আমি নিজেকে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে অবিচল এক বিপ্লবী মনে করি

 (কোবাড ঘান্দীর সাক্ষাৎকার)-মন্দিরা নায়ার

বঙ্গানুবাদঃ বহ্নিহোত্রী হাজরা 

[মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্কে একটি স্নিগ্ধ বিকেলে বসে আছি সেই মানুষের সঙ্গে, সরকারের ভাষায় যে কিনা "বড় মাছ" অর্থাৎ ভীষণ ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক ব্যক্তি। বিকেলের সেই মনোরম পরিবেশেও কোবাডকে বেঞ্চে বসে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের বিফলতা, বৈপ্লবিক পরিবর্তন-জেল জীবনের যন্ত্রণা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে দেখে ঘোড়ায় চড়া বিশাল শিবাজির মূর্তিটির মতোই বিরাট মনে হচ্ছে ।]


প্রঃ কোথাও যেন মনে হয় আপনি যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন তা আপনার জানাশোনা সমস্ত পরিধির থেকে আপনাকে একটা বিরতি এনে দেয়...

উঃ হ্যাঁ নিশ্চিত ভাবেই।

প্রঃ এটি কি একটি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সিদ্ধান্ত ছিল?

উঃ যুবক-যুবতীদের মধ্যে সেই সব দিনগুলিতে প্রবল আদর্শবাদ ছিল। বিশ্বজুড়ে সেই সময়টাতে প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছিল। এটা সত্যি যে আমরা ভেঙে বেরিয়েছি। কিছুটা কঠিন ছিল। তাছাড়া আমি লন্ডনেও (বিপ্লবে সক্রিয় অংশগ্রহণের আগে) বেশ সাধারণ জীবনযাপন করতাম। এমন নয় যে আমার বাবা-মা বিশাল বড়লোক ছিলেন। আমার বাবা গ্ল্যাক্সোতে চাকরি পেয়েছিলেন এবং যা বেতন পেতেন তাতে আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যেত। এর আগে, আমি পড়াশোনা করেছি দুন স্কুলে তারপর লন্ডনে। সেই সময়কালে সমাজে প্রবল আলোড়ন ছিল।   

     আমি আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনেক সমর্থন পেয়েছি, তাই এই সিদ্ধান্ত আমি নিতে পেরেছি। আমি তাদের সাথে সেই সময় একই বাড়িতে থাকতে পারতাম। তারপরে, আমরা (আমি এবং আমার স্ত্রী) নাগপুরে চলে এসেছি। এমন নয় যে আমরা রাস্তায় ছিলাম। আমার স্ত্রী (অনুরাধা) কলেজে শিক্ষকতা করতেন। আমাদের জীবনযাত্রা কঠিন ছিল, কারণ আমরা তখন একটি বস্তিতে থাকতাম।  

প্রঃ আপনি আদর্শবাদের কথা বলছেন। আপনি বস্তিতে না থেকেও তো উন্নয়নের পক্ষে কাজ করতে পারতেন ...

উঃ যখন কেউ ভালো থাকে না একমাত্র তখনই তার মনকে গ্রাস করে এই ধরনের চিন্তা। তবে আমরা নিজেরাই শ্রেণীচ্যূত হওয়ার প্রশ্নে পরিষ্কার ছিলাম আপনি যদি জনগণের সাথে একাত্ম না হন, তবে সত্যই আপনি তাদেরকে আমূল পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন না আমরা অনুভব করেছি যে আইভরি টাওয়ারে থাকা আমাদের পক্ষে কিছুটা ভণ্ডামিই হত

প্রঃ আপনার কি এটা ত্যাগ বলে মনে হয়?

উঃ ত্যাগ বলে মনে করি না। বরং মনে করি এটাই ছিল প্রয়োজন। এটা খুব স্বভাবিক বিষয়।

প্রঃ বেড়ে ওঠার সময় আপনি ছিলেন অন্তর্মুখী... তখন কি এসব বিষয়ে কোনও চর্চা ছিল? আপনি কি সমাজে থাকা বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন?

উঃ আমি অন্তর্মুখী ছিলাম এবং সামাজিকভাবে সচেতন ছিলাম না। লন্ডনের অভিজ্ঞতা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় (তিনি দেখেছিলেন এক ভারতীয় যুবককে সাদা চামড়ার এক যুবক ধাক্কা মারে)। এটি বর্ণবাদের একটি নির্দিষ্ট নমুনা, যা আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। বাইরে যাওয়ার সাথে সাথে দেখলাম যে এই জাতীয় ঘটনা অন্যান্য মানুষকেও কীভাবে প্রভাবিত করে। আমার মধ্যেও তার কিছুটা প্রভাব পড়েছিল। তার আগে আমার মধ্যে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র বা সমাজ বা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের তেমন প্রভাব ছিল না। আমি মনে করি সে সময় নিজে নিজেই বাইরে থেকে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আমাকে স্বাধীনতা সম্পর্কিত চিন্তার বিশেষ উপাদান দিয়েছে। আপনার নিশ্চয়ই মনে থাকবে ১৯৬০ এবং ১৯৭০- এর দশকের শেষের দিকে, সারা বিশ্বে প্রাণবন্ত আন্দোলন ছিল। যখন একবার আমি আশেপাশে তাকাতে শুরু করলাম,ভাবতে শুরু করলাম, তখন দেখার অনেক কিছুই ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল, চীনে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল - যার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার সাথে আসা নেতিবাচক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা হয়েছিল। নকশালবাড়ি [অভ্যুত্থান] সবেমাত্র ঘটেছিল তখন। একে ঘিরে যে সাহিত্য তৈরি হচ্ছিল, তা সেখানেও (লন্ডন) পাওয়া যেত। আমি যে বিষয়েই জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছি, তার সুযোগ পেয়েছি; কোন সীমাবদ্ধতা ছিল না।   

প্রঃ আপনাকে মাওবাদী নেতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আপনাকে নকশাল বলা হয়েছে। আপনি নিজেকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?

উঃ আমি নিজেকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য উৎসর্গীকৃত একজন র‍্যাডিকাল হিসেবে বিবেচনা করি। আমি দলিতদের কল্যাণ-এর মতো অনেকগুলি বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। আমি আম্বেদকর, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগত সিং এবং মাও সে তুং, লেনিন এবং অন্যান্যদের অনুসরণ করি। মূলত, আমি সমাজকে বুঝতে এবং পরিবর্তন করতে মার্কসবাদী পদ্ধতি ব্যবহার করি। আমাকে মিডিয়া মাওবাদী তকমা দিয়েছে। এদিকে আমি চার রাজ্যে মাওবাদী অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছি।

     আমি বিশ্বাস করি যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি জনগণের সমস্যা বা প্রশ্নকে সম্বোধন করতে অপারগ; অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিগুলি যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং কিউবা লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে বা অনেকাংশে উন্নত করেছে। আসলে, গোটা পৃথিবীতে এবং ভারতে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রয়োজন, যদিও আঙ্গিকের পরিবর্তন হতে পারে। আমি মূলত একজন অর্থনীতিবিদ এবং একজন মার্কসবাদী হিসাবে আমি অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে সামাজিক বিষয়গুলির অনুসন্ধান করি। আমি অনুভব করি যে আমাদের দেশে সত্যিকারের অগ্রগতির জন্য অর্থনীতিতে পরিবর্তন অপরিহার্য, এবং বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই কেবলমাত্র তা ঘটতে পারে। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে হবে না অন্যভাবে হবে, তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।

প্রঃ বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলতে আপনি কী বোঝেন?

উঃ মানে অর্থনীতির একটি অ-পুঁজিবাদী রূপ। মূলত, একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। এখন সমাজতন্ত্র এমন অস্পষ্ট একটা শব্দ; মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স থেকে যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য জেরেমি কর্বিন, সকলেই দাবি করেছেন তাঁরা সমাজতান্ত্রিক। তবে এই ধরনের সমাজতন্ত্র মূলত ধনতন্ত্রের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণকারী মুষ্টিমেয় শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেশন-গুলিকে বজায় রেখে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দে আরও ব্যয় করেও মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বজায় রাখে। এটি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খানিক বেশি ইতিবাচক হলেও  দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়।

প্রঃ আপনি বিপ্লবী হওয়ার কথা বলেন। র‍্যাডিকাল হওয়া আর বিপ্লবী হওয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

উঃ মূলত, একই জিনিস। আসলে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। কীভাবে করা হবে, তা অনেকাংশে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।

প্রঃ কীভাবে?

উঃ অ্যাক্টিভিজমের পদ্ধতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, আরও অনেক কিছুই। এটি বিদ্যমান অবস্থার উপর নির্ভর করে। বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটি বড় বিপ্লব হয়েছিল, যখন শাসকশ্রেণীরা একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এমনকি প্যারি-কমিউন, অর্থাৎ প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ঘটেছিল ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের সময় ।

     শান্তির সময়ে, বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার। তবে আমি কোনও বামপন্থী সাহিত্যে আজ অবধি এই বিষয়ে কোনও আলোচনা হতে দেখিনি যে, সেসব দেশে বিপ্লব যুদ্ধের সাথে কীভাবে সংযুক্ত ছিল। আমি সাম্প্রতিককালে আমার গবেষণাটি চালানোর সময়ই সেই বিষয়টির ধারণা দিয়েছিলাম। সুতরাং, কট্টরপন্থী বা বিপ্লবী, যাঁদের কথাই বলুন না কেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, যা পরে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলিতেও প্রতিফলিত হবে।  

প্রঃ আপনি কি বলছেন যে পরিবর্তনের জন্য হিংসা দরকার?

উঃ যুদ্ধবিহীন পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তনের রূপগুলি গ্রহণ করা দরকার, সেগুলিকে বিবেচনা করতে হবে। ভারত ও বিশ্বের যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রয়োজন তার বিষয়ে আমি আরও স্পষ্ট; বর্তমানে যা ব্যবস্থা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক হওয়া উচিত। হিংসা তো সমাজেই বিদ্যমান। ইতিহাস হিংসা নিয়েই উত্তাল। আজও, লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধে এবং অসুস্থতায় এবং মানবসৃষ্ট দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছেন। এ সবকিছুই ভীষণ হিংস্র। তাই আমি মনে করি এটি একটি নন-ইস্যু। যখন বিদ্যমান ব্যবস্থাটি এতটা হিংস্র, তখন কোন যুক্তিতে তারা আমাদের মুখে এই প্রশ্ন বসানোর চেষ্টা করে? প্রথমে তাদের উত্তর দেওয়া উচিত, যে তারা শান্তিপূর্ণভাবে শাসন করতে চায় কি না। শাসকরা কি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটতে দেবে?

প্রঃ আপনি বলেছেন গণতন্ত্রের ফলশ্রুতিতে বাস্তবের মাটিতে পরিবর্তন হয় না।

উঃ আমি এটা কখনই বলিনি। আপনি আমার মুখে কথা বসিয়ে দিচ্ছেন। ভেনিজুয়েলা, গ্রীস এবং এ জাতীয় অন্যান্য দেশগুলি ছিল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের উদাহরণ, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী ১৫০-টি দেশে রয়েছে। কেন?

প্রঃ আপনার কি মনে হয় গণতন্ত্র সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে?

উঃ আমি মনে করি যদি কোনও দেশ সত্যই গণতান্ত্রিক হয়, তা অবশ্যই পরিবর্তন আনতে পারে। যদি আমি সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াই এবং আমি নির্বাচিত হই, তখন সেখানে কোনও ক্যু হওয়া উচিত নয়। আমি যদি বলি যে আম্বানি-আদানীর মতো মুষ্টিমেয় বৃহৎ পুঁজিপতির সম্পদ হস্তান্তর করা উচিত, কারণ এই পদক্ষেপই আরও মানবিক সমাজে উত্তরণের পথকে প্রশস্ত করে দেবে, তাতে কী ভুল আছে? বর্তমান ব্যবস্থায়, জনগণের হাতে থাকা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বড় বড় কর্পোরেশনগুলিতে চালান করা  হচ্ছে।

     তবে গণতান্ত্রিক শব্দটির প্রকৃত অর্থেই প্রয়োগ হওয়া উচিত; যেখানে সরকার থাকবে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থে এবং আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য।

প্রঃ আপনি কমিউনিজমের ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলেছেন। কেন বিপ্লব অর্থাৎ আপনার মতে লাল বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন? আপনি কি মনে করেন সত্যিই এটি ব্যর্থ হয়েছে?

উঃ ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন আমি কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকেছি তখন প্রায় অর্ধেক বিশ্ব কমিউনিস্ট ছিল। আমাদের কাছে তখন বিশ্বব্যাপী বিপ্লব সংঘটিত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু আমি এখন তেমন কোনও কমিউনিস্ট আন্দোলন দেখছি না। মানুষের অবস্থা ১৯৭০-এর দশকের চেয়ে দশগুণ বেশি খারাপ। আজ মানুষের সামনে আর কোন আশা নেই। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির কোনটাই স্থিতিশীল হতে পারেনি। এমনকি চীন কেবল নামেই কমিউনিস্ট। সেখানে এখন প্রচুর কোটিপতি আছেন। অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে এটুকু বলা যায় তারা তাদের জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের অর্থনীতি আমেরিকার সাথে পাল্লা দিচ্ছে।

প্রঃ কিন্তু সেখানে কী মারাত্মক কঠোর আইনকানুন!

উঃ তা সত্যিই। তবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলিও এক্ষেত্রে কিছু কম যায় না। আমি মনে করি যে সামাজিক পরিবর্তনের যে কোনও প্রকল্পে তিনটি দিক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যদি এটিকে দীর্ঘস্থায়ী এবং আরও মানবিক করতে হয়। আমি আমার বইতে এগুলিতে জোর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি অনুভব করি, যে কোনও আন্দোলনে, যখনই কেউ আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন, নেতৃত্ব এবং জনগণের একটি মূল্যবোধের ব্যবস্থা থাকা উচিত; আমি আমার বই এবং অন্যান্য নিবন্ধগুলিতে মূল্যবোধের ব্যবস্থার রূপরেখা দিয়েছি। তাদের উচিত আমার স্ত্রী অনুরাধার মতো হওয়া — সৎ, সরল এবং ক্ষমতার বিষয়ে নির্লোভ। বাম পরিসরে অর্থের চেয়েও ক্ষমতার লোভ বেশি দেখা যায়। অন্যান্য ব্যবস্থায় অর্থ এবং ক্ষমতা এই দুটির প্রতি লোভই যে কোনও ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্থ করে।

     দ্বিতীয় বিষয়: আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুখী জীবনযাপন। এটির প্রতিফলন দেখা যাবে আপনার সাংগঠনিক কাজে এবং প্রত্যেকের সাথে বিশেষত জনগণ এবং ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই, জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তাই যে কারও জন্য সুখী হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হবে।

     তৃতীয় দিক- জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা থাকা উচিত, যা প্রায়শই থাকে না।

প্রঃ কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও?

উ: আমাদের চেনা জানা পরিসরে। আমি আমার গ্রন্থে সংগঠনের কাঠামো, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ইত্যাদির উদাহরণ দিয়েছি, যেখানে নামে গণতান্ত্রিক তবে বাস্তবে কেন্দ্রীকতাবাদই প্রধান। এই তিনটি আঙ্গিককে মূল কাঠামোর স্থায়ী অঙ্গ হিসেবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে গড়ে তোলা জরুরি। বিশেষত ভারতে, যেখানে বর্ণভেদ [জন্মগতভাবে] দ্বারা একজন ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয়। আমরা অর্থ এবং ক্ষমতা বাদ দিয়ে চলতে পারি না, তবে তাদের নেতিবাচক প্রভাবগুলি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে।     

প্র:  বইটিতে আপনি বলেছিলেন যে মানুষ কেন সত্যিকারের স্বাধীনতার চেয়ে বাজার অর্থনীতিকে বেছে নিয়েছে, তা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। আপনি কি বিশ্বাস করেন যে এটিই আসল সমস্যা?

উঃ আমি মনে করি এটিই আসল প্রশ্ন। আমি মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে এবং কীভাবে সাধারণ মানুষ  এবং সমাজ পরিবর্তনের কর্মীদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আনতে পারা যায়, সেই পদ্ধতির আরও বিকাশ ঘটাতে চাই। আভ্যন্তরীণভাবে পরিবর্তনগুলি বোঝার ক্ষেত্রে এখন মার্কসবাদীরা কিছুটা যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। কেউ মার্কসবাদ, মাও-এর লেখাপত্র ইত্যাদি পড়েন এবং ধরে নেন যে এর ফলে আমাদের আবেগ এবং মূল্যবোধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন আসবে। মনোবিজ্ঞান আমাদের জানায় যে আমাদের অবচেতন মন, যা আমাদের আবেগকে নির্ধারণ করে, তা আমাদের শৈশবেই নির্মিত হয়েছিল। আরও বিশেষত আমাদের জীবনের প্রথম সাত বছরে। আমাদের মতাদর্শের পরিবর্তনের সাথে সাথে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয় না।

     সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, বর্ণবাদ এবং পুরুষতন্ত্রের মতো ব্যবস্থাগুলি আমাদের মনস্তত্বে এত গভীরভাবে গেঁথে গেছে যে মতাদর্শগতভাবে মার্কসবাদী হয়ে উঠলেও, তা এখনও আমাদের মধ্যে থেকে যেতেই পারে, সচেতন মন যদি না একে মুছে ফেলার চেষ্টা করে তাহলে। আমি দেখেছি যে এই বিষয়গুলি সংক্ষিপ্তভাবে হলেও আমাদের চেতনাতে বিদ্যমান, যদিও এগুলি অপরাজেয় নয়। এই ব্যাপারটা অন্যান্য সমস্ত মূল্যবোধের ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়, কারণ আমরা বুর্জোয়া পরিমণ্ডলে বাস করি যেখানে স্বার্থপরতা রয়েছে সর্বস্তরে এবং একজন আরেকজনকে ঠেলে নীচে নামিয়ে দিয়ে আত্মপ্রচার পাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। আমরা এই ধরনের আচরণ এমনকি কমিউনিস্ট আন্দোলনে, মার্কসবাদী পরিসরেও দেখতে পাই।

প্রঃ আপনি বর্ণ ব্যবস্থার কথা বলেছেন। আপনি বলছেন কমিউনিস্ট আন্দোলন বর্ণব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।

উঃ  কমিউনিজম বলা ভুল, বরং বলা ভালো ভারতীয় কমিউনিস্টরা। তাদের মধ্যে যান্ত্রিকভাবে বর্ণব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা রয়েছে। মার্কসবাদ কোনও ধর্মীয় পাঠ নয়, বরং এমন একটি দর্শন যার সৃজনশীলভাবে ব্যাখ্যা হওয়া উচিত যে দেশে এটি চর্চা করা হচ্ছে তার নিরিখে। এই ধর্মান্ধতার জন্যই আমি অনুভব করি যে কমিউনিস্টরা বর্ণবাদের বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনায় পিছিয়ে যাচ্ছেন।   

     এটি হিন্দি বলয়ে যে কেউ বুঝতে পারে। এখানে তেমন কোনও বড় সমাজ সংস্কার আন্দোলন হয়নি। এমনকি মহারাষ্ট্রের মতো জায়গায় যেখানে ভক্তি আন্দোলন হয়েছে এবং জ্যোতিরাও ফুলে এবং আম্বেদকরপন্থী আন্দোলন হয়েছে সেখানকার লোকেরাও বলেছে, 'তুমি কোন জাতের?' উদাহরণস্বরূপ, বিহারের দিকে যদি দেখি, যেখানে সিপিআই এবং এমসিসির (মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র) একসময়ে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল, বিশেষভাবে বললে সিপিআই বেশিরভাগ ভূমিহারের (ভূমি মালিকদের) মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং বেশী র‍্যাডিকাল এমসিসির ঘাঁটি দরিদ্রতমদের মধ্যে, যাদের বর্ণব্যবস্থায় হরিজন বলে অভিহিত করা হয়, সেখানেও দেখব তারা এই বিষয়টি নিয়ে বাস্তবে কাজ করলেও, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বলে যে এটি সমস্তটাই শ্রেণি সংগ্রামের অঙ্গ - এ হল যান্ত্রিক ব্যাখ্যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নেতৃত্বে জাতপাত বা বর্ণ ভিত্তিক ক্ষমতার বিন্যাসের কারণেই হয়ত এই ঔদাসিন্য।

প্রঃ আপনি কি এখনও সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছেন?

উঃ আমি একজন পর্যবেক্ষক এবং সর্বোপরি একজন সমাজকর্মী। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এবং মূলত দলিতদের মধ্যে আমি কাজ করার চেষ্টা করি, তবে সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনগুলিকেও পর্যবেক্ষণ করি। কমিউনিস্ট আন্দোলন, দলিত আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন- যাই হোক না কেন, আমি তার  ইতিবাচক এবং  নেতিবাচক দিকগুলি সমালোচকের চোখে দেখে বিবেচনা করি।   

প্রঃ কমিউনিস্ট আন্দোলনে কিছু নির্দিষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আপনি কি তার বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়েছেন?

উঃ আমি বলব না এটি বিভ্রান্তি বা হতাশা। কখনও কখনও হয়ত আমি বিরক্ত এবং অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছি। তবে গভীরে গিয়ে চিন্তা করে আমি এগুলিকে আমার অভিজ্ঞতার অঙ্গ হিসাবেই দেখছি।  

     আমি শুধু কিছু ব্যক্তি, সংগঠন বা দলের সমালোচনা করি না। আমি বিষয়টিকে দার্শনিকভাবেই দেখছি, কী সংশোধন করা দরকার।  জীবন এই অভিজ্ঞতায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে এবং আমি মানুষের যন্ত্রণা দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এই সমস্ত অভিজ্ঞতা তারই অঙ্গ।  

     বেশীরভাগ মানুষের জন্য সর্বাধিক ন্যায়বিচার পেতে পরিবর্তন বলতে কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনই হতে পারে, অর্থাৎ যা সমাজতান্ত্রিক মডেলের সাথে যুক্ত। এই বইয়ের মাধ্যমে আমি ধরতে চেয়েছি পরিবর্তনের যে কোনও মডেলে কোন কোন দিকগুলির অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। এই অর্ধ শতাব্দীর অভিজ্ঞতা না থাকলে এই বিষয়ে ধারণা করা সম্ভব হত না।  

প্রঃ আপনি বর্ণব্যবস্থা সংক্রান্ত সমস্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে কমিউনিস্টদের ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলেছেন। কারাগারে থাকাকালীন আপনি কি এই বিষয়টিকে সম্বোধন করেছেন?   

উঃ আমরা যখন বাইরে ছিলাম, যদিও আমরা অনুভব করেছি যে কিছু ভুল হচ্ছে, তখন সত্যই বিষয়টিকে  সম্বোধন করার সময় আমরা পাইনি। এছাড়াও, ইতিবাচক, সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোনও কিছু তুলে ধরতে আপনার মানসিক প্রশান্তি প্রয়োজন। এমনকি কারাগারেও সেই মানসিক স্থিতি আপনি পাবেন না।  প্রথম তিন বছর আমার ভাগ্য ছিল প্রসন্ন। কিন্তু তার পরে, ওরা প্রতি দুই বা তিন মাস পর পর আমাকে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত করতে শুরু করে। আমি কোন চিন্তা স্থির হয়ে করতে পারিনি, লিখতে পারা দূরে থাক। তখন  ছিল বেঁচে থাকার এবং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই  চালিয়ে  যাওয়ার সময় । তিহার বেশ অমানবিক জায়গা। মনে এমন ধারণা চেপে বসে যে এখান থেকে কখনই বেরোনো যাবে না। সেই অস্থিরতায়, আপনি কখনই সঠিকভাবে কোনও বিষয়কে প্রতিফলিত করতে পারবেন না। অনেকটা সময়ের পরে, আমি সত্যিই এটি করবার চেষ্টা করেছি। আমি আমার শরীরকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতাম। আমি যোগব্যয়াম এবং শরীর চর্চা করতে শুরু করি। কিছু লেখা শুরু করলাম। আমি সৌভাগ্যবান যে সুমিত চক্রবর্তীর (Editor of Mainstream) মতো কাউকে পেলাম। তিনি এই সমস্ত নিবন্ধ ছাপার জন্য নিয়মিত আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতেন। আপনি যদি কোনও বিষয়ে গভীরে গিয়ে চিন্তা করেন এবং কেবল লেখেন অথচ কেউ সেটা পড়ে না, তখন আপনি সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। আত্মবিশ্বাস পাবেন না। 

     তারপরে, পরবর্তী বছরগুলিতে, বিজেপির প্রাক্তন উপদেষ্টা সুধেন্দ্র কুলকার্নি এসেছিলেন; আমি তাদের সাথে কথা বলতে পারতাম। 'কাশ্মীরী বিচ্ছিন্নতাবাদী' আজফাল গুরু সেখানে ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী। ওনার সঙ্গে কথা বলে আপনি কিছু নতুন ধারণা পেতে পারেন — রুমি, ইকবাল এবং সমস্ত কিছুর বিষয়ে। তখন কিছুটা প্রাণবন্ত পরিবেশ ছিল, নতুন কিছু ভাবার এবং প্রকাশ করার জন্য। কারাগারে আর কোনও বামপন্থী ছিলেন না। সেখানে কেবলমাত্র ইসলামপন্থী এবং খালিস্তানীরা ছিলেন, তাঁদের গোঁড়া এবং সংকীর্ণ মানসিকতা আমাকে তাঁদের প্রতি বেশ নিরুৎসাহ করেছিল।  

     তিহার লাইব্রেরি থেকে সাহিত্যের বই পাওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। আমাকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি, তবে একটি অল্পবয়সী ছেলে ছিল; উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড-এর মধ্যে থেকেও তার সাথে আমি কীভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছি তা আমি নিজেও ঠিক জানি না; সে আমার জন্য সাহিত্যের বই আনত।  

প্রঃ বিপ্লব বা নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে জনমানসে একটা রোমান্টিক ছবি বিদ্যমান। আপনার মতে এই পথে প্রতিদিনের টিকে থাকার লড়াইটা ঠিক কেমন?

উঃ প্রতিদিনের বাঁচা-মরা, টিকে থাকার লড়াইয়ের গল্প খুব একটা রোম্যান্টিক শোনায় না। বাস্তব হল দরিদ্র মানুষের মধ্যে কঠোর জীবনযাপন।

প্রঃ গোপন অবস্থায় জীবনযাপন আপনার কাছে ঠিক কেমন?

উঃ ১৯৯৯, ২০০০ অবধি আমি বেশিরভাগ সময় নাগপুরেই ছিলাম। পরে অনু বস্তার গিয়ে ফিরে এসেছিল। সুতরাং, আমাদের বেশিরভাগ জীবনে আমরা বেশ খোলামেলাই ছিলাম। আমরা গোপন জীবনে গিয়েছিলাম এটি একটি ভুল ধারণা।  

প্রঃ আপনি তো বস্তারেও গিয়েছিলেন।

উঃ সবাই বলত যে আমরা  গ্রামে কাজ করেছি। আমরা কখনও কোনও গ্রামে কাজ করিনি। অনু সেখানে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দু'বছর ছিল। সকলেই জানেন আমরা নাগপুরের ইন্দোরার একটি দলিত বস্তিতে বাস করছিলাম। বাকিটা মিডিয়ার তৈরি করা চিত্র। তবে আমাদের কোনও আরামের জীবন ছিল না, বিশেষত আমাদের জন্য, যারা কিছুটা সুবিধাভোগী শ্রেণী থেকে এসেছি। নিজেকে প্রতিমুহূর্তে ধাক্কা দিতে এবং ভাঙতে হবে। আমার মনে হয় অনু আরও সহজে মানিয়ে নিয়েছিল।

     অনেকে বলে ‘তুমি কি আফসোস কর? সফল হতে পারলে না!’ সফলতা জীবনে এবং জনসাধারণের সেবার মধ্যে থেকেই খুঁজে পেতে হবে বলে মনে করি। ফলে তাঁদের কথায় আমি মোটেই সম্মত নই। এই জীবন বেছে না নিলে আমি কর্পোরেট চাকরিতে থাকতাম এবং অর্থ উপার্জন করতাম। আমি মনে করি না যে সেটা আমাকে সন্তুষ্ট করত। তাহলে বিকল্প কী ছিল? বরং অনু একজন ভাল একাডেমিশিয়ান হতে পারত এবং কিছু সৃজনশীল কার্যকলাপ সম্ভব হত। তবে আমার তেমন কোনও দক্ষতা বা সম্ভাবনা ছিল না। 

প্রঃ আপনার কাছে এই জীবন তাহলে কেমন?

উঃ এই জীবন অনেক বেশী সংযত, পরিমিত জীবনযাপন। সাধারণ বাসে অথবা ট্রেনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় নাগপুরের অসহ্য গরম সহ্য করে যাতায়াত, ঘিঞ্জি বস্তির ঘরে জীবনযাপন। তখনকার দিনে তো ফোনও ছিল না।  

প্রঃ শুনেছি আপনি খুব খাদ্যরসিক, ভালো খাবার খেতে পছন্দ করেন।

উঃ আমি ভাল খাবার পছন্দ করি, বিশেষ করে পার্সি খাবার পছন্দ করি। তবে, আমরা এই পছন্দকে কখনও প্রশ্রয় দিইনি। কেবলমাত্র যখন আমরা অনুর বাড়িতে যেতাম, বা আমার বাবার কাছে যখন তাঁর জীবিতাবস্থায় যেতাম, তখন ভালোমন্দ খাওয়া হত। তবে তিনি ১৯৯৬ সালে মারা যান।  অন্যথায়,  ডাল, ভাত/রুটি এবং সব্জি আমাদের রোজকার খাবার ছিল।

প্রঃ একটি নিবন্ধে আপনাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে আপনার ‘মুরগির নলি কাটা’ দরকার। নইলে বিপ্লব এলে আপনি কী করবেন? মন্তব্য কী আপনার এ ব্যাপারে?  

উঃ এগুলো সবই রোমান্টিক বিষয়।

প্রঃ তাহলে আপনি কি মুরগীর ঘাড় মটকালেন?

উঃ নাহ! আমি কাউকে মুরগী কাটতে দেখতেই পছন্দ করি না। তবে খেতে বেশ ভালবাসি।

প্রঃ আপনি লিখেছেন যে আপনার বোন আপনাকে সাহায্য করেছিলেন কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না।  সমর্থন করতে পারে, কিন্তু আপনার সাথে হয়ত একমত নয়। 

উঃ আমি মনে করি তাঁরা সমঝদার। আমার বোন আমাকে নিজের কাছে থাকতে দিয়েছে। আমাদের বাবা-মা রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে সমর্থক ছিলেন। তবে বোনের তো  নিজের মতামত এবং জীবন রয়েছে। তবুও, তিনি পাশে দাড়িয়েছেন। অনেক মানুষ এরকম আছেন। আমি লক্ষ্য করেছি আমি বেরিয়ে আসতে পার্সী সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে এই সমর্থনের সেরকম রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। কেবলমাত্র তারা শ্রদ্ধার চোখে দেখে যে আমি একটি আরামের জীবন ছেড়ে দিয়েছি এবং মানুষের জন্য কাজ করেছি। আমি লক্ষ্য করেছি যে এমনকি কিছু ভদ্র পুলিশ কর্মী এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও একাংশের এরকম একটা মত ছিল। দিল্লিতে নয় তবে অন্য জায়গাগুলিতে আমি তা লক্ষ্য করেছি। তারা এর সাথে একমত হতে পারে না তবে তারা শ্রদ্ধা করে যে, এই যুগে কেউ জীবনের সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্যগুলি ছেড়ে দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে পারে।

প্রঃ তাঁরা বোঝদার কিন্তু সমর্থক নন, তাই বলতে চাইছেন তো?

উঃ আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা অনেকের মধ্যে না থাকতে পারে, কিন্তু দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অবশ্যই এই কাজের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

প্রঃ আমি আপনার সাথে অনুর সম্পর্কের কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনি বইটি লিখেছেন তো তাঁর অনুপ্রেরণায়। আপনি কখন তার সাথে প্রথম দেখা করেছেন? কেমন ছিলেন অনু?  

উঃ বই লেখার একমাত্র কারণ সেটা নয়। আমি আমার অভিজ্ঞতাগুলি লিখে রাখতে চেয়েছিলাম যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম এই ধরণের বিষয়ে আরও কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। আসলে এটাই উদ্দেশ্য। অনুকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি মূল্যবোধের ব্যবস্থার দিকটি  নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।     

     আমি লন্ডন থেকে ফিরে আসার সাথে সাথেই অনুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে, সে এলফিনস্টোন কলেজের একজন ছাত্র-নেত্রী ছিল। সময়ের সাথে সাথে সে আরও বেশি করে র‌্যাডিক্যালাইজড হয়ে উঠল। বিজয় টেন্ডুলকারের মতো শীর্ষস্থানীয় থিয়েটার শিল্পী, আমাদের ঘনিষ্ঠ  ছিলেন এবং আমাদের সমর্থন করতেন। সে ছিল এক ভিন্ন যুগ। বিশ্বব্যাপী, তখন  র‌্যাডিকাল আন্দোলন জোরদার ছিল ... কিছু সশস্ত্র, কিছু নিরস্ত্র। আমরা সকলেই অনুভব করেছিলাম দ্রুত পরিবর্তন আসবে।    

     অনুর অনেক ভালো গুণ ছিল। সমস্যা হ'ল, বাম পরিধিতে এগুলিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সাধারণ সমাজেও নয়। কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হয় আপনার দক্ষতাকে। আপনি যদি একজন ভয়ঙ্কর ব্যক্তিও হন, তবু আপনি যদি ফলাফল পেতে সক্ষম হন, তবে আপনার পদোন্নতি হবে। অনুর এই বৈশিষ্ট্য বা দক্ষতাও ছিল, তবে তার মূল্যবোধ প্রশংসনীয়। এটা তার কাছে খুব স্বাভাবিক ছিল। অবশ্যই তাকে নেতৃত্ব নিয়ে আসবার প্রধান কারণ হ'ল তার সাংগঠনিক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতা।

প্রঃ যখন সে মারা গেল, আপনি বলেছিলেন এটি আপনার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন।

উঃ অনু ঝাড়খণ্ড থেকে ফিরে এসেছিল। সেখানে তার একটি মহিলাদের ক্লাস নেওয়ার কথা ছিল। আমি তাকে না যেতে বলেছিলাম। ও সিস্টেমিক স্ক্লেরোসিসে ভুগছিল। তার আঙ্গুলগুলি অচল হয়ে পড়ছিল। আসলে তার বাত ছিল। এই রোগ ওর মায়েরও ছিল। এটি বংশগত। কিন্তু তার দায়িত্ববোধ এতটা দৃঢ় ছিল যে সে চলে গেল। যখন সে ফিরে এল তখন আমি দিল্লিতে ছিলাম। সে তখন অসুস্থ ছিল। একটি পরীক্ষা করা হল, যার ফলাফল নেতিবাচক ছিল। এই ল্যাবগুলি নিয়ে আমার খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, তবে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা যখন সবেমাত্র হাসপাতালে পৌঁছাচ্ছি তখন সে কোমায় চলে গেছে। এটা আমাকে সত্যিই হতবাক করেছিল, কারণ তার আগে সে তুলনামূলকভাবে ঠিকই ছিল। ওটাই ছিল ওর আরেকটি বিশেষত্ব। অনু কখনই দেখাত না যে সে অসুস্থ। ওইদিনের পর সে কখনই আর কোমা থেকে বেরিয়ে আসেনি। সত্যিই সেদিন আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ দিন ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমরা কেবল হাসপাতালে গিয়ে ফিরে আসব। দেখলাম তাকে স্পষ্টতই একটি ভেন্টিলেটরে রাখল। গোটা একটা দিন এবং রাত জুড়ে ভেন্টিলেটরেই ছিল।           

প্রঃ আপনি সেখানে ছিলেন না?  

উঃ আমি হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু ওরা একবারও আমাদের কথোপকথনের অনুমতি দেয়নি। আমি সেখানে থাকতে চাইতাম না।  দূরে দূরে থাকতাম।  অনুর মা সম্প্রতি মারা গেলেন। মনে হয় এটিই প্রথমবার যখন আমি কোনও মৃতদেহের কাছে এলাম। আমি এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারি না।  

প্রঃ দুঃখ আপনাকে বিভিন্নভাবে আঘাত করে। আপনি কি মনে করেন যে সেই ঘটনার পর আগের আপনি কি বদলে গেলেন? 

উঃ | আমি মনে করি না যে এর পরে আর কিছুই একই রকম ছিল। তার স্বাস্থ্যের যা অবস্থা ছিল গ্রেপ্তার না হয়ে উপায় ছিল না বলা যায়। বেশি বয়সে সেই যন্ত্রণা তার পক্ষে খুব খারাপ হত। বিষয়গুলিকে ইতিবাচকভাবে দেখা ভাল, সেক্ষেত্রে কষ্ট কম হয়। সিস্টেমিক স্ক্লেরোসিস সহ তার রোগ তাকে খুব ভোগাচ্ছিল। হয়ত অক্ষম হয়ে পড়ত। তার আঙ্গুলগুলি ইতিমধ্যে খারাপ ছিল। সে কিছুই ধরতে পারছিল না। 

প্রঃ  ভবিষ্যত কী? আপনি কি মনে করেন যে সরকার "লাল বিপ্লবকে" বিপর্যস্ত করে দিতে পেরেছে?

উঃ  সরকার তা করতে পারেনি। যদিও আন্দোলন হ্রাস পেয়েছে।  বিপ্লবী আন্দোলন অগ্রসর হয়নি। আমি কারাগারে থাকাকালীন উচ্চস্তরের কর্মকর্তাসহ অনেক লোক আমার কাছে এসেছিলেন। আমি বলেছিলাম যে বস্তারের মতো কিছু অঞ্চলে তারা (মাওবাদীরা) ভাল কাজ করছে। ঝাড়খণ্ডে, আমি জেলে থাকাকালীন বুঝতে পেরেছিলাম, সেখানকার মাওবাদীরা মাফিয়ার মতো। আমি অফিসারদের বলেছি যে তারা যেন আলোচনা করে। কিছু বোঝাপড়া হোক। ইতিবাচক হলে তারা তাদের উন্নয়নমূলক কাজ চালিয়ে যেতে পারে। আমি বলতাম অফিসারদেরকে, আপনি তাদের পরাজিত করছেন না; বিষয়টা এভাবে শেষ হওয়া সম্ভব নয়। নাগাদের সাথে আপনারা চুক্তি করতে পারেন, যারা পৃথক দেশ চায়; অথচ যাদের উন্নয়নের ভিন্ন মডেল রয়েছে তাঁদের সাথে আপনারা শান্তি স্থাপন করতে রাজি নন! আপনি কি চান যে আপনার খনি সহ সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটি অধিগ্রহণ করা এবং সমস্ত কিছু ধ্বংস করা উচিত? তারা চায় গ্রামবাসী, বন এবং পরিবেশের বিকাশ হোক। আসলে এটি তো গান্ধীবাদী আদর্শের জায়গা। তো, কেন আপনি আলোচনা করবেন না?  

প্রঃ  আপনি কি কখনও সেখানে ফিরে যেতে চান?   

উঃ| কোথায়? এই কাজে? না না। এই বয়সে বুনিয়াদি স্তরে গিয়ে কাজের জন্য আমি শারীরিক বা মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে নেই। আমি বরং যতটুকু জীবনীশক্তি রয়েছে তা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা লিখি যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম পরিবর্তনের পক্ষে এই কাজে আরও ভালো ফল পেতে পারে।

প্রঃ আপনি কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা সম্পর্কে লিখেছেন যখন আপনি কারাগারে ছিলেন তখন তিনি আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর করতেন। আমার  মনে হয় আপনার এবং পার্টির মধ্যে ফাটল রয়েছে। এটা আমার ধারণা। এটা কি সঠিক?  

উঃ আমি জানি না। আমার সবসময় নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল। এবং এত বছর ধরে আমি সবকিছু থেকে দূরে রয়েছি।

প্রঃ | আপনি কি  কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন?

উঃ  আমি কোনদিনই ছিলাম না। রাজা তাঁর ব্যক্তিগত সামর্থ্যে সহায়তা করেছিলেন। এখানে অনেক মার্কসবাদী সংগঠন রয়েছে। তারা সকলেই নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করে।  

প্রঃ  তাহলে আপনি কি আপনার সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছেন? কবে?  

উঃ  বাম দলগুলির বেশিরভাগই নিষিদ্ধ নয়। কয়েকটি নিষিদ্ধ এবং শুধুমাত্র সেগুলির সদস্যপদ থাকলেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আমন্ত্রণ জানিয়েছে রাষ্ট্র। আমার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ দলের সদস্য হওয়ার যত অভিযোগ ছিল, চার রাজ্যে মামলার পরে প্রত্যেকটি থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে মিডিয়া আদালতের সিদ্ধান্তের বিপরীতে রিপোর্ট করে চলেছে। সমস্যাটি হ'ল বেশিরভাগ মিডিয়া সরকার / পুলিশ-এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবেদন করে বলে মনে হয় এবং আদালতগুলিতে তাদের বিশ্বাস নেই বলেই মনে হয়। এছাড়াও যে দলের আমি সদস্য হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেটিকে আমার গ্রেপ্তারের মাত্র তিন মাস আগে নিষিদ্ধ তালিকায় আনা হয়েছিল।

প্রঃ  সুতরাং আপনার জীবনের পরবর্তী অধ্যায় লেখা সম্পর্কিত হবে।  

উঃ  হ্যাঁ, অর্থনীতি নিয়েও। আমি অনুভব করি যে বিশ্বের অর্থনীতির পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার মতো পরিস্থিতি। এই বইটির জন্য খুব বেশি অধ্যয়নের প্রয়োজন নেই। আমি সেই পড়ার অভ্যাসটি হারিয়ে ফেলেছি। যাকে বলে খুব খুঁটিয়ে পড়া। আমি এখনও পড়ি এবং নোট তৈরি করি, তবে খুব  ধীর লয়ে। আমি যদি এই গতিতে কাজ করি তবে আমি মৃত্যুর আগে বেশি কিছু উত্পাদন করতে সক্ষম হব না। আমাকে উন্নতি করতে হবেই এই দিকটিতে এবং এটিকে সহজ করার জন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখতে হবে।    

প্রঃ  আপনার মুক্তির পরে দিনগুলি কেমন কাটছে?

উঃ  আমার মুক্তির ছয় মাস পরেই কোভিড এল আর আমরা লকডাউনে চলে গেলাম। মুক্তির পরে, আমার আর যাওয়ার কোনও জায়গা ছিল না। আমি ভাগ্যবান যে আমার বোন আমাকে তাঁর বাড়িতে রেখেছেন। আমি, আমার বোন এবং ভগ্নীপতির সঙ্গে থাকি। প্রথম তিন-চার মাসে আমাকে প্রতি মাসে আদালতে যেতে হয়েছিল; আমাকে ঝাড়খণ্ডের একটি মামলায় উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। আমার আধার এবং অন্যান্য নথিপত্র পেতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। আমি এত দিন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম, তাই এই বিষয়গুলি সম্পর্কে কীভাবে চলতে হবে তা আমি জানতাম না .... আমাকে লাইসেন্স নিতে হয়েছিল এবং আইনি ডকুমেন্টেশন তৈরি করতে হয়েছিল। আর তারপর আমি যখন এই বইটি লেখার কথা ভাবতে শুরু করি তখন মহামারী দেখা দিল।  



 Picture Courtesy: The Week, ibpbooks.com 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

পুঁজিবাদ আপনাকে নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে

রিপিট টেলিকাস্ট

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে