বিরোধিতা কেবল কোনও ঘটনার নয়, বিরোধিতা পলিসির

 সুমিত ঘোষ



বিরোধিতা কেবল নিরীহ মানুষের উপর গুলি চালানোর ঘটনার নয়। ওরকম পরিস্থিতিতে রাজ্য রাজনীতি পৌঁছালোই বা কি করে? সাম্প্রতিক মমতার বিস্ফোরক উক্তি যে নন্দীগ্রামে পুলিশবাহিনী ঢোকানোর পিছনে অধিকারী পরিবারের হাত ছিল, প্রত্যয় ও স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করেছে সিপিআই(এম)-এর কর্মী সমর্থকদের মধ্যে। পার্টি কোনোদিন আত্মসমালোচনা না করে, জনমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে নিজেদের সরকার খুঁইয়েছে; দশ বছর পার হয়ে গেলেও সে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯-এর নির্বাচনগুলি বরং পার্টিকে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত করেছে। সমাজের খেটে খাওয়া এবং পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ লাল পতাকা থেকে সরে গেছে এবং তাদের জায়গা নিয়েছে নব্য উচ্চ মধ্যবিত্তদের একাংশ। সমর্থকদের পালস অনুযায়ী পার্টি তার পলিসিও পাল্টাতে পাল্টাতে গেছে। বুদ্ধবাবুর মডেলে তাই শিক্ষিত "ভালো লেখাপড়া জানা, ইংরেজি, একটু কম্পিউটার শেখা" যুবসমাজের কর্মসংস্থানের কথা উঠে এসেছে। এত বছর পরেও দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির কর্মসংস্থানের আন্দোলনে তাই শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নই মূলগতভাবে উঠে এসেছে। সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের প্রশ্নকে অ্যাড্রেস করা হয়নি আজও। ফলে, এই সংকীর্ণ কর্মসংস্থানের পরিসরে যাদের কথা উঠল না, তাদের ঠাঁই হল তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীতে, পরে বিজেপিতে। জোড়াফুল দশ বছর ক্ষমতায় থেকে সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের উদাহরণ তৈরি করেছে। বার্ষিক নিয়োগের রীতি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আর শিক্ষাক্ষেত্রের ভর্তি প্রক্রিয়া সারদাকান্ড পরবর্তী পর্যায়ে একদিকে পার্টি ফান্ড তুলে আনার আদর্শ ও বিকল্প পথ এবং অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র সমাজকে ঠেলে দেওয়ার নীল নকশায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু ঘুরে ফিরে প্রশ্নটা সেই কর্মসংস্থানের গেরোতেই আটকে... সিপিআই(এম) কর্মসংস্থানের নামেই তাদের শিল্পায়নের পলিসিতে গেড়ে বসে আছে আর তাদের পলিসি হাইজ্যাক করেই উদীয়মান ফ্যাসিস্ট শক্তি সিঙ্গুরেই কারখানা করার স্লোগান দিয়ে চলেছে। ফ্যাসিস্টরা যে অর্থনৈতিক পলিসি চুরি করল তাতে বিপ্লবী উপাদানের বদলে কর্পোরেট তোষণের গন্ধ যে রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিরোধিতা এখানেই। বিরোধিতা এই কর্মসংস্থানের নামে কর্পোরেটবাদী পলিসিরই। এই পলিসিই সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামে সাধারণ মানুষের জমি আন্দোলনের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সিপিআই(এম)-এর বিপক্ষে গ্রামাঞ্চলের মানুষের অবস্থান তৈরি হয়েছিল সেজ বা 'স্পেশাল ইকোনমিক জোন' আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে। পুঁজিবাদী সঞ্চয়নের উপর আদিম সঞ্চয়নের তত্ত্বের ট্যাগ লাগিয়ে, সেজ আইনের আড়ালে শ্রমিকের অর্জিত অধিকারগুলি খর্ব করে এবং জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কর্মমুখী ক্ষতিপূরণ দিতে অনিচ্ছুক তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার শ্রম নিবিড় শিল্পের বদলে পুঁজি নিবিড় শিল্প ডেকে আনার জন্য কর্মসংস্থানের ভুঁইফোড় স্লোগান তুলতে শুরু করে। এর ফলে আজও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্র সরকারের বিনা ক্ষতিপূরণে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা সাধারণ মানুষ লাল পতাকার প্রতি বিরূপ থেকে মমতার বর্তমান সেটিং-এর রাজনীতির ফলে মোহভঙ্গ হয়ে নব্য উদীয়মান খেটে খাওয়া মানুষের রাজনীতির খোঁজ করে চলেছে অসহায়ভাবে। অন্যদিকে, ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ পিছু ১০ জনকেও যখন পৃথিবীর প্রথম ৫০০টি কোম্পানি চাকরি দিতে পারছে না, তখন কর্মসংস্থানের নামে বিনিয়োগের ধুঁয়ো তুলে আদতে বর্তমান নয়াউদারবাদী অর্থনীতিরই পক্ষাবলম্বন করা হচ্ছে (১)। বিগত পার্টি কংগ্রেসগুলির দলিলে এই প্রশ্নে সমালোচনা  করা থাকলেও রাজ্য নেতৃত্ব তা অবজ্ঞা করার মাধ্যমে বারংবার এটাই ফুটিয়ে তুলেছে যে পার্টির আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলায় অর্থনৈতিক প্রশ্নে বড়সড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ডানপন্থার দিকে দলের এই ঝোঁক আরও প্রকট হয়েছে এ দেশে নয়াউদারবাদের আমন্ত্রণকারী কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট গড়ার তাড়নার মধ্যে দিয়ে। শিল্প করতে জমি আর জমি নিতে কৃষক খেদানোর (অধিকারী পরিবার যে পুলিশ ডেকে এনেছিল (সত্যাসত্য বিচার্য!) তা তৎকালীন রাজ্য সরকারেরই অধীন ছিল) গড্ডলিকা থেকে বেরনোর উপায় দুটিঃ ১. নতুন করে ভূমি সংস্কার এবং কর্মমুখী ক্ষতিপূরণের পদ্ধতির প্রচলন ২. নির্দিষ্ট  বিনিয়োগ পিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক চাকরি দেওয়ার আইন বলবত করা (মহাবোধি সোসাইটি হলে ১৩ই মার্চ, ২০২০-র কর্মসংস্থান বিষয়ক কনভেনশনে উত্থাপিত)। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব তাদের শিল্পায়নের লাইন থেকে না সরে নিজেদের পতনভূমি নন্দীগ্রামে যুব নেতৃত্বকে ঠেলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের সামনে পার্টির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সাধারণ  পার্টি কর্মী এবং প্রার্থী মিনাক্ষী মুখার্জি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। মিটিং, মিছিল, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামনের সারিতে থেকেছে কমঃ মিনাক্ষীরা। এমনকি পার্টির ভুল স্বীকারের কথাও উঠে এসেছে তার মুখে। এই লড়াকু কর্মীরা পার্টির সম্পদ। কিন্তু পার্টির ডানপন্থী ঝোঁককে রুখতে হলে দলের নয়াউদারবাদী পলিসির বিরুদ্ধেও তাদের লড়তে হবে। নেতৃত্বের চৈতন্য হওয়ার জন্য আজীবন অপেক্ষার বদলে বিকল্প রাজনীতির সন্ধান তাদের করতে হবে। তারা না পারলে পার্টির ছত্রছায়ার বাইরে থাকা নব্য উদীয়মান রাজনীতিমুখর যুব সমাজকেই সেই ব্যাটন কাঁধে তুলে নিতে হবে। এটাই যুব নেতৃত্বের কাজ। স্থিতাবস্থা বজায় রাখা তার শোভা পায় না।

সূত্রঃ

১. http://jabardakhal.in/english/the-empire-of-large-capital/


Comments

  1. সহজ কথায় সুন্দর বিশ্লেষণ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views