণ, উভয় ক্ষেত্রেই দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। অতএব নিজের কাজের উপযোগী হবে, পুষ্টির জন্য তেমন খাদ্য বাছাই করতে হবে। অন্তরের বাসনা, যন্ত্রটা(দেহ) দিয়ে যত বেশি দিন ধরে যত বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। অর্থাৎ, অনেক দিন বেঁচে থাকবার আকাঙ্ক্ষা। মন, কর্তা। দেহ, আজ্ঞাবহ।

খাবারে স্বাদের অনুভূতি। মানুষ প্রথম যেদিন আগুনে ঝালসানো খাবারের স্বাদ গ্রহণ করল। আদ্দিকালের সেই প্রথম অনুভব, খাদ্য শুধু পেট ভরায় না। একটা অন্য রকমের আনন্দও দেয়। সুখের সেই অনুভূতি আজ এত কাল পরেও টিকে আছে। তাই-না পোড়া আর ভর্তার কদর সকল খাদ্যের শীর্ষে আজও উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করছে, দুনিয়ার তামাম খাদ্যতালিকায়। আগুনের পরশেপবিত্রকরা খাদ্যের অপরাপর গুণ মানুষের বোধের আয়তনকে সমৃদ্ধ করেছে। অনেক পরে হলেও মানুষের গোচরে এসেছে। বুঝতে শিখিয়েছে, দেহযন্ত্রের বিপাক ক্রিয়ায় এর প্রভাবের কথা। যা কি না মনের গহীনেও কাজ করে যায় চুপে চুপে।

এর পরেই যা ঘটল, খাবারে লবনের ব্যবহার। আবারও এক নতুনতর স্বাদের সংযোজন। ঘটেছিল আচম্বিতেই। সেই যে এলো, আজও তাকে ছাড়ানো গেল না। পাতে নুন। সল্ট টু টেস্ট। বাগধারায় সমাজের রুচিবোধের সংস্কৃতিতে নিজের জায়গা করে নিল। নুন খেলে গুণ গাইতে হয়। অথবা নিমক হারাম, মর্যাদা পায় না সমাজে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে গেল’। বাঙালি এই শব্দবন্ধ দিয়ে অনিচ্ছা আর দারিদ্র্য দুই-ই বোঝাতে ব্যবহার করে। আবার অন্য দিকে লবনজ্ঞান না থাকা বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ বলেই বিবেচিত হয়, বাঙালির সমাজে। আমার ভারতে জাতীয় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল লবন আইন ভাঙা দিয়ে। আবার অন্যদিকে ঘাম আর রক্তের স্বাদ যে লবনাক্ত, এ কথা শ্রমজীবীদের মতো করে আর কে বা বুঝতে পারে।        

আধুনিক রসায়নবিদগণ মানুষের দেহে লবনের পরিমাণ এবং তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিষয়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। সেই মতো চিকিৎসকদের বিধান লবনকে এক গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কারণ এই লবন ক্ষমতা রাখে দেহযন্ত্রের অভ্যন্তরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অদল বদল ঘটিয়ে দেবার। শুধুমাত্র স্বাদের সীমা ছাড়িয়ে সে অনেক পথ চলে এসেছে।

এদিকে খাবারে বাড়তি স্বাদ পাওয়া মানুষ আরও স্বাদের সন্ধানে বা নেশায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নতুন নতুন স্বাদু দ্রব্যের সন্ধান করতে থাকল। পেয়েও গেল। নানা রকমের মশলাপাতি। তাই নিয়ে এক সময় বাণিজ্যে নেমে পড়ল। পাড়ি জমাল ভিনদেশে। মশলার ফেরি নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করে ফেলল নানান দেশের নানান জাতের মানুষ। খাবারের সুবাস আর সুস্বাদ মানুষকে জোটবদ্ধ করল খাবারের থালিতে।

মানুষের দেহ মন আর স্বভাবে বদল ঘটিয়ে সে যুগ গত হয়েছে। সে কি আজকের কথা। দ্রুতগতির আধুনিকযুগ ব্রাত্য করে দিয়েছে তাকে। সে কালের সেই সুগন্ধী আহারের ম ম করা শ্লথগতির পরিবেশকে।

বর্তমানে চটজলদি আহারের পসরা নিয়ে অতিগতির আধুনিকযুগ তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে অতিআধুনিক প্রজন্মকে। চলতে চলতে খাও। নয় তো খেতে খেতে চল। এসেছে প্যাকেটে মোড়া নতুন যুগের উপযোগী নতুন স্বাদে ভরা নানা ধরণের খাদ্যসামগ্রী। ছুটছে মানুষ নবতর স্বাদের সন্ধানে। নব নব ঠিকানায়। ফুডকোর্ট রেস্তোরা হোটেল ধাবা এমনই সব খাবারের ঠিকানায়।

দেহের গঠনে তার প্রতিফলন আর গোপন থাকছে না। মনের পরিবর্তন প্রকাশ পায় আচরণে। তবে স্বাদের বিষয়ে এই বলেই শেষ করছি, সকল স্বাদের সেরা স্বাদ মায়ের হাতে তৈরি খাবারে। ওই খাবারের স্বাদ নিয়ে যে রুচিবোধের সূচনা, সে সারা জীবনের সঙ্গী। স্বাদের পারিবারিক সামাজিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় কি আন্তর্জাতিক যে মান্যতাই থাক না কেন মায়ের রান্নার স্বাদ সে একান্তই ব্যক্তির নিজের সম্পদ। নিজের অহংকার।

জাগতিক একই বস্তু নিয়মিত ব্যবহার করলে দেহের সঙ্গে সেই বস্তুর একটা স্বাভাবিক সখ্য গড়ে ওঠে। মনের প্রশ্রয়ে সেটাই সংস্কার নামে ভাষায় প্রকাশ পায়। মানুষের বেঁচে থাকবার প্রাথমিক উপাদান, যেমন খাদ্য বাসস্থান আর পোশাক। এর তিনটেই প্রকৃতির স্বাভাবিক উৎপাদন। আর জলবায়ু ভেদে তিনেরই ভিন্ন ভিন্ন চেহারা, আকারে প্রকারে। আর সে কারণেই ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের খাদ্য বাসগৃহ আর পোশাকের ভিন্নতা। খাদ্য যেখানে পৃথক, তার সংস্কৃতিও আলাদা রকমের। এটাই স্বাভাবিক। 

মূল বিষয় এক থাকলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বদল ঘটে। তার এক কারণ, আদতে মানুষ পরিযায়ী। এক জায়গায় স্থির থাকবার অবস্থা বা অভ্যাস কোনোটাই নেই তার জন্মগত স্বভাবে। খাদ্যসংস্কৃতির বদল ঘটে যায় বা ঘটিয়ে নেয় সে একারণেই। শুধু এখানেই থামে না বিষয়টা। খাদ্যবস্তুর অভাব বা প্রাচুর্য, সে-ও একটা কারণ হতে পারে বা হয়ে থাকে। এখানে ধর্ম সমাজ রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা থাকে। যা মানুষকে বাধ্য করে খাদ্যাভাসের বদল ঘটাতে।

বর্তমান যুগে বিশ্বজুড়ে মানুষের চলাচল বসবাস সামাজিক মিলন দেশভেদ স্থানভেদ দূর করে মানবজাতিকে একবিশ্বের আধারে বেঁধে ফেলবার আয়োজন চলেছে। সেকারণেই খাদ্যসংস্কৃতিতেও তার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটছে। এটা স্বভাবিক। এই বদলে মানবের দেহের গঠনে এবং মননে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে আজকের দিনে, আগামী লক্ষ বছর পরের মানব প্রজাতি আজকের মানুষকে বনমানুষ বা আদিমমানব এমনই এক কোন্ নামে অভিহিত করবে কে জানে। সেই উন্নত সাম্যবাদী মানব আজকের অহংকারী মানুষকে তার পূর্বপুরুষ বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করবে না তো।


    

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার